‘চিকা মারা’র মধ্যে দুটো বিষয় লুকিয়ে আছে। একটি রাজনৈতিক অন্যটি সামাজিক। এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বেশ সমৃদ্ধ। দলগুলো তাদের আদর্শ, নীতির প্রচার, জনগণের দাবি আদায় বা সরকার বিরোধী প্রচারণার জন্য এই ‘চিকা’ পন্থা বেছে নিয়েছে ঐতিহাসিকভাবে। আবার কোনও এক অজ্ঞাতনামা প্রেমিক ‘অপেক্ষায় আইজুদ্দিন’ চিকা মেরেও ইতিহাস হয়ে আছেন ঢাবি ক্যাম্পাসে।
বিপরীতে ‘চিকা মারা’র সামাজিক বিষয়টি অনেকটা নেতিবাচক। কারণ, এই চিকা মারা মানে যে কোনও সুন্দর দেয়ালে লেখালেখির মাধ্যমে অসুন্দরকে টুকে দেওয়া মনে করেন নগর প্রশাসক বা দেয়াল মালিকরা। ধরুন, দেয়ালে যদি ইঁদুর মারার বিষ বিক্রির চিকা মারা হয়; তো বিষয়টি নিয়ে আপত্তি আসতেই পারে। কিংবা বিরোধী দলের চিকাকে সরকার দল নেতিবাচকভাবে নিতেই পারে।
আবার এই চিকা মারা প্রকল্পের আরেকটি শৈল্পিক বিভাগ রয়েছে, যার নাম গ্রাফিতি।
তবে এসব ছাপিয়ে নির্মাতা যুবরাজ শামীম ‘চিকা মারা’কে নতুন প্রাণ দিতে চলেছেন স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। মুক্তিপ্রতীক্ষিত তার সিনেমা ‘আদিম’ প্রচারণায় বেছে নিলেন চিকা কৌশল। রাশিয়া-আমেরিকা-ইতালি ঘুরে ছবিটি দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ১২ মে। যার প্রচারণা এরমধ্যেই শুরু করেছেন রাত জেগে রাজধানীর দেয়ালে-ফুটপাথে চিকা মারার মাধ্যমে।
যুবরাজ জানান, টিএসসি থেকে তার চিকা মারা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে সম্প্রতি। শাহবাগ-পরীবাগ এলাকাও কাভার করেছেন এরমধ্যে। কিছু স্থিরচিত্রে দেখা গেছে, ‘আদিম’ ছবির লোগোটি চিকা মারছেন নির্মাতা, রাতের অন্ধকারে। হুম, চিকা মারার ঐতিহাসিক সময়টাই হচ্ছে রাতের অন্ধকারে! যুবরাজও তাই করছেন।
কিন্তু কেন এই চিকা মারার প্রক্রিয়া বেছে নিলেন! অভাব নয় তো! জবাবে শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘অর্থ বা অভাবের ভেতর দিয়েই পুরো প্রক্রিয়াটা যাচ্ছে। সেই শুরু থেকে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি শুরু থেকেই সচেতন- অভাবটাকে আমি পুঁজি করবো না। কারোর দয়ায় আমি কিছু করতে চাইনি। ফলে চিকা মারার বিষয়টিকেও পোস্টার বানানোর পয়সার অভাবের করছি, সেটা বলা ঠিক হবে না। আমি আসলে আমার সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকে একটু বিকল্প পথ বের করার চেষ্টা করছি এই চিকা মারার মাধ্যমে। তাই এটাকে অভাব না বলে প্রচারণার নতুন পথও বলতে পারেন। অভাব তো আছেই, কিন্তু সেটিকে বিক্রি করে আমি সমবেদনা আদায় করতে চাই না। আমি আসলে সিনেমাটা বিক্রি করতে চাই দর্শকদের কাছে।’
যুবরাজ শামীম বেশ আত্মবিশ্বাসী ‘আদিম’ ও নিজেকে নিয়ে। সম্ভবত সেই সুবাদেই টঙ্গী থেকে সিনেমা বানিয়ে সোজা উড়ে যান রাশিয়ায়। সেখানে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৪৪তম আসরে সিলভার জর্জ অ্যাওয়ার্ড (স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড) এবং নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় ‘আদিম’। এরপর ইতালির ২৫তম রিলিজিয়ন টুডে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও দর্শক-সমালোচক প্রশংসা পেয়েছে ছবিটি। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১২তম কুইন্স ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা সিনেমার পুরস্কারটি পেয়েছে ‘আদিম’।
ফেরা যাক ছবিটির মুক্তি ও চিকা মারা প্রসঙ্গে। যুবরাজ জানান, যেহেতু তিনি প্রায় একাই ছবিটি নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন ফলে হাতে সময় নিয়েই প্রচারণার কাজটি শুরু করেছেন। ফলে ফেব্রুয়ারি টু মে পর্যন্ত অনেকগুলো পরিকল্পনা আছে তার মাথায়। যার একটি হলো চিকা মারা প্রকল্প। যার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে চান যুবরাজ ও ‘আদিম’।
তার ভাষায়, ‘সব ছবির প্রচারণা তো একরকম হলে চলে না। সবার রুচি, সীমাবদ্ধতাও এক নয়। দেখুন অনেকে গণ অর্থায়নের ছবির কথা শুনলেই এখন নাক সিটকায় ভয় পায়। মনে করে, টাকা মেরে দেওয়ার প্রকল্প। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি সিনেমাটিকে গণ অর্থায়নের দিকে নিইনি। আমি শেয়ার হোল্ডার বানিয়েছি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি শেয়ার হোল্ডারকে আমি গুনে গুনে টাকা ফেরত দেবো। প্রমাণ করবো, গণ অর্থায়নের সিনেমা জলে ডুবে যায় না। আমি জানি, সিদ্ধান্তটি কঠিন। কিন্তু সিনেমার মান বাঁচাতে এই প্রমাণটা আমি করতে চাই সবার সহযোগিতা নিয়ে। বাকিটা সময়ের হাতে।’
বলে রাখা প্রয়োজন, ‘আদিম’ নির্মিত হয়েছে ঢাকা-গাজীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা টঙ্গীর ব্যাংক মাঠ বস্তিতে। চমকপ্রদ বিষয় হলো, এখানে অভিনয় করা শিল্পীরাও সেই বস্তিরই মানুষ। অর্থাৎ বাস্তবিক ছবি বানাতে গিয়ে যুবরাজ শামীম কোনও পাকা অভিনেতা নয়, বাস্তব মানুষই বেছে নিয়েছেন।
‘আদিম’র মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুলাল মিয়া ও সোহাগী। ছবিটির চিত্রগ্রহণে ছিলেন আমির হামযা। এরমধ্যে ছবিটি পেয়েছে আনকাট ছাড়পত্র। 
