X
সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিক্ষার্থীরা বই পেলো দেরিতে, তারপরও সরকারের গচ্চা ১০০ কোটির বেশি

এস এম আববাস
০৮ জুন ২০২৫, ২৩:৫৯আপডেট : ০৮ জুন ২০২৫, ২৩:৫৯

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্যবই ছাপাতে গিয়ে সরকারকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত প্রাক্কলিত দরের তুলনায় গড়ে ২০ শতাংশ বেশি দরে ছাপানো হয়েছে সাড়ে ১২ কোটি কপির বেশি বই। এতে সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৫৫৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যেখানে প্রাক্কলিত দরে এই খরচ হওয়ার কথা ছিল ৪৪৫ কোটি টাকার আশেপাশে।

এ ব্যয়বৃদ্ধির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০০৬ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) এবং ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুসারে, কোনও পণ্য বা সেবার জন্য সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত দরের ১০ শতাংশের বেশি হলে রি-টেন্ডার বাধ্যতামূলক। কিন্তু এবারের পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে সে নিয়ম মানা হয়নি। বরং অতিরিক্ত দরে দরপত্র দেওয়া হয়েছে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইতেই ২৬৯ কোটি টাকা খরচ


মাধ্যমিকের অষ্টম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, দাখিল ও কারিগরি পাঠ্যবই ছাপাতে খরচ হয়েছে ২৬৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। মোট ৫ কোটি ২০ লাখ বইয়ের জন্য প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১৮ থেকে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি দর গৃহীত হয়েছে। ১০২টি আলাদা দরপত্রের মাধ্যমে এ কাজ দেওয়া হয়। 

এছাড়াও প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য ছাপানো ৭ কোটি ৩১ লাখ কপির জন্য খরচ হয়েছে ২৮৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এখানে মোট ১০৭টি দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাদের নির্বাচন করা হলেও তাদের প্রস্তাবিত দরও ছিল ১৬ থেকে ২৩ শতাংশ বেশি।

নিয়ম ভেঙে অনুমোদন

২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর এনসিটিবির বোর্ড সভায় দর মূল্যায়ন কমিটি বাড়তি দর অনুমোদনের সুপারিশ করে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করে এবং অর্থনৈতিক ক্রয় কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

তবে এ প্রক্রিয়ায় পিপিএ এবং পিপিআরের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পিপিএ ৩১(৩) ধারায় বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনও দর প্রাক্কলিত দরের ১০ শতাংশের বেশি হলে সেটি বাতিল বলে গণ্য হবে। একইভাবে, পিপিআর ৯৮(২৫) ধারায় বলা আছে, প্রাক্কলিত দরের বেশি হলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তা গ্রহণ করতে পারে—তবে শর্ত থাকে যে বাজারদরের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং পর্যাপ্ত বাজেট থাকতে হবে।

এখানে প্রশ্ন উঠেছে—পাঠ্যবই কেনা কি ‘গুডস’ (পণ্য) না ‘ওয়ার্কস’ (কাজ)? এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মতে, পাঠ্যবই কোনও রেডিমেড পণ্য নয়; এটি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করতে হয়। তাই এটি ‘ওয়ার্কস’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানে ১০ শতাংশ সীমা অতিক্রম করা আইনের পরিপন্থী।

আন্তর্জাতিক দরপত্র বাতিলে খরচ বাড়ে পাঠ্যবইয়ে


২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভারতীয় দুটি প্রতিষ্ঠান—‘মেসার্স পিতাম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘মেসার্স পাইনিওর প্রিন্টার্স লিমিটেড’—আন্তর্জাতিক টেন্ডারে সর্বনিম্ন রেসপনসিভ দরদাতা হিসেবে ১৮টি লটের কাজ পায়। প্রতি ফর্মায় তাদের প্রস্তাব ছিল ২ টাকা ৪৩ পয়সা থেকে ২ টাকা ৬৪ পয়সা। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে সেই টেন্ডার বাতিল করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পুনরায় কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়, যারা প্রতি ফর্মায় ১৬ থেকে ২৩ শতাংশ বেশি দর দিয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, ভারত-বিরোধী মনোভাব এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতে এই টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।

