X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০
ঘোড়াঘাট ইউএনও’র ওপর হামলা

৫ ধরনের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ শতভাগ নিশ্চিত আসামি হচ্ছে রবিউল

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
০১ অক্টোবর ২০২০, ১০:০০আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫৯

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের আমলি আদালতে তোলা হয়েছে ইউএনও ওয়াহিদার ওপরে হামলা মামলার আসামি রবিউলকে। (ফাইল ছবি)

দিনাজপুরে আবারও আলোচনায় ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী শেখের ওপর হামলার ঘটনা। মঙ্গলবার প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছে এই ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করা আসামি রবিউল জড়িত নয়। ফলে ঘটনাটি আবারও আলোচনায় এসেছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ৫ দিকের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই ঘটনায় রবিউলের সম্পৃক্ততা শতভাগ বলে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। এই ৫টি তথ্য-প্রমাণে রয়েছে প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ, শারীরিকভাবে যাওয়ার তথ্য-প্রমাণ, ফরেনসিক তথ্য-প্রমাণ, কোলাবেরেশন (সংশ্লিষ্ট সাক্ষী) তথ্য-প্রমাণ এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান।

এই ঘটনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বিশ্লেষণে জানিয়েছেন, যে ৫টি তথ্য-প্রমাণ রয়েছে তাতে করে শতভাগ নিশ্চিত যে রবিউল ইসলামই এই ঘটনার একমাত্র পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী। সংবাদ সম্মেলনে যেসব দাবি করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন বলেও দাবি করেছেন তিনি।

প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ:

ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনায় মূল তথ্য-প্রমাণ হচ্ছে প্রযুক্তিগত। ওই ঘটনার আগে ও পরে প্রযুক্তির মাধ্যমে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে ঘটনায় রবিউল জড়িত। পুলিশ প্রযুক্তির যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তা হলো রবিউল ইসলাম ঘটনার দিন অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৯ মিনিটে শহরের ঈদগাহ আবাসিক এলাকায় ছিল। সকাল ১১টা ১৬ মিনিটে সে জেলা প্রশাসক কার্যালয় (ডিসি অফিস) থেকে বের হয়। সেখান থেকে শহরের ষষ্টিতলা মোড়ে মোহাম্মদ আলীর সেলুনে যায় এবং আড়াইটা পর্যন্ত সেখানে মোবাইলে গেম খেলে। পরে ওই দোকানের পার্শ্বে আইনুল ইসলামের গ্যারেজে তার সাইকেলটি রেখে বিকেল ৩টার দিকে তৃপ্তি পরিবহনের একটি বাসে করে ঘোড়াঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিকেল ৫টার দিকে সে ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জে পৌঁছে এবং সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টা ২৮ মিনিটে ঘোড়াঘাটের ওসমানপুর বাজারে যায়। সেখানে কবিরাজ মশিউরের দোকানের পার্শ্বে একটি মাচায় বসে থাকে এবং সেখানে সিরাজ নামে এক ব্যক্তির মুদি দোকান থেকে ৫টি মিল্ক ক্যান্ডি ক্রয় করে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেখান থেকে হেঁটে রওনা দেয় উপজেলা পরিষদের ভেতরে নির্মাণাধীন একটি মসজিদে। সেখানে রাত ১টা পর্যন্ত অবস্থান করে এবং ওই নির্মাণাধীন মসজিদের ভেতর থেকে একটি লাঠি নিয়ে ইউএনওর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

শারীরিকভাবে যাওয়ার তথ্য-প্রমাণ:

রবিউল ইসলাম ঘটনার দিন বিকেল থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত ঘোড়াঘাটেই অবস্থান করছিল। শারীরিকভাবে তথ্য-প্রমাণে এই বিষয়টি নিশ্চিত হতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। ওই রাতে রবিউলের পরিধেয় প্যান্টে ইউএনও’র শরীরের রক্ত, ইউএনওর বাবার সঙ্গে রবিউলের ধস্তাধস্তির ফলে তার অজান্তেই কিছু তথ্য-প্রমাণ রেখে গেছে রবিউল। এছাড়া ধাক্কা দিয়ে বাথরুমের দরজা খোলারও ফলেও শারীরিকভাবে কিছু তথ্য-প্রমাণ রেখেছে রবিউল। এছাড়া তার চলার ভাবভঙ্গি রেকর্ড হয়েছে সিসি ক্যামেরায়। তার ব্যবহৃত উপকরণসহ মামলায় সংশ্লিষ্ট যাবতীয় উপকরণ প্রেরণ করা হয়েছে পুলিশের সিআইডি ব্রাঞ্চ ডিভিশনে। 

ফরেনসিক তথ্য-প্রমাণ:

রবিউল ইসলাম ওই রাতে যে ঘোড়াঘাটে গিয়েছিলেন এবং ইউএনও’র বাড়িতে ছিলেন ফরেনসিক প্রতিবেদনই তার প্রমাণ দেবে। ওই রাতে তার হাতের ছাপ বিভিন্ন স্থান ও উপকরণ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্যান্টে লেগে থাকা ইউএনও’র রক্ত এবং ইউএনওর বাবার শরীরের লোমসহ কিছু সংস্পর্শ ডিএনএ প্রতিবেদনে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সেসব উপকরণ ঢাকার ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

রবিউলকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। (ফাইল ছবি)

কোলাবেরেশন (সংশ্লিষ্ট সাক্ষী) তথ্য-প্রমাণ:

এই ঘটনাটি রবিউল ঘটিয়েছে দিনাজপুর শহর থেকে তার ঘোড়াঘাটে যাওয়া, ঘোড়াঘাটে উপস্থিতি এবং সেখান থেকে চুরি করে নিয়ে আসা টাকা একজনকে প্রদান এমন প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ৫ জন সাক্ষী রয়েছে। যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। তারা হলেন—দিনাজপুর শহরের ষষ্টিতলা এলাকার মোহাম্মদ আলীর সেলুনের কর্মচারী মুরাদ, গ্যারেজের স্বত্বাধিকারী আইনুল ইসলাম, ঘোড়াঘাট উপজেলার ওসমানপুর বাজারের মুদি দোকানি সিরাজ, কবিরাজ মশিউরের ছেলে ওলিউল এবং চুরি করা টাকা গ্রহণকারী খোকন।

সেলুনের কর্মচারী মুরাদ জানিয়েছেন, সকাল থেকে তার দোকানে বসে থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত রবিউল মোবাইলে গেম খেলেছে। রবিউল প্রায় ওই সেলুনে চুল কাটাতো, এমনিভাবেই মুরাদ রবিউল ইসলামকে চেনেন। ওই দিন রবিউল সেলুনের কর্মচারী মুরাদের কাছে একশ’ টাকা ধারও চেয়েছিল। পরে রবিউল সাইকেলটি তার দোকানে রাখতে চাইলে মুরাদ সাইকেলটিকে আইনুলের সাইকেল স্ট্যান্ডে রাখার পরামর্শ দেয়।

সাইকেল স্ট্যান্ডের স্বত্বাধিকারী আইনুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিশেষ কাজে বাইরে যাবেন এই কথা বলে রবিউল তার গ্যারেজে সাইকেলটি রাখে। পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ২৫ টাকা পরিশোধ করে রবিউল সাইকেলটি নিয়ে যায়।

ওইদিন রবিউল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঘোড়াঘাটের ওসমানপুর বাজারে কবিরাজ ও মুদি দোকানের পাশে একটি মাচায় বসে ছিল।

মুদি দোকানি সিরাজ জানিয়েছেন, সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রবিউল তার দোকানের পাশে মাচায় বসে ছিল। কিন্তু রবিউলের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। রবিউলকে তার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে রবিউল অচেনা এক জায়গার নাম বলে।

বসে থাকার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে বিশেষ কাজে ইউএনও অফিসে যাবে বলে জানায় রবিউল। তার দোকান থেকে রবিউল ৫টি মিল্ক ক্যান্ডি ক্রয় করে। পরে পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ছবি দেখালে রবিউলকে চিনতে পারে এবং রবিউল ওই রাতে তার দোকানের পাশে ছিল বলে পুলিশকে জানায়।

ওই কবিরাজি দোকানের স্বত্বাধিকারী মশিউরের ছেলে ওলিউল জানিয়েছে, সেদিন তার বাবা কবিরাজি করতে অন্য স্থানে যাওয়ায় বাবার দোকানে বসেছিল। ওই সন্ধ্যায় রবিউলকে সে মাচায় বসে থাকতে দেখেছে। এদিকে রবিউল যে ইউএনও’র বাড়ি থেকে ব্যাগের মধ্যে থাকা ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল নিয়েছিল তার মধ্যে ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা মুন্সিপাড়া এলাকার খোকন আলী নামে এক ক্রিকেট জুয়াড়ুকে দেয়। খোকন আলী জানিয়েছেন, রবিউল ক্রিকেটে বাজি ধরে ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা হেরে যায়। ৩ সেপ্টেম্বর মোবাইলের মাধ্যমে রবিউল ইসলাম তাকে রেলওয়ে স্টেশনে আসতে বলে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রবিউল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম গেটের পাশে তাকে নিজ হাতে ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা বুঝিয়ে দেয়।

এই ৫ জন ব্যক্তিই উপরোক্ত কথাগুলো স্বীকার করে সাক্ষী হিসেবে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন।

 

ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার মামলা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি:

গত ২০ সেপ্টেম্বর রবিউল ইসলাম দিনাজপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-৭ এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। জবানবন্দিতে সে বলেছে, ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রবিউল ইসলাম জেলা প্রশাসকের ফরাস পদে চাকরিতে যোগদান করে। গত বছরের ১ ডিসেম্বর তাকে ঘোড়াঘাটে বদলি করা হয়। সেখানে চাকরির দেড় মাসের মাথায় ইউএনওর ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে এবং সেই অপরাধে তাকে ৫ ফেব্রুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ও বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। পরে সে সাংসারিকভাবে আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। বারবার ক্ষমা চেয়েও ক্ষমা না পেয়ে সে পরিকল্পনা করে ইউএনও’র ওপর হামলার এবং পরিকল্পনা মোতাবেক সে ইউএনও’র বাড়িতে গিয়ে তার ও তার বাবার ওপর হামলা করে। ওই দিন ঘোড়াঘাটে যাওয়া, সেখানে হামলা করা ও বাড়িতে ফিরে আসার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে রবিউল ইসলাম।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, রবিউলই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তার কথা বলা, চলার ভাবভঙ্গি, জবানবন্দিতে দেওয়া বিবরণ, আলামত জব্দ, ফরেনসিক তথ্য সংগ্রহ, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, প্রযুক্তিগত তথ্য, ঘটনার স্থানের তথ্য এসবের প্রত্যেকটির সঙ্গে প্রত্যেকটির মিল রয়েছে। তবে একটি গোষ্ঠী এই ঘটনাটিকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সত্য সবসময়ই সত্য, এবং এটি যে শতভাগ সত্য তা আদালতের মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে। ঘটনার প্রত্যেকটি সংশ্লিষ্টতাই প্রমাণ করবে রবিউলই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

উল্লেখ্য, গত ২০ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-৭ এ ইউএনও ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনায় দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে বিরল উপজেলার ধামাহার গ্রামের মৃত খতিব উদ্দিন আহাম্মেদের ছেলে রবিউল ইসলাম। গত ১২ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত আদালতের আদেশে ডিবি পুলিশের হেফাজতে ৯ দিনের রিমান্ডে রাখা হয় তাকে। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ঘোড়াঘাট ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

/টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
এনসিসি ব্যাংক ও একপের মধ্যে চুক্তি সই
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
‘বিএনএমের সদস্য’ সাকিব আ.লীগের এমপি: যা বললেন ওবায়দুল কাদের
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
ভাটারায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে লোহার পাইপ পড়ে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই