বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। রণাঙ্গন থেকে ফিরে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। এরপর একের পর এক এসেছে- ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নের রাত’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এই অন্তরে তুমি ছাড়া নেই কারো’, ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, ‘তোমার হয়ে গেছি আমি’, ‘মায়ের মাথার সিঁথির মতো লম্বা সাদা পথ’, ‘হৃদয়ের চেয়ে ভালো কোনও ফুলদানি নেই’র মতো কালজয়ী গান।
বলা হচ্ছে খ্যাতিমান গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর কথা। ১৯৯০ সালে প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধা-গীতিকবি অবশেষে পেলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
আজ (৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ জন পাচ্ছেন একুশে পদক। যেখানে আছে তার নাম। সংগীতে অবদান রাখায় শিল্পকলা বিভাগে মরণোত্তর পদক দেওয়া হচ্ছে তাকে।
দীর্ঘদিন ধরেই তার অনেক সহকর্মী আফসোস করে আসছিলেন, একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সম্মান যেন দেওয়া হয় তাকে।
অনেক গানের সঙ্গী শেখ সাদী খান ও প্রয়াত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলও তাকে নিয়ে অনেক সাক্ষাৎকারেই করেছেন আক্ষেপ। অবশেষে এলো পদক।
এদিকে, ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় নজরুল ইসলাম বাবুকে নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ ‘নজরুল ইসলাম বাবু স্মারকগ্রন্থ’। এটি সংকলন করেছেন আরেক বরেণ্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। প্রয়াত গীতিকবি ছিলেন রফিকউজ্জামানের ঘনিষ্ঠজন।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নজরুল ইসলাম বাবু দেশের গান অনেক রচনা করেছেন। তবে আমি এগিয়ে রাখি ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ গানটি। তিনি লেখায় একটি আবহ তৈরি করতে পারতেন। এটা তার দুর্লভ প্রতিভা। আধুনিক গানগুলোও চমৎকার। চলচ্চিত্রে অসাধারণ গান রচনা করেছেন। ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নের রাত’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’- শব্দ ব্যবহার চমৎকার, ভাবনার নতুনত্ব ছিল। ছন্দে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠার আগেই তিনি মারা গেলেন। হয়তো তিনি তার প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার আগেই মারা গেলেন।’’
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা ও মরণোত্তর পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘‘বাবুর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘রফিক ভাই আপনি বাবুকে ছেড়ে দিয়েছেন বলেই বাবু চলে গেলো’। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আমি বাবুকে ছাড়িনি; বরং বাবুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন।’ এই যে সরকার এখন মরণোত্তর পুরস্কার দেয়- এতে একজন মৃত শিল্পীর জন্য কতটুকুই আর যায় আসে? বরং বেঁচে থাকা অবস্থায় পেলে কিছুটা হলেও তৃপ্তি পেতো।’’
নজরুল ইসলাম বাবুর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে। তার বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রেজিয়া বেগম গৃহিণী। বাবা বজলুল কাদেরের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে মামার কর্মস্থল বরিশালে চলে যান। সেখানকার বি এম স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক এবং পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএসসি ডিগ্রি নেন।
২১ বছরের টগবগে তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে বেশ নামডাক করেছিলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা হওয়ায় তিনি আত্মগোপন করেন। পরে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীতচর্চা শুরু করেন। ১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।