২০০৯ সালেও দেশীয় মুদ্রণ মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার আন্তর্জাতিক টেন্ডার চালু করে। তাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয় এবং বইয়ের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কিন্তু এবার সেই ধারা থেকে সরে গিয়ে আগের ‘বাড়তি দর সিন্ডিকেট’ পদ্ধতিতেই ফেরা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সময়মতো বই না পাওয়ার ভোগান্তি

সরকারের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে (আগস্ট ২০২৪-এ অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসা) এবং ছাপাখানার ধীরগতির কারণে শিক্ষার্থীরা ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সব বই পায়নি বছরের প্রথম দিনে। অনেক স্কুলে মার্চ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে সম্পূর্ণ সেট বইয়ের জন্য।

যা বলছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বর্তমান চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে বাড়তি দরে পাঠ্যবই ছাপতে হয়েছে। আর আমি ওই সময় চেয়ারম্যান ছিলাম না।’

এনসিটিবি ওই সময়ের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় রি-টেন্ডার করা যায়নি। সে কারণে সুযোগ নিয়েছে মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বাড়তি ব্যয়ের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল।’

‘পিপিএ অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি উদ্বৃত্ত কীভাবে দেওয়া যায়’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গুডস হিসেবে ১০ শতাংশের বেশির ক্ষেত্রেও বাধ্যবাধকতা নেই।’

যদিও এনসিটিবি সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পাঠ্যবই ‘গুডস’ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। পাঠ্যবই সরাসরি কিনে আনা হয় না। পাঠ্যবই প্রণয়ন করতে হয়, বিধায়, পাঠ্যবই প্রণয়ন ‘গুডস’ নয়, এটি ‘ওয়ার্কস’। ফলে ‘গুডস’ বলে সরকারি ক্রয় আইন লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই। লঙ্ঘন করা আর্থিক দুর্নীতি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, “রেডিমেইড পাঠ্যবই কিনে আনলে এটি গুডস হিসেবে গণ্য করা যেতো। কিন্তু পাঠ্যবই নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন দিয়ে তৈরি করিয়ে আনতে হয় বলে এটি ‘গুডস’ নয়, বরং ‘ওয়ার্কস’। ‘গুডস’ কেনার ক্ষেত্রেও বাজার দরের বাইরে অর্থাৎ এক টাকার জিনিস ১০০ টাকায় কেনা যায় না। সেটা করলে মহাদুর্নীতি হয়ে যাবে, যা বালিশ কাণ্ডে (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বেশি ব্যয়ে পণ্য ক্রয়) ঘটেছিল বলে অভিযোগ ওঠে বিগত সময়।”


/ইউএস/
সম্পর্কিত
সেই নাদিরা ইয়াসমিন ওএসডি
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাতিল
সরকারি হলো তিন বিদ্যালয়
সর্বশেষ খবর
ইতিহাস গড়ে লাল দুর্গের রাজত্ব ধরে রাখলেন আলকারেজ
ইতিহাস গড়ে লাল দুর্গের রাজত্ব ধরে রাখলেন আলকারেজ
ঈদের তৃতীয় দিন টিভি পর্দায় যত নাটক
ঈদের তৃতীয় দিন টিভি পর্দায় যত নাটক
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি : সাম্য রাইয়ান
অনুভবের কথাই লিখতে চেষ্টা করেছি : সাম্য রাইয়ান
সর্বাধিক পঠিত
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
এবার ৪৪ জন আমলাকে অপসারণের দাবিতে পোস্টার
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে চান টিউলিপ সিদ্দিক
মহিলা লীগ নেত্রীর কোরবানির মাংস ‘ভিক্ষা করার’ ভিডিও ভাইরাল
মহিলা লীগ নেত্রীর কোরবানির মাংস ‘ভিক্ষা করার’ ভিডিও ভাইরাল
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
সাবেক সংবাদ উপস্থাপক তরীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার
রোগীর সেলাই-ড্রেসিং করা সেই ওয়ার্ডবয় গ্রেফতার