X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
সিনেমা রিভিউ

দেশান্তর: দেশভাগের বেদনা রাঙানো প্রথম বাংলাদেশি ছবি

আহসান কবির
২০ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৪৫আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৫৫

আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি/ এক দেশ থেকে অন্য দেশে/ এক ধর্ষণ থেকে আরও এক ধর্ষণের দিকে... (দেশান্তর, শঙ্খ ঘোষ)।

কবি নির্মলেন্দু গুণের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত প্রথম ছবি ‘দেশান্তর’। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া পরিচালক আশুতোষ সুজনের প্রথম ছবি এটি। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পটভূমিতে বেদনা রাঙানো অনুদানের এক ছবি এটি। পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের ত্রয়ী চলচ্চিত্র ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ও ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫); রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ (১৯৭৫, বাংলাদেশেও মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি), সৃজিত মুখার্জির ‘রাজকাহিনী’ (২০১৫), গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’ (২০১৬), লীনা গাঙ্গুলি ও শৈবাল ব্যানার্জির ‘মাটি’ (২০১৮) ছবিগুলোর মতো দেশভাগের আখ্যান নিয়ে বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম ছবি ‘দেশান্তর’।

১৯৪৭-এর দেশভাগে ভারত ও পাকিস্তানের অনেক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ও নৃশংসতার শিকার হয়েছিল পাঞ্জাব আর বাংলা। স্বজন হারানো ও হৃদয় বিভাজনের নির্মমতা আর অমানবিক জীবনযাপনের দাগ নিয়ে তৈরি ছবি ‘দেশান্তর’।

রুবেল-টাপুর, সিনেমাটির পোস্টার ও টাপুর-ইয়াশ দেশভাগের গল্পে শোষণ আর ধর্মের বিভাজনে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কারও ভারতে চলে যাওয়া আর কারও ভারত থেকে বাংলাদেশে (তৎকালীন পাকিস্তান) চলে আসাটাই বেশি দেখা যেতো। কবি নির্মলেন্দু গুণের উপন্যাস কিংবা ‘দেশান্তর’ ছবির গল্প তেমন নয়। ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী’- স্বদেশ প্রেমের এই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মাটি কামড়ে দেশে থেকে যাওয়ার গল্পের ছবি ‘দেশান্তর’। দেশকে ভালোবাসার এক বুক-ঝিম ছবি ‘দেশান্তর’।

ছবির অন্নপূর্ণা ও মনীন্দ্রর তিন সন্তান, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে মনসা বাবা মনীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ। সদ্য কিশোরী হওয়া মনসাকে বিয়ে দেওয়া হয় পাশের গ্রামে। তখনকার সময়ে এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হতো। বিয়ের আগে মনীন্দ্রকে তার বেয়াই অনীল ধর কথা দেন যে তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু বিয়ের পর পাল্টে যেতে থাকে সবকিছু। অনেকেই, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভারতে চলে যেতে থাকেন ভয় কিংবা ধর্মীয় বিভাজনকে কেন্দ্র করে শোষণের ভয়ে, কেউ কেউ চলে যান জমি বিনিময় করে। কিন্তু মনীন্দ্রর এক কথা। তিনি মাটি কামড়ে এ দেশেই থেকে যাবেন। মনসার শ্বশুরবাড়িতে যখন চলছে ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা, তখন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনেন মনীন্দ্র। এরপর শ্বশুরপক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিচার বসিয়ে কিশোরী বউকে ফিরিয়ে নিতে এলে মেয়ে মনসা তার বাবার মতো নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেয় এই দেশ ছেড়ে সে কোথাও যাবে না!

টাপুর ও মৌসুমী দেশভাগের পটভূমিতে নির্মিত এই ছবির সময়কাল দেখানো হয়েছে ১৯৯৪৭ থেকে ১৯৫১। ছবির বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, নদীনালা, খালবিল সেই সময়কার বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে। খুব ছোট্ট পরিসরে সেই সময়কার রাজনীতিটাও স্পষ্ট ছবিতে। মুসলিম লীগ যে পাকিস্তান চায়, কমিউনিস্ট পার্টি সেই পাকিস্তান চায় না বলেই মনীন্দ্র বাপ-দাদার ভিটে অর্থাৎ দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। সেই সময়কার পোশাক, পানের বাটা, কাপড় রাখার ট্রাংক কিংবা নৌকাও দেখা গেছে ছবিতে। রাতের বেলার নিঃস্ব অন্ধকার কিংবা দিনের আলোর বেদনাহত রঙটাও আছে ছবিতে। সেই সময়কার বাংলাদেশ এই ছবির ফটোগ্রাফিতে দুর্দান্তভাবে এসেছে।

ছবির শুটিং হয়েছে নেত্রকোনা, গাজীপুর, কালীগঞ্জের নাগরী ও কেশরপা গ্রামে। কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা বলেই হয়তো ছবিতে নেত্রকোনার ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন তিন জন। নুরুল আলম আতিক, ডালিম কুমার ও পরিচালক আশুতোষ সুজন নিজে। ফটোগ্রাফিতে সেই সময়কার আবহ তুলে এনেছেন নেহাল কোরায়শী। মনীন্দ্রর ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। দেশ ত্যাগ না করার প্রতিজ্ঞা, মেয়ের জন্য কষ্ট, সাধুর গান শুনে বেদনা ভোলার চেষ্টা, সর্বহারা বাংলাদেশের মতো এক বাবার চরিত্র সুনিপুণভাবে রূপায়ণ করেছেন তিনি। ছবির আরেক চরিত্র মনসা। কিশোরী মেয়ের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন রোদেলা টাপুর। মনেই হয়নি যে এটা টাপুরের প্রথম ছবি। কিশোরী এই মেয়েটার স্বামীর প্রতি ভালোবাসার কমতি না থাকলেও তার অভিনয়ে দেশের প্রতি মমত্ব ছিল তুমুল। বড় পর্দায় রোদেলা টাপুরের অভিষেক স্মরণীয় করে রাখতে টাপুর, তার বাবা এবং মা নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা সতীর্থ রহমান রুবেল ও গোলাম ফরিদা ছন্দাকেও শুভাশিস জানিয়ে রাখা যায়। টাপুরের প্রথম অভিনয় ছিল তারা বাবা সতীর্থ রহমান রুবেল পরিচালিত নাটক ‘খোলস’-এ। 

মৌসুমী নিজের মতোই অভিনয় করেছেন অন্নপূর্ণা চরিত্রে, হয়তো নেত্রকোনার ভাষার প্রতি পুরোপুরি দখল ছিল না তার।

মোমেনা, ইয়াশ ও শুভাশিস ছবিতে অশোক বেপারি অভিনয় করেছেন অরোদ দাসের ভূমিকায়। দেশত্যাগের সময় নিজ বাড়ির মাটি নিয়ে তার মাতম মানুষকে আলোড়িত করেছে। মনসার শ্বশুর অনীল ধরের ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেছেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-খ্যাত শুভাশিস ভৌমিক। মনসার জামাই শুভেন্দুর ভূমিকায় ইয়াশ রোহানও ভালো অভিনয় করেছেন। শিক্ষক জামাই চরিত্রে তিনি ছিলেন বেশ সাবলীল। এছাড়া মামুনুর রশীদ, মোমেনা চৌধুরী, রিফাত চৌধুরী ও মনসার দুই ভাইসহ এই ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীরা ছিলেন নিজের চরিত্রে সপ্রতিভ।

ছবিটি ১১ নভেম্বর মাত্র দুটি হলে মুক্তি পেয়েছে। সৃষ্টিশীল ছবি বেশিরভাগ সময়ে বাণিজ্য-লক্ষ্মীর সন্ধান পায় না। দেশান্তর ছবিটা হয়তো এই দীর্ঘশ্বাস নিয়েই টিকে থাকবে। ছবিতে গান ব্যবহৃত হয়েছে চারটি। এই ছবিতে পরিচালক আশুতোষ সুজন গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ‘আমার স্বপ্নের হাতে হাতকড়া’ গানের কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন সুজন নিজেই। দুটো গান করেছেন জাহিদ নীরব এবং অন্যটি করেছেন ইমন চৌধুরী। গান চারটিও ছবিতে নিদারুণ ব্যঞ্জনায় ব্যবহৃত হয়েছে। রামপ্রাসাদী গানটির ব্যবহার চমকপ্রদ।

বাংলা ছবির বাঁকবদলের এই সময়ে এ দেশের ছবির জগতে এক অনন্য সংযোজন ‘দেশান্তর’। দুই ধর্মের সম্প্রীতি বা রেষারেষি, দেশত্যাগের মাধ্যমে সর্বোচ্চ হারানো হৃদয়ের না শুকানো ক্ষত নিয়ে মানুষের অমানবিকতার এক মানবিক ছবি ‘দেশান্তর’।

জয় হোক বাংলা ছবির।

লেখক: সাংবাদিক, সমালোচক ও রম্যলেখক

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
মা হারালেন বেবী নাজনীন
মা হারালেন বেবী নাজনীন
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘অভিনেতা’ ও ‘টিনের তলোয়ার’
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি