সহকারী শিক্ষকদের পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে দুদিন ধরে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি বন্ধ। এতে শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। এ বছর প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছাতে সময় লেগে যায় মার্চ পর্যন্ত। তার ওপর শিক্ষকদের চলমান কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি আরও বেড়ে চলেছে ।
শিক্ষকরা বলছেন, আমরা শিক্ষার্থীদের কোনও ক্ষতি চাই না, তারা আমাদের সন্তান। পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে লেখাপড়া বন্ধ হলেও প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা মেতে আছে খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে। লেখাপড়ার প্রতি বাড়িতে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখারও আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষকরা। পাশাপাশি তিন দফা দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হওয়ারও আহ্বান জানান তারা।
গত ৫ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ১ ঘণ্টা, ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত ২ ঘণ্টা এবং ২১ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। ২৬ মে থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেন তারা।
এই আন্দোলন চলাকালে গত ২১ দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা কিছু ক্লাস পেয়েছে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা ও অর্ধদিবস কর্মবিরতির সময় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে খেলাধুলা, ছবি আঁকা এবং যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে আনন্দ করেছে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীরা। কিন্তু গত দুদিন ধরে কোনও লেখাপড়া নেই বিদ্যালয়গুলোতে। শুধু খেলাধুলা, ছবি আঁকাসহ আনন্দ উৎসব করেই দিন কেটেছে তাদের। আবার অনেকে বিদ্যালয়েও যাচ্ছে না।
শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে দেশের শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়েও ফ্রি স্কুল জীবন। এতে অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমন শিক্ষকরাও বিব্রত অবস্থায় পড়ছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, আমরা বিব্রত হচ্ছি। শিশুদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, কিন্তু সরকারের উচ্চ মহলে এর কোনও প্রভাব পড়েনি।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, ‘গত ২৩ দিন ধরে আন্দোলন চললেও সরকারের উচ্চ পর্যায় কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে কোনও সাড়া মেলেনি। তবে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষকদের শোকজ করেছে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসন। এছাড়াও অনেক জায়গায় শিক্ষকদের আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়ে তাদের কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। যেমন মাথাব্যথা নেই শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়েও।’
শিক্ষক নেতা ও রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি বলেন, ‘সারা দেশের শিক্ষকরা যখন দীর্ঘদিনের বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য ভয়কে উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করছেন তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা বিদ্যালয়ে আসছে, খেলাধুলা করছে, কিন্তু শ্রেণিকক্ষে নেই। একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আজ এমন চিত্র তৈরির পেছনে দায় শুধু আমাদের নয়, সবার। দ্রুত সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি মেনে নিতে হবে এবং সব শিক্ষকের চাওয়া সহকারী প্রধান শিক্ষক পদটি বাতিল করতে হবে। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি পূরণের পথ তৈরি করে আমাদের সন্তানদের কাছে আমাদের ফিরিয়ে দিন।’
শিশুরা বিদ্যালয়ে কী করছে, জানতে চাইলে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহেনুর আক্তার বলেন, ‘শিশু শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও তো বঞ্চিত হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে আমরা বিদ্যালয়ে শিশুদের নিরাপত্তা দিচ্ছি, নিয়ন্ত্রণে রাখছি, তারা তো আমাদের সন্তানের মতোই। তাই শিশুদের সুরক্ষা আমরা সব সময় বিবেচনায় রাখছি।’
শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে শিক্ষক শাহেনুর আক্তার বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও বিরোধ নেই। কনসালটেশন কমিটি সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে সহকারী শিক্ষকদের জন্য ১২তম গ্রেড, আর আমাদের দাবি ১১তম গ্রেড। এতে সরকারের ব্যাপক কোনও বাজেটের প্রয়োজন নেই। শিক্ষকদের সম্মানটাও বিবেচনা করা উচিত।’
পূর্ণদিবস কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনেও রাজশাহীর শিক্ষকদের কর্মসূচিতে সরব থাকতে দেখা গেছে। আর শিক্ষার্থীরা তখন গল্প-ছবি আঁকছে। তাদের সহযোগিতা করেছেন শিক্ষকরা।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও মোহনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘কর্মবিরতির আন্দোলন সহকারী শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এসে খেলাধুলা করছে, আমরা সুরক্ষা নিশ্চিত করছি। শিক্ষকদের আন্দোলন যৌক্তিক। তবে শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান, তাদের দিক বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’ প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড দ্রুত বাস্তবায়নসহ সহকারী শিক্ষকদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই শিক্ষক নেতা।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ফতেপুর বাউসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা কর্মবিরতি পালন করছি, ছেলেমেয়েরা স্কুলে এসে খেলাধুলা করছে।’
সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চললেও কোথাও কোথাও কর্মবিরতি পালনে বাধার সৃষ্টি করেছে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে তা খুব কম সংখ্যক জায়গায় ঘটেছে বলে দাবি করেছে ঐক্য পরিষদ।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মনিকা পারভীন জানান, ময়মনসিংহ সদরের শুধু চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমি এই কর্মবিরতি পালন করছেন। এছাড়া আর কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কর্মবিরতি পালনের ঘটনা নেই। তবে ক্লাস বা লেখাপড়া যে ঠিকমতো হচ্ছে না তা জানিয়েছেন অনেকেই।
বরিশালের অনেক বিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। স্থানীয় পর্যায়ের লোকজন দাবি করছেন, কর্মবিরতির তেমন প্রভাব এখানে নেই।
জেলার দোহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক অভিভাবক বলেন, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোনও আন্দোলন হতে পারে না। বিকল্প আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার অনুরোধ জানান তারা। এসব অভিভাবক আরও বলেন, এ বছর শিক্ষার্থীদের হাতে সম্পূর্ণ পাঠ্যবই পৌঁছাতে মার্চ পর্যন্ত সময় লেগেছে। এ কারণে তারা ঠিকমতো ক্লাস পায়নি। তার মধ্যে অর্ধদিবস, এখন আবার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি চলছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নগরীর বিনাবানী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পার্থ সারথী জানান, তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে পূর্ণদিবস কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হলেও তারা ক্লাস পরিচালনা করছেন। তারা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোনও আন্দোলন করতে চান না। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পাঠদান করাচ্ছেন।
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি জহিরুল ইসলাম জাফর বলেন, ‘গতকাল সোমবার কিছু সংখ্যক স্কুলে পাঠদান দেওয়া হলেও আজ বেশিরভাগ স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা পাঠদান থেকে বিরত রয়েছেন। সচিবালয়ের একটি আদেশের কারণে শিক্ষকরা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ায় গতকাল এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মবিরতি পালিত হয়েছে।’
কর্মবিরতি পালনকারী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যাতে পাঠ্যবই নিয়ে লেখাপড়ায় মেতে থাকে সেদিকে দৃষ্টি রাখবেন। শিক্ষার্থীদের মনে যেন ভিন্ন কোনও প্রভাব না পড়ে, লেখাপড়া থেকে মনোযোগ হারিয়ে না যায়, সেদিকে অভিভাবকদের নজর রাখার আহ্বান জানান শিক্ষকরা।
শিক্ষকদের তিন দফা দাবি
১. কনসালটেশন কমিটির সুপারিশের যৌক্তিক সংস্কার করে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ।
২. ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন।
৩. প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতিসহ দ্রুত পদোন্নতি প্রদান।