X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
স্মরণ

কায়েস চৌধুরীর প্রতি চিঠি অথবা কিছু প্রশ্ন

আহসান কবির
২১ অক্টোবর ২০২২, ১৩:৪৯আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৫৩

প্রিয় কায়েস চৌধুরী,

কেমন আছেন?

নাজিম হিকমত লিখেছিলেন–‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একটা বছর’! আপনার চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো আজ (২১ অক্টোবর)। দীর্ঘশ্বাসের বাঁশিতে ধুন তুলে আপনার লেখা গানগুলো আরও করুণ সুরে যদি বাজানো যায়, তবে সেটি বলে দেবে আপনার জন্য রাখা দীর্ঘশ্বাসগুলো শুধু এক বছরের জন্য নয়, আজীবনের। আপনাকে নীরবে মনে করার বা মনে রাখার কারণও আপনি। আপনি এক অসহনীয় নীরবতার জগতে বাস করতেন, একা। সিগারেট খাওয়ার সময়ও চুপচাপ থাকতেন। কখনও কাব্য করে বলতেন– চিতার আগুনেরও শব্দ খাকে। শরীর কিংবা কাঠ একসঙ্গে আগুনে ফোটে। হৃদয় পোড়ার কোনও শব্দ থাকে না। অভিমান আর হৃদয় পোড়ার কষ্ট নিয়ে আপনি নীরবতার এক স্বর্গ বানিয়েছিলেন। সেই স্বর্গের দরোজায় টোকা দিলে ভয়াবহ সুন্দর এক হাসি দিয়ে দরোজা খুলতেন। আপনি নেই কিন্তু সেই হাসিটা আজও স্মরণে রয়ে গেছে। কষ্ট আর অভিমান আপনি একাই নিয়ে গেছেন।

প্রিয় কায়েস চৌধুরী কোথায় আছেন এখন? আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখলেও সেটা ফেরত আসবে জানি। আপনি সম্ভবত কোনও এক ‘গঞ্জে’ থাকেন। উদ্দেশ্যহীন কোনও একদিন শাহবাগ আজিজ মার্কেটে না এলে আপনার সঙ্গে দেখাই হতো না। ৯৪-৯৫-৯৬ সালে আমি যখন বিশুদ্ধ ভবঘুরে আপনি তখন দেশের নামকরা এক নির্মাতা। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করতেন তখন। আপনার সঙ্গে ঘুরতে গেলে বলতেন– চলেন মাথার ধারের নদীটার কাছে যাই। সেই নদী অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে কালীগঞ্জ। কখনও সখনও শীতলক্ষ্যার পাড়ের নারায়ণগঞ্জ। আর পায়ের দিকের নদী হচ্ছে কালীগঙ্গা ও তার বুক বেয়ে বয়ে চলা মানিকগঞ্জ। করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে মানিকগঞ্জের স্মৃতি আজও দোলা দেয়। মজা করার জন্য একটা গান তখন শুনতাম– ‘মানিকগঞ্জের বড় মিঞা/ আতর মাখা রুমাল দিয়া..’। পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদের মতো বাংলা টেলিভিশন নাটকের ঘরানায় আপনি ছিলেন ‘বড়মিঞা’। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী কতজন সহকারী ছিল বা কাজ শিখেছিল আপনার কাছ থেকে? কতজন অভিনয় করতে এসেছিল আপনার হাত ধরে? কতজন আদর করে ‘বাবা’ ডাকতো আপনাকে? আপনি যেখানে আছেন সেই নীরবতার ধূসর জগতে কারও কথা কি আপনার মনে পড়ে? তিন কন্যার নাম রেখেছিলেন ‘মা’ যুক্ত করে। কার কথা আপনার বেশি মনে পড়ে?

