X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় নীলফামারীর অধিকাংশ বধ্যভূমি

নীলফামারী প্রতিনিধি
১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:০০আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:০০




অবহেলায় নীলফামারীর অধিকাংশ বধ্যভূমি স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ বাঙালি শহীদদের (গণকবর) অধিকাংশ বধ্যভূমি রয়েছে অযত্ন ও অবহেলায়। নীলফামারীর ২৫টিরও অধিক গণকবরেরও একই অবস্থা।

নীলফামারীর সরকারি কলেজ চত্ত্বরে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিকে হত্যার পর সেখানের পুরনো একটি কুয়ায় ফেলে দেয় পাকিস্তানিদের দোসর আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি এই গণকবরটি চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালে ওই কলেজের গণকবরের জায়গাটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) বাস্তবায়নে বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হলেও তা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। এতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে দুই দফায় ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথম দফায় ১৩ লাখ ও দ্বিতীয় দফায় ৩৪ লাখ।

কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া ও এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বধ্যভূমিটি কেন হস্তান্তর করা হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, শহীদদের নামের তালিকা নিয়ে জটিলতা থাকায় তা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে আগামী মার্চ মাসে স্থানীয় দলীয় নেতা ও প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে শহীদদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করে বধ্যভূমিটি হস্তান্তর করা হবে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা নীলফামারী জেলা শহর দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপন লড়াইয়ে ১৩ ডিসেম্বর শহরটি হানাদার মুক্ত হয়। ওই সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার দুর্বার প্রতিরোধের ফলে মুক্ত করেন জেলার ডিমলা, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুরসহ সদরের বিভিন্ন এলাকা।

অবহেলায় নীলফামারীর অধিকাংশ বধ্যভূমি জেলার ডিমলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সামসুল হক জানান, উপজেলাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় সেখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অসংখ্য গণকবর রয়েছে। এরমধ্যে দুই-একটি চিহ্নিত হলেও বাকিগুলো এখনও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল জেলার জলঢাকার গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ এলাকায় রাজাকার আলবদর ও তাদের দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা প্রায় ৩৫০ নিরপরাধ বাঙালিকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিরাপদ আশ্রয়ের (ভারতে) সন্ধানে সরে যেতে থাকা মানুষদেরও প্রাণে বাঁচতে দেয়নি তারা। হানাদার বাহিনীর নির্দেশে হত্যার পর সেখানেই তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ওই ঘটনায় উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বালাগ্রামের বাসিন্দা অশ্বিনী কুমার অধিকারীসহ পরিবারের ১৩ জন শহীদ হয়েছেন। ওই ঘটনায় আজও বেঁচে আছে অশ্বিনী কুমারের বড় ছেলে অমর কৃষ্ণ অধিকারী। তিনি বলেন, ওই দিন আমার বাবা, মাসহ (১৩ জন) ভারতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। পথে কালীগঞ্জ গ্রামে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। সবাই মিলে প্রায় তিন শতাধিক লোক হবে। সে সময় দশম শ্রেণি পড়ুয়া অমর কৃষ্ণ অধিকারী (৬৪) ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

অমর কৃষ্ণ তিনি বলেন, ওইদিন বিকালের দিকে কালীগঞ্জে হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনাদের তিন থেকে চারটি গাড়ি আসে। সেনা সদস্যরা সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আমার ডান হাতে ঘাড়ের ওপর একটি গুলি বিদ্ধ হয়। আর একটি পিঠের ওপর দিয়ে চলে যায়। তবে ভগবানের কৃপায় আমি ওই ঘটনার পরেও বেঁচে যাই।

স্থানটি কালের সাক্ষী হিসেবে কালীগঞ্জ বধ্যভূমি নামে পরিচিতি লাভ করে। কালীগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে শহীদদের স্মরণে সেখানে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ এবং একটি শহীদ মিনার।

জলঢাকা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদুর রহমান বলেন, দিনটির কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা ভোলার নয়। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিকল্প নেই।

জেলার সৈয়দপুর উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একরামুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব বেগ শহীদ হওয়ার পর আমরা সবাই আটকা পড়ছিলাম শহরে। ঘোষণা হলো এয়ারপোর্ট তৈরি করা হবে। সেখানে কাজে নেওয়া হলো। সারাদিন ইটের সোলিং করার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এলে আবার রাতে আমাদের বন্দি করে নিয়ে যায় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। আমাদের সহায় সম্পদ সব লুট করে নিয়ে যায় আলবদর ও রাজাকাররা।

সেই ঘটনার কালের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন সৈয়দপুর পৌরসভার নয়া বাজার মহল্লার তপন কুমার দাস ওরফে কাল্টু (৬৫)। তিনি জানান, সাত দিন পর আমাদের রেলস্টেশনে এনে চারটি বগিতে তোলা হয়। একটু এগিয়ে উপজেলার গোলাহাট নামক স্থানে নামিয়ে গুলি করে চার শতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। ঘটনার বর্ণনায় তপন বলেন, সেদিন ছিল ঝিরঝির বৃষ্টি। আমি ভাগ্যক্রমে বৃষ্টির কারণে ট্রেনের বগির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে বেঁচে যাই। নয়তো সেদিন নিশ্চিত আমার মৃত্য হতো।

তপন কুমার তিনি বলেন, ৭১ সালের ১৩ জুন এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এসব শহীদদের স্মরণ করতে আজও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি সেখানে। ৪৯ বছরেও তৈরি হয়নি কোনও স্মৃতিসৌধ। লেখা হয়নি তাদের নাম।

এছাড়াও, একাত্তর সালের ১৫ ও ১৬ এপ্রিল শতাধিক নিরীহ শ্রমিক-কর্মচারীকে হত্যা করা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ভেতরে ও বাইরে। আজও এই বধ্যভূমিটিও অবহেলায় পড়ে আছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দায়সারাভাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে।

তপন কুমার দাস জানান, বধ্যভূমির স্মৃতি ও শহীদদের তালিকা ৪৯ বছরেও সংরক্ষিত হয়নি যথাযথভাবে। তিনি বধ্যভূমিগুলোর সংস্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান।

অবহেলায় নীলফামারীর অধিকাংশ বধ্যভূমি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক জানান, ৭১ সালে জেলার প্রায় দুই হাজার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই সময় ৯ মাসের যুদ্ধে শহীদ হন ৭১ জন মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া সম্ভ্রম হারা অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। জেলায় গণকবরের (বধ্যভূমি) সংখ্যা ২৫টির বেশি। বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে অল্প কিছু বধ্যভূমি সংস্কার করা হলেও অধিকাংশই অযত্ন ও অবহেলায় রয়েছে। দ্রুত এসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির দাবি জানান তিনি। এছাড়াও জেলার ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় অসংখ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর আছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রশাসক (সার্বিক) আজাহারুল ইসলাম জানান, জেলায় বিদ্যমান বধ্যভূমিগুলোতে পর্যায়ক্রমে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। নীলফামারী সরকারি কলেজের সংরক্ষিত বধ্যভূমিটি হস্তান্তরের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি কলেজ কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘ধর্ষণে’ অসুস্থ স্কুলছাত্রীকে স্বামী পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে যুবকের পলায়ন
‘ধর্ষণে’ অসুস্থ স্কুলছাত্রীকে স্বামী পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে যুবকের পলায়ন
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে