X
শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
৫ আষাঢ় ১৪৩২

হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ১০ মাস পর হত্যা মামলা, বেরোবির শিক্ষক কারাগারে

রংপুর প্রতিনিধি 
২০ জুন ২০২৫, ০০:০৪আপডেট : ২০ জুন ২০২৫, ০০:০৪

রংপুরে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া ছমেছ উদ্দিনের মৃত্যুর ১০ মাস পর দায়ের করা হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 

বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) মেট্রোপলিটন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে নগরীর ধাপ এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে মেট্রোপলিটন চিফ জুডিশিয়াল আদালতের পরিদর্শক শাহিনুর আলম বলেন, বিকালে রংপুর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (হাজিরহাট) মাহমুদুল হককে তোলা হয়। বিচারক সোয়েবুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

হাজিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন শাহ বলেন, ছমেছ উদ্দিন হত্যা মামলায় বেরোবি শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

তবে এই মামলা দায়ের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। কারণ, মামলায় শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তারা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মামলার ৫৪ নম্বর আসামি অধ্যাপক মাহমুদুল হক। ২০২৪ সালের ২ আগস্ট নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর এলাকায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া মুদি দোকানি ছমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম স্বামী হত্যায় হাজিরহাট থানায় ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া আসামি হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বাকি ৫২ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ।

এ নিয়ে মাহমুদুল হকের স্ত্রী মাসুবা হাসান মুন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার স্বামী মাহমুদুল হক সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। আজ বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে আমার রংপুরের ধাপ এলাকায় অবস্থিত নিজ বাসা থেকে রংপুর মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানা পুলিশ আমার স্বামীকে আটক করে সরাসরি আদালতে নিয়ে যায়। কোনও এক হত্যা মামলার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার স্বামী এরকম কোনও অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন‌ না। তিনি পুরোপুরিভাবে নির্দোষ। এটি একটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো মিথ্যা মামলা। আমি আমার স্বামীর স্নেহভাজন শিক্ষার্থী, সম্মানিত সহকর্মী, সাংবাদিকতা পেশার সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা কামনা করছি।’

এ ঘটনা জানাজানি হয়ে রংপুরজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। নিহত ছমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম ও তার ছেলে আশিকুর রহমান স্বীকার করেছেন যে, তাদের বাবা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তারা মামলা করেছেন পুলিশের কথামতো। মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে, তা তারা জানেন না। কেবলমাত্র কাগজে সই দিয়েছেন তারা। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২ আগস্ট মুদি দোকানদার ছমেছ উদ্দিন দোকানে বসে থাকা অবস্থায় জামায়াত নেতা হাজি নাছির উদ্দিনকে পুলিশ আটক করতে ওই এলাকায় এলে ছমেছ উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে দৌড় দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তায় শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারান। স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে বাড়ির কাছে বেসরকারি প্রাইম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

তবে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন পুলিশ, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার মুদি দোকানি ছমেছ উদ্দিনকে (৬৫) তার দোকানে এসে হুমকি দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেন। এতে তিনি অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ ও আসামিরা তাকে রেখে পালিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা ছমেছ উদ্দিনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম বাদী হয়ে হাজিরহাট থানায় গত ৩ জুন একটি মামলা করেন। এতে শিক্ষক মাহমুদুল হককে ৫৪ নম্বর আসামি করা হয়।

তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, তার মরদেহের কোনও ময়নাতদন্ত হয়নি। হত্যা মামলার পরও লাশ তুলে ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। অথচ শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

থানা সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি দায়ের করার পর হাজিরহাট থানার ওসি আব্দু্ল্লাহ আল মামুন শাহ মামলাটি নিজেই রেকর্ড করে তিনি নিজেই তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেন। 

নিহত মুদি দোকানদার ছমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম জানান, তার স্বামীকে ধরতে ২ আগস্ট পুলিশ এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে একপর্যায়ে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারান। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তাহলে কেন হত্যা মামলা করলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে জানান, পুলিশ প্রশাসন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কাগজে সই করতে বলেছে। তিনি তাই করেছেন। কাদের নামে হত্যা মামলা হয়েছে সেটা তিনি জানেন না।

ছমেছ উদ্দনের ছেলে আশিকুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি রংপুরের বাইরে ছিলাম। আমার বাবাকে পুলিশ ধরতে এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসক বলেছেন আমার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।’

ছমেছ উদ্দিনের জানাজায় ইমামতি করা স্থানীয় মসজিদের ইমাম মমিনুল ইসলাম জানান, তিনি জানাজা পড়িয়েছেন। নিহতের শরীরে কোনও জখম দেখেননি। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার কথা শুনেছেন। হত্যার কথা শোনেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজি নাছির উদ্দিনকে ২ আগস্ট তারিখে কয়েকজন পুলিশ গ্রেফতার করার জন্য তার বাসা ঘেরাও করে। সে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। ওই সময় মুদি দোকানদার ছমেছ উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। স্বয়ং স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজি নাছির উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মুদি দোকানদার ছমেছ উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে আসে নাই। পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেফতার করতে। এই মামলায় বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছমেছ উদ্দিন হত্যা মামলা দায়ের হওয়ার পর স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিদের স্বজনরা বলেন, ছমেছ উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এটাই শত ভাগ সত্য। অথচ এই ঘটনাকে লুকিয়ে করে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করে তাদের স্বজনসহ এলাকার নিরীহ মানুষকে আসামি করা সম্পূর্ণ অন্যায়।

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, ‘ছমেছ উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ ঘটনায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নালসহ স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করা সত্যিই দুঃজনক। ছমেছ উদ্দিনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কই? ১০ মাস পর মামলা করা হলো। এখনও লাশ উত্তোলনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? পুরো ঘটনা তদন্ত করা উচিত। তখন আসল ঘটনা বের হবে।’

২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি হাজিরহাট থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করি, হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে কীভাবে হত্যা করার গল্প সাজানো হয়। পুলিশ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। নিরীহ লোকদের আসামি করে মামলা বাণিজ্য করা হচ্ছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দু্ল্লাহ আল মামুন এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নাই, তাহলে কীভাবে হত্যা মামলা রেকর্ড করলেন? মামলায় আসামিদের গ্রেফতারের নামে হয়রানির অভিযোগ করা হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ওপর মহলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

/এএম/
সম্পর্কিত
বগুড়ায় ৫২ লাখ টাকা মূল্যের জাল ব্যান্ডরোল উদ্ধার, গ্রেফতার ৪
আহত পুলিশ সদস্যদের পাশে আইজিপি
প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের জানাজায় যুবলীগ নেতা
সর্বশেষ খবর
বগুড়ার আদমদীঘিতে ট্রাকের ধাক্কায় বাইক আরোহী ৩ কলেজ বন্ধু নিহত
বগুড়ার আদমদীঘিতে ট্রাকের ধাক্কায় বাইক আরোহী ৩ কলেজ বন্ধু নিহত
মেসির ফ্রি কিকে পোর্তোকে হারালো মায়ামি
মেসির ফ্রি কিকে পোর্তোকে হারালো মায়ামি
বিশ্বের শীর্ষ ৫০ শহরের তালিকা থেকে বাদ পড়লো লন্ডন
বিশ্বের শীর্ষ ৫০ শহরের তালিকা থেকে বাদ পড়লো লন্ডন
নোয়াখালীতে ঝড়ে লন্ডভন্ড অর্ধশতাধিক বাড়িঘর, আহত ১০
নোয়াখালীতে ঝড়ে লন্ডভন্ড অর্ধশতাধিক বাড়িঘর, আহত ১০
সর্বাধিক পঠিত
আর চুপ থাকার পরিস্থিতি নেই, ইশরাক ইস্যুতে উপদেষ্টা আসিফ
আর চুপ থাকার পরিস্থিতি নেই, ইশরাক ইস্যুতে উপদেষ্টা আসিফ
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে মহাজোটের ২ শরিককে আমন্ত্রণ, নুর ও ইরানের ক্ষোভ
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে মহাজোটের ২ শরিককে আমন্ত্রণ, নুর ও ইরানের ক্ষোভ
নানার সূত্রে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে রাজি জায়ান হাকিম
নানার সূত্রে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে রাজি জায়ান হাকিম
ইরানে হামলার পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন ট্রাম্প
ইরানে হামলার পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন ট্রাম্প
যেন আকাশ ভেঙে পড়ছিল, ইসরায়েলি হামলার বর্ণনায় তুর্কি সীমান্তে ইরানিরা
যেন আকাশ ভেঙে পড়ছিল, ইসরায়েলি হামলার বর্ণনায় তুর্কি সীমান্তে ইরানিরা