প্রিয় কায়েস ভাই, চলে যাওয়ার আগে কি আপনার প্রিয় কিছু কাজ ‘পেনড্রাইভে’ করে নিয়ে গেছেন? নাকি কোনও কিছুই নেওয়া যায় না? চুমকি চলেছে একা পথে গানটা যে ছবিতে ছিল সেই ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির কথা মনে পড়ে? হিন্দি সিনেমার ইতিহাস বদলে দেওয়া ‘শোলে’ ছবির রিমেক এ দেশে করেছিলেন পরিচালক দেওয়ান নজরুল। আপনি আজীবন এই মানুষটাকে ‘দেওয়ানজি’ ডেকেছেন। দেওয়ান নজরুলের সহকারী হিসেবে আপনি নির্মাণের জগতে এসেছিলেন। দেওয়ানজি আছেন আরও শতবর্ষ থাকুন তিনি পৃথিবীতে, আপনি নেই কায়েস চৌধুরী। আপনার আরেক ভক্ত, সহকারী এবং অভিনেতা শামীম ভিস্তি। আপনার চলে যাবার খবর শুনে সেও অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেও চলে যায় অজানা ভুবনে। ভিস্তির সাথে কি আপনার দেখা হয়েছে কায়েস ভাই?

আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কিছু কি নিয়ে গেছেন সাথে করে? আপনার প্রথম ধারাবাহিক নাটকের নাম ছিল ‘না’। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল নাটকটি। প্রথমটার কথা বললাম এ কারণে যে আপনার লেখা এবং পরিচালিত নাটকের সংখ্যা নির্দ্বিধায় একশ’র বেশি হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাজ করতে দেখেছিলাম আপনাকে প্রথম, সেই ১৯৯৫-৯৬ সালে। ‘তুমি রবে নিশ্বাসে তুমি রবে বিশ্বাসে’ নামের তথ্যচিত্রের কথা আজও মনে পড়ে। সময় বদলেছে এখন। অনেকের কাছে যেটা ছিল একদা ঘোর  দুর্দিন, আজ কারও কারও কাছে সেটা ক্ষমতাশালী সুদিন। এই তথ্যচিত্রের কথা কি ক্ষমতাশালী সুদিনদের কারও মনে আছে? নাকি আপনি নীরবেই সেটা নিয়ে গেছেন সাথে করে, যদি কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয় সেই অক্ষয় আশাতে?

বিজ্ঞাপন জগতেও আপনি একসময় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আপনার আইডিয়া এবং পরিচালনাধীন বিজ্ঞাপনচিত্রের সংখ্যা ৬৫। আন্তর্জাতিকভাবে আপনার যেসব তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে সেসব নিয়ে আজও গর্ব করা যায়। সৌদি আরবের অর্থায়নে নির্মাণ করেছিলেন ‘হজ পারফরম্যান্স স্টাডি’, যা পৃথিবীর ৬৫টি দেশে প্রদর্শিত হয়েছে। সৌদির অর্থায়নে আরও নির্মাণ করেছিলেন– ‘আরব ডেজার্ট লাইফ’। আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মাণ করেছিলেন ‘দ্য গোল্ডেন ম্যারিন পয়েন্ট’। বিবিসির জন্য নির্মাণ করেছিলেন ‘ভাসমান যৌনকর্মী’ এবং ‘হিউম্যান মেশিন’ ও ‘চাইল্ড লেবার’ নামের শিশুশ্রমের ওপর অসাধারণ সব তথ্যচিত্র।

২০০০ সালে আপনার নির্মিত ও বিবিসিতে প্রচারিত ‘সময়ের এক ফোঁড়’ বছরের শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের পুরস্কার জেতে। একই বছর পানিতে আর্সেনিকের উপাদান নিয়ে আপনার নির্মিত ‘আর্সেনিক অ্যালার্ট’ নামের ডকুমেন্টারি পুরস্কার পায়। ২০০২ সালে বয়স্ক শিক্ষা নিয়ে আপনার নির্মিত ‘জ্বলুক আলো ঘরে ঘরে’ও পুরস্কার এনে দিয়েছিল। এনএইচকে টিভি, জাপানের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘সুন্দরবন, দ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট অ্যান্ড অ্যামাজিং ফিশিং ওয়ে’ নামের সুন্দর এক ডকুমেন্টারি। বাংলাদেশ নিউট্রেশান প্রোগ্রামের অধীন মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ক আপনার চিত্রনাট্যের সংখ্যা ৩৮। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন আটটি ছবি। দেশে-বিদেশে কোম্পানি প্রোফাইল করেছেন একশ’র মতো। জানি না আপনার এত এত কাজ, এসব কোথায় আছে কীভাবে আছে। নাকি ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর একটা বছরের’ মতো যা কিছু ভিজুয়াল সবকিছু ‘ইরেজ মিডিয়া’র অংশ? জীবনের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে চাইলেই কি সবকিছু বা সব স্মৃতি মুছে ফেলা যায়?

