X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সিনেমা রিভিউ

মায়ার জঞ্জাল: তৈরি হয় কোথায়, সাফ করে কে? 

বিধান রিবেরু
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১২আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১০

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দার্শনিক প্রতীতি দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। ‘মনুষ্যত্ব কী?’ প্রবন্ধে বঙ্কিম বলছেন, “বাস্তবিক জীবনের উদ্দেশ্য কী, এ তত্ত্বের প্রকৃত মীমাংসা লইয়া মনুষ্যলোকে আজিও বড় গোল আছে। লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্ব্বে, অনন্ত সমুদ্রের অতলস্পর্শ জলমধ্যে যে আণুবীক্ষণিক জীব বাস করিত, তাহার দেহতত্ত্ব লইয়া মনুষ্য বিশেষ ব্যস্ত, আপনি এ সংসারে আসিয়া কি করিবে, তাহা সম্যক প্রকারে স্থিরীকরণে তাদৃশ চেষ্টিত নহে। যে প্রকার হউক, আপনার উদরপূর্ত্তি এবং অপরাপর বাহ্যেন্দ্রিয়সকল চরিতার্থ করিয়া, আত্মীয় স্বজনেরও উদরপূর্ত্তি সংসাধিত করিতে পারিলেই অনেকে মনুষ্যজন্ম সফল বলিