X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান!

ইব্রাহীম রনি, চাঁদপুর
০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:০০আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:০৬




বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান! পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার সঙ্গমস্থলের চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন ‘মোলহেড’ এলাকা একটি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কয়েক হাজার মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও শহীদদের রক্তমাখা এ স্থানটির ভাবগাম্ভীর্জতা ও পবিত্রতা রক্ষায় তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর ইতিহাসও জানে না নতুন প্রজন্মের অনেকেই। উপরন্তু মোলহেড এলাকায় বিভিন্ন সময় হয়েছে মেলা, উৎসব, নাচ-গান। ইতিহাস জানান দেওয়ার ব্যবস্থা না করায় এ স্থানটিকে জেলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আশা পর্যটকরা জানেন একটি নৈসর্গিক বিনোদনকেন্দ্র তথা পর্যটন স্পট হিসেবে। তরুণ-তরুণীদের কাছে এটি ডেটিং স্পট! এ স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘রক্তধারা’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করলেও বেশিরভাগ মানুষই এটিকে পর্যটন স্পটের একটি অংশ মনে করেন।

বুধবার (২ ডিসেম্বর) বধ্যভূমি বড়স্টেশন মোলহেড এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাগলের পাল। রক্তধারার পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিপুল সংখ্যক দোকান-পাট। রক্তধারার সাইনবোর্ডে লাগানো হয়েছে জুতার পোস্টার। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিন নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন মানুষজন। আছে ভিক্ষুকের যন্ত্রণা।

বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান! মোলহেডে ঘুরতে আসা চাঁদপুর শহরের রফিক, সোহান, আমিনুর রহমান বলেন, আমরা স্থানীয় হলেও জানতাম না এটি একটি বধ্যভূমি। আমরা ছোটবেলা থেকেই এটিকে একটি বিনোদনের জায়গা হিসেবেই জেনে এসেছি। যখনই ভালো লাগে না, একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য এখানে ঘুরতে আসি।

চট্টগ্রাম থেকে আসা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেছি- চাঁদপুরে ঘোরার মতো প্রধান জায়গা এটি। সে হিসেবে এখানে বন্ধুরা সবাই ঘুরতে এসেছি। আমরা কেউই জানি না- এটি একটি বধ্যভূমি। এটি যদি বধ্যভূমি হয়েই থাকে তাহলে এর ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত জেলা ব্র্যান্ডিং বইটিতেও এই বধ্যভূমিকে নৈসর্গিক বিনোদনের স্থান হিসেবে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- চাঁদপুর বড় স্টেশনের পশ্চিম পাশে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ত্রিকোণাকার অংশটিই মোলহেড নামে পরিচিত। এ স্থান হতে পশ্চিম দিগন্তে খুব স্পষ্টভাবে সূর্যাস্ত দেখা যায়। ইংরেজি শব্দ মোলহেড মানে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ অভিঘাত হতে স্থল ভূমিকে রক্ষার জন্য পাথর বা কংক্রিট দ্বারা নির্মিত শক্ত প্রাচীর বা বাঁধ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলিত প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণি হতে চাঁদপুর শহরকে রক্ষার জন্য বোল্ডার দ্বারা এটি নির্মিত হয়।

বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান! জেলা ব্র্যান্ডিং কমিটির ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ বই থেকে জানা যায়, এখানে স্থাপিত রক্তধারার পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় পুরানবাজার এবং বড় স্টেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কয়েকটি নির্যাতন কেন্দ্র (টর্চার সেল) স্থাপন করে। নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার ও রেলগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে যারা চাঁদপুরে পৌঁছাতো, সন্দেহ হলে তাদেরকে এবং জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোক ও নারীদের এই টর্চার সেলে এনে নির্যাতন করে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত, অর্ধমৃত অথবা হত্যা করে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর খরস্রোতে ফেলে দেওয়া হতো। হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা এ হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করতো। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার শহীদদের স্মরণে ২০১১ সালে মোলহেডের সন্নিকটে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’। এ স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চাঁদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন কানাই চক্রবর্তী বলেন, বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের অনেকেই হাত-পা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান! তিনি আরও বলেন, আগে এখানে অনেক নাচ-গান হতো, তা বন্ধ করা হয়েছে। কুৎসিত মেলা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকলে হয়তো কিছু করা যেতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধা জীবন কানাই বলেন, মানুষ ঘুরবে, নদীর দৃশ্য দেখবে, রক্তধারাটাও দেখবে। এ থেকে যার যেমন অনুভূতি হয়। সব মানুষতো আর এক রকম না। সবাইকেতো আর পাহারা দেওয়া সম্ভব না। এখানে প্রবেশের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকবে। স্থানটিতে যাচ্ছে-তাই যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। যা করা হবে তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই করতে হবে। তিনি বলেন, এখানকার ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ রক্ষায় আমরা বসবো, কাজ করবো।

বধ্যভূমি ‘মোলহেড’ এখন বিনোদনের স্থান! চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, বড়স্টেশন মোলহেড বধ্যভূমির প্রতীক হিসেবে রক্তধারা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখানে অশ্লীলতা যদি কিছু হয়, সেটি আমরা দেখবো। কিন্তু সুস্থ বিনোদন তথা মানুষ যাবে ঘুরবে সেটিতো সাংঘর্ষিক না।

তিনি বলেন, গান-বাজনা, নাচ-গানতো শহীদ মিনারেও হয়। এখন যদি জায়গাটি বন্ধ করে দেই তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? তারপরও স্মৃতিফলক করা যেতে পারে। কারা কারা মারা গিয়েছিল, কি হয়েছিল- এখানে আগতরা এসব বিষয়ে পড়ে জানতে পারবেন। সমস্যা হচ্ছে- আমরা করতে চাইলে সেটি একটু কঠিন। এ জায়গাটি হচ্ছে রেলওয়ের। এর ব্যবস্থাপনায় পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন। এ তিনটি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে কোনও উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তিনি।

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সুন্দরবনে আগুন: ১১ নাগরিকের উদ্বেগ
সুন্দরবনে আগুন: ১১ নাগরিকের উদ্বেগ
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বর্তমান চেয়ারম্যানকে হারিয়ে হাকিমপুর উপজেলায় রাজের জয়
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বর্তমান চেয়ারম্যানকে হারিয়ে হাকিমপুর উপজেলায় রাজের জয়
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু: ওসি-চিকিৎসকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু: ওসি-চিকিৎসকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা
ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা
ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