প্রিয় কায়েস চৌধুরী, জীবনের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে স্মৃতি মুছে ফেলার সেই ডাস্টার কি ছিল আপনার কাছে? আপনি কি সাথে করে নিয়ে গেছেন সেটা? নাকি যেখানে গেছেন সেখানেও নীরবতার এক বলয় তৈরি করেছেন? শ্যাওলা হয়ে হোক কিংবা বৃক্ষের মতো কি সেখানে স্মৃতি জন্মায়? সেখানে মাথার দিকে কি বুড়িগঙ্গা কিংবা শীতলক্ষ্যা আছে? পায়ের দিকে কি কালীগঙ্গা কিংবা ইছামতি দোল খায়? যেখানে আছেন সেখানেও কি খুব একা?

আপনি বলতেন, ‘যতদিন মানুষ নিয়ে ছিলাম তার অনেক বেশি থেকেছি একা হয়ে। একাকিত্বের চেয়ে আপন কেউ ছিল না আমার’। এখনও কি আপনার সেই স্বীকারোক্তিই সমান সত্য? সে কারণেই কি লিখেছিলেন–‘আজ সারা দিন তুমি তুমি করে কষ্টে থেকেছি আমি’?

আপনার লেখা জনপ্রিয়তম এক গানে আছে– ‘প্রতি নিশ্বাসে কষ্ট ধরে বেঁচে থাকা দায় তোমাকে ছাড়া’! মায়াবী পর্দার জন্য এত নির্মাণের বাইরে আপনি কি সেই তুমুল কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিলেন আমাদের মাঝে?

আহসান কবির বিশেষ দ্রষ্টব্য: কথা ছিল আমার লেখা গান নিয়ে কিছু করবেন আপনি। কবিতার বই থেকে দুটো লাইন বেছে নিয়েছিলেন- ‘বিশ্বাসী মানুষ বানায় অবিশ্বাসের ঘর/ নিঃস্বার্থ মানুষ মানেই ভীষণ স্বার্থপর!’ তারপর আর কিছুই হয়নি! করোনার দিনগুলোতে ফাঁকা রাস্তায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তুমুল গতিতে গাড়ি চালানোর মতো দিনগুলো কোথায় যেন চলে গেছে। জীবনের স্বার্থপরতায় হারিয়ে গেছে সব। আমার কাছে স্মৃতি মুছে ফেলার কোনও ডাস্টার নেই বলে রাতের আকাশে তাকালে আপনার লেখা গান দীর্ঘশ্বাস হয়ে ফিরে আসে–

‘রাতেরও আকাশে নিশ্চুপ সাক্ষী

দূরের ঐ  ধ্রুবতারা

কতটা বেসেছি ভালো..

শুধু মন জানে’…

যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছেন তার মাথা বা পায়ের দিকে কোনও নদী নেই। কবরের সীমানা বেষ্টনীতে টানানো আছে– ‘রাতেরও আকাশে নিশ্চুপ সাক্ষী দূরের ওই ধ্রুবতারা... গানের এই লাইনটা!

ধ্রুবতারাদের খসে পড়ার কোনও ইতিহাস নেই!

লেখক: সাংবাদিক, গীতিকবি ও সমালোচক

/এসএএস/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
সিনেমা সমালোচনারাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সিনেমা সমালোচনাকাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য