স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ ও পুকুর ভরাট করে দিনাজপুর জেলা পরিষদের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সরকারি জমির ৬ শতাংশ দখল করে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ৩৩ শতাংশ পুকুর ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। জেলা শহরের ভেতরে এমন কর্মকাণ্ড চললেও নীরব জেলা প্রশাসন। কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, উপরন্তু জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রধান জানিয়েছেন, স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা ওই ব্যক্তিকে জমিটি লিজ দেওয়া হবে। আর যিনি জমি দখল কাজ করছেন তিনি জানিয়েছেন, স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা পুকুর ভরাটের বিষয়টি মৌখিকভাবে জেলা পরিষদ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, শহরের পৌরসভা এলাকায় ১২নং ওয়ার্ডের মিস্ত্রিপাড়ার এলজিইডি অফিস সংলগ্ন খামার ঝাড়বাড়ী মৌজার জেএল নং-১০৭, ৪৩৮, ৪৯৯, সিএস দাগ নং ৪৯৮/৪৯৯, খতিয়ান নং-১৫৫/১৫৭, যার বিএস দাগ নং-১১০৪ ও খতিয়ান নং-৩, জমির পরিমাণ ৯.৮৮ একর। এরমধ্যে ৬ শতক জমিতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্ল্যাক সার্কেল নাম দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ওই অবকাঠামোর পাশে ৩৩ শতকের একটি পুকুরও ভরাট করছে ওই প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, ৫ মাস আগে ৬ শতক জায়গার ওপর দ্বিতল ভবনের অফিস তৈরি করে জায়গা দখল করা হয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে ব্ল্যাক সার্কেল নামের এক অফিস তৈরি করে ব্যবসা করছেন জাহিদ কামাল সৌদ। এছাড়া ভবনের পেছনে ৩৩ শতকের একটি বিশাল বড় পুকুর মাটি ফেলে ভরাটের কাজ করছেন।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ১৪২৫ বাংলা সনে জাহিদ কামাল সৌদকে ওই ৬ শতক জমিটি লিজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরের বছর ১৪২৬ সনে লিজ আর নবায়ন করা হয়নি। চলতি ১৪২৭ সনে তাকে লিজ প্রদান করেনি জেলা পরিষদ। অথচ আগে থেকে দখল করা ওই জমিটিতে তিনি আধুনিক মডেলের দ্বিতল ভবনের অফিস তৈরি করে জায়গাটি দখল করেছেন। এছাড়া ওই ভবনটির পেছনে সরকারি পুকুরটিও মাটি ফেলে ভরাট করছেন তিনি।
বিষয়টি জেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও সদস্যরা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলেও কোনও ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, দখলকারী ব্যক্তিকে নিষেধ পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ জেলা পরিষদের কর্মকর্তা হিসাবে এসব দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তার।
জেলা পরিষদের সম্পত্তি (অর্জন, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও হস্তান্তর) বিধিমালা ২০১৭-এর ৭নং বিধি (পরিষদের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) অনুযায়ী, রাজস্ব আয়ের উৎস সৃষ্টিকল্পে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন জমি অনূর্ধ্ব এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া যাবে। ইজারা দেওয়ার আগে একটি জাতীয় দৈনিকে এবং একটি জেলার দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। ইজারা প্রদানকৃত সম্পত্তিতে কোনও প্রকার পাকা বা স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করা যাবে না এবং চুক্তিপত্রে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। ইজারার মেয়াদান্তে নবায়নের ক্ষেত্রে নতুনভাবে চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে হবে। এছাড়া ইজারা বা ভাড়া প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে পরিষদ কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট জমি সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরিষদে প্রতিবেদন দাখিল করবেন এবং ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অথচ এসব বিধিমালা অনুযায়ী ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়নি এবং কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু ওই ৬ শতক জমিটি পুনরায় ওই ব্যক্তিকে লিজ দেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ অবৈধভাবে জমি দখলের পুরো বিষয়টিই জানেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রশিদুল মান্নাফ কবীর। দখলকারী জাহিদ কামাল সৌদ জানিয়েছেন, পরিষদকে জানিয়েই তিনি এসব কার্যক্রম করছেন।
এ বিষয়ে জাহিদ কামাল বলেন, ‘১৪২৫ সনে একসনা ওই জমিটি সরকারের কাছ থেকে আমার লিজ নেওয়া আছে। পরের বছর আমাকে লিজ দেওয়া হয়নি। তবে পরবর্তীতে আমাকে লিজ দেওয়া হবে এটি জেলা পরিষদ থেকে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। তাই সেখানে আমি বিল্ডিং করেছি।’ তবে বিল্ডিং নির্মাণের নিয়ম নেই বলে স্বীকার করেছেন তিনি। একইসঙ্গে সেটি আবাসিক হিসেবে লিজ নেওয়া হয়েছিল এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জায়গাটি দখলে রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে এটিও স্বীকার করেছেন। পুকুর ভরাট তিনি নিজে করছেন এটিও স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘সবকিছুর জন্য জেলা পরিষদ থেকে মৌখিকভাবে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে জমিটি আমাকে লিজ দেওয়া করা হবে।’
এসব ব্যাপারে জানতে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রশিদুল মান্নাফ কবীরের কার্যালয়ে যাওয়া হলে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি রূঢ় আচরণ করেন। তিনি বলেন, তার কার্যালয়ে ২ জনের বেশি প্রবেশ নিষেধ এবং সাংবাদিকরা কী কথা বলতে এসেছেন তিনি তা জানেন।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘যে জমিটির ব্যাপারে সাংবাদিকরা এসেছেন ওই জমিটি স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণকারী সৌদকে লিজ দেওয়া হবে। আবাসিক হিসেবে জমিটি লিজ দেওয়া হয়েছিল বাংলা ১৪২৫ সনে। পরের বছর আর লিজ নবায়ন করা হয়নি। তাই এবারে তাকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে বলে শুনেছি, সেটির ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
দিনাজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুল ইমাম চৌধুরী বলেন, একসনা মেয়াদে সরকারি জমি লিজ প্রদান করা হলে সেখানে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। সর্বোচ্চ আধাপাকা বাড়ি নির্মাণ করা যেতে পারে। আবার ওই জমিটি আবাসিক হিসেবে লিজ প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে এটিও একটি অনিয়ম। নিয়ম অনুযায়ী কোনও সরকারি জলাধার ভরাট করা যাবে না। আবার সেটি লিজও প্রদান করা হয়নি। এসব অবৈধ ও অনিয়ম কার্যক্রমের জন্য তার যে লিজ তা স্থগিত করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।