X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় গুলিতে ৪ জন নিহতের নেপথ্যে

মো. নাজমুল হুদা নাসিম, বগুড়া
০৬ জানুয়ারি ২০২২, ২৩:০৯আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ২৩:০৯

বগুড়ার গাবতলীর বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর গুলিতে চার জন নিহতের নেপথ্যে রয়েছে—ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণা না করা। ‌‘উপজেলা সদরে গিয়ে ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণা করা হবে’ কেন্দ্রে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের এমন সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় এলাকাবাসী, রাজনৈতিক নেতা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বুধবার সন্ধ্যায় কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গুলিতে চার জন নিহত হন। নিহতরা হলেন- কালাইহাটা গ্রামের খোকন মন্ডলের স্ত্রী নারী ইউপি সদস্য প্রার্থীর এজেন্ট কুলসুম আকতার (৩৫), একই গ্রামের শাকসবজি বিক্রেতা আবদুর রশিদ (৬০), রিকশাচালক আলমগীর হোসেন (৩৫) ও কৃষক খোরশেদ আকন্দ (৭০)।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতাকে বিজয়ী করতে শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহমেদের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে চার নিরীহ ব্যক্তির প্রাণ গেছে। ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের আত্মীয়। তাকে জেতাতে কৌশল করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার জন্য আসিফ আহমেদ দায়ী। 

এদিকে, বৃহস্পতিবার (০৬ জানুয়ারি) দুপুরে আসিফ আহমেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন গ্রামবাসী। 

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ বলেন, নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থী তার বিজয় নিশ্চিত করতে লোকজন নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যান। আমরা কেউ ব্যালট বাক্স উপজেলা সদরে নিতে চাইনি। বরং চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুস আলী ভোট গণনায় বাধা দিয়েছেন। আর তার হঠকারিতার কারণে চার জন নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে। এই ঘটনার জন্য ইউনুস আলী দায়ী। আর স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী শাকিউল ইসলাম তিতু মন্ডল আমার আত্মীয় নন। এটিও মিথ্যা কথা।

নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুস আলী ফকির বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ সকাল থেকে কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবস্থান নেন। তিনি ব্যাপক কঠোরতা দেখান এবং প্রার্থীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেন। এ ছাড়া ভোটারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, আসিফ আহমেদের এমন আচরণের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা শাকিউল ইসলাম তিতু মন্ডলের আত্মীয় আসিফ। তাই আত্মীয়কে বিজয়ী করতে তিনি ব্যালট বাক্স উপজেলা সদরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার নির্দেশে গুলিতে চার জনের প্রাণ গেছে। গুলিবিদ্ধ ও মারপিটে আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন।

গুলিতে নিহত গৃহবধূ কুলসুম আকতার, আবদুর রশিদ, আলমগীর হোসেন ও খোরশেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা আহাজারি করছেন। দরিদ্র এসব পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা তারা।

ঘটনাস্থল কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, দরজা-জানালা ও আসবাবপত্র তছনছ হয়ে আছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউসুফ আলী বলেন, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করার মতো কোনও পরিবেশ নেই। হামলা ও ভাঙচুরে অন্তত লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে রাস্তা ও জমিতে রক্ত শুকিয়ে আছে। বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান, গ্রামবাসী শহীদুল ইসলাম, নৌকার প্রার্থীর এজেন্ট আল আমিন, নিহত কুলসুমের স্বামী খোকন মন্ডল জানান, গতবারের নির্বাচনে কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ব্যালট উপজেলা সদরে নিয়ে গণনা করায় বিজয়ী হওয়ার পরও ইউনুস আলী ফকিরকে ৮২ ভোটে পরাজিত দেখানো হয়। বুধবার দিনভর উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় ভোট গণনা শুরু হয়। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহমেদ ব্যালট বাক্স উপজেলা সদরে নিয়ে গণনার ঘোষণা দেন। বাক্সগুলো গাড়িতে তুলতে শুরু করলে গ্রামবাসীদের পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে। ফলাফল পরিবর্তন করে এবারও ইউনুস ফকিরকে পরাজিত করা হবে এমন আশঙ্কায় শতাধিক নারী-পুরুষ নির্বাচনি সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার গাড়ির সামনে দাঁড়ান। অনেকে রাস্তায় অবস্থান নেন।

এ সময় প্রশাসনের লোকজন নারী-পুরুষদের বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করেন। তখন গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে মারমুখী হয়ে ওঠেন। ম্যাজিস্ট্রেট পরিস্থিতি সামাল দিতে এখানে ভোট গণনার আশ্বাস দিলেও গ্রামাবাসী বিশ্বাস করতে পারেননি। তারা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতি হলে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা ২৫ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন। এতে চার জন নিহত হন।

তাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা হাতে কেন্দ্র ঘেরাও এবং সড়কে কাঠের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেন। পরে অতিরিক্ত ফোর্স ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। এরপর কেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। 

আরও পড়ুন: বগুড়ায় ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর’ গুলিতে নিহত ৪

এখানে তিন হাজার ২২ ভোটের মধ্যে দুই হাজার ৩৭০ ভোট কাস্টিং হয়। নৌকা প্রার্থী ইউনুস আলী ফকির এক হাজার ৮৯১, স্বতন্ত্র প্রার্থী শাকিউল ইসলাম তিতু মন্ডল (চশমা) ২৪৬ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (ঘোড়া) বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ১১৫ ভোট পান। সার্বিক ফলাফলে বালিয়াদীঘি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হন। 

হতাহতের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহমেদকে দায়ী করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন গ্রামবাসী। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার গাবতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, আমরা তো ব্যালট বাক্স উপজেলা সদরে নিয়ে যেতে চাইনি। নৌকার প্রার্থী ও তার লোকজন ভোট গণনা করতে বাধা দিয়েছেন। এ জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক বলেন, ওই ঘটনায় প্রিসাইডিং অফিসার বাদী হয়ে মামলা করবেন। এ ছাড়া গুলিবর্ষণ ও পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কুলসুম আকতারের স্বামী খোকন মন্ডল বলেন, আমার স্ত্রীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এ ঘটনায় প্রশাসনের লোকজন জড়িত। আমি তাদের বিচার চাই।

নিহত রিকশাচালক আলমগীর হোসেনের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণির মেয়ে আদুরী খাতুনকে নিয়ে বগুড়া শহরের কৈপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকি আমরা। ভোট দেওয়ার জন্য গ্রামে এসেছিলাম। স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র মেয়ে ও ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত আমি। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই।

নিহত আবদুর রশিদের স্ত্রী বুলবুলি খাতুন বলেন, আমার স্বামী ভোট দেওয়ার পর ফলাফল জানতে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে দুই ছেলে নিয়ে আমি চিন্তিত। আমাদের কে দেখবে?

খোরশেদ আকন্দের স্বজনরা জানান, আমরা বাকরুদ্ধ। ভোট দিয়ে কেন্দ্রের পাশে শাক বিক্রি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। 

গুলিবিদ্ধ কালাইহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী হাসান জানায়, আমি কেন্দ্রের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। লোকজনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম। ওঠে দাঁড়াতেই আমার শরীরে গুলি লাগে।

/এএম/
সম্পর্কিত
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
সর্বশেষ খবর
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি