পঞ্চগড় জেলাবাসীর নিরাপত্তা ও সেবার মান বাড়াতে জেলা পুলিশ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গোটা জেলাকে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) আওতায় আনা হচ্ছে। জেলা শহরসহ পাঁচটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইতোমধ্যে সাড়ে ৪শ’ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে গোটা জেলায় ছয় শতাধিক সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হবে। এর ফলে গোটা জেলা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে যাবে, জনদুর্ভোগ লাঘব হবে। উপকৃত হবে প্রশাসনও।
ইতোমধ্যে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সুফল পেয়েছেন স্থানীয়রা ও পুলিশ প্রশাসন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চোর ধরা, মোটরসাইকেল, ভ্যানসহ খোঁয়া যাওয়া ব্যাগ ও মালামাল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
চুরি, ছিনতাই, মারামারি, মাদক সেবন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিংসহ অন্য অপকর্ম করে অপরাধীরা যেন পালাতে না পারে, সন্দেহভাজনদের তল্লাশি, যানজট নিরসন, বখাটেদের উপদ্রব, মিছিল, সভা-সমাবেশে আইনশৃংঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ঘটনার রহস্য উদঘাটন সহজতর করার লক্ষ্যে জেলা পুলিশ সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।
জেলা পুলিশের মিডিয়া সেল সূত্রে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর উদ্যোগে জেলা পুলিশ গত অক্টোবর মাসে জেলার ব্যস্ততম, গুরুত্বপূর্ণ ও অপরাধপ্রবণ এলাকাসমূহ চিহ্নিত করে ৬ শতাধিক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে গোটা জেলায় ৪৫৭টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে পঞ্চগড় সদর উপজেলায় ১৭৯টি, বোদায় ৭৬টি, দেবীগঞ্জে ৯৭টি, আটোয়ারীতে ১৪টি ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় ৯০টি। গত ২৪ অক্টোবর পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজলদিঘী ইউনিয়নের টুনিরহাট বাজারে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী সিসি ক্যামেরা স্থাপন কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
পঞ্চগড় জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. জোবায়ের আরিফীন জানান, পঞ্চগড় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থিত ক্রাইম কন্ট্রোল মডেল (সিসিএম) কার্যালয় থেকে পুলিশের চার জন সদস্য জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপনকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার ও পাঁচ থানার ওসিবৃন্দ জেলার সকল পেট্রোল পাম্প মালিকদের সিসি ক্যামেরা স্থাপনে উদ্ধুদ্ধ করেন। এর ফলে জেলার সকল পেট্রোল পাম্পে সিসি ক্যামেরা স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের প্রয়োজনে এসব সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংরক্ষণ করা হয়।
তিনি আরও জানান, সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সুফল হিসেবে গত ২৯ অক্টোবর তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর বাজার থেকে চুরি হওয়া একটি মোটরসাইকেল উদ্ধারসহ একজনকে গ্রেফতার করা গেছে।
কিছুদিন আগে রিকশায় করে সপরিবারে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় একজন একটি ব্যাগ হারিয়ে ফেলে। সিসি ক্যামেরার দায়িত্বে নিয়োজিত পঞ্চগড় জেলা পুলিশের বিশেষ টিম ভিডিও ফুটেজ দেখে রিকশাওয়ালাকে শনাক্ত করে ব্যাগটি উদ্ধার করে ফেরত দেয়। সম্প্রতি পঞ্চগড় থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ভ্যান সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ প্রশাসনের সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগকে সময় উপযোগী এবং এর ফলে জেলাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা।
পঞ্চগড় শহরের ব্যবসায়ী নুর আলম জানান, পূর্বে শহরসহ হাটবাজারে প্রায়শই চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটতো। সিসি ক্যামেরা বসানোয় আমরা ব্যবসায়ীরা অনেক সুবিধা পাবো।
পঞ্চগড় পেট্রোল পাম্পের সত্ত্বাধিকারী আবুল কাশেম রুমেল জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কপোরেশন (বিপিসি) ও পঞ্চগড় পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় আমরা পাম্প এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছি। বর্তমানে জেলার সকল পেট্রোল পাম্পই সিসি ক্যামেরার আওতাধীন।
বোদা থানার ওসি আবু সাঈদ চৌধুরী জানান, সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ফলে পুলিশের তদন্ত কাজে যেমন সহায়তা পাচ্ছি, অন্যদিকে এলাকাবাসীও এর সুফল পাচ্ছেন। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম জেলা পুলিশের সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।
পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহমুদুল হক জানান, আমার প্রতিষ্ঠানেও সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সড়ক মহাসড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই ক্যামেরা স্থাপনের ফলে কম বেশি সকলেই সুবিধা পাবে। তবে সিসি ক্যামেরা নিয়মিত মনিটরিং করলে ভালো হয়।
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মজিবর রহমান সিসি ক্যামেরা স্থাপনের গুরুত্ব আছে জানিয়ে বলেন, এর ফলে ইভটিজিংসহ বখাটেদের দৌরাত্ম কমবে। ঘটনা ঘটলে তথ্য প্রমাণও পাওয়া যাবে।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী জানান, ১৪০৪.৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সেবা বাড়ানোর লক্ষ্যে জেলা পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত পুলিশি সেবা চালু করা হয়েছে। জেলা পুলিশের নানামুখী পদক্ষেপে জনগণ তাদের কাঙ্খিত সেবা ও ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন। সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন নিরাপত্তাবোধ কাজ করে তেমনি অপরাধীরা অপরাধকর্ম থেকে বিরত থাকে। এছাড়া অপরাধ করলেও অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হয়। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে। জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে স্থাপনকৃত সিসি ক্যামেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, জনগণের বন্ধু হিসেবে পুলিশি সেবা পৌঁছে দিতে পঞ্চগড় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। জেলার যে কোনও থানায় মামলা দায়ের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রিয়ভাবে বাদীর মোবাইল ফোনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল ফোন নম্বরসহ ম্যাসেজ পাঠানো হচ্ছে। মানুষ যাতে সহজেই সেবা পেতে পারেন এ জন্য ক্রাইম কন্ট্রোল মডেল (সিসিএম) বাদীর মোবাইলে যোগাযোগ করছে। মামলার তদন্তসহ অন্য কোনও কাজে পুলিশকে ঘুষ বা টাকা না দিতে সিসিএম থেকে ফোন করে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে করেনায় দরিদ্র পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ,বাজার মনিটরিং, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, জেলার প্রবেশদ্বারে নজরদারিসহ করোনা মোকাবিলায় নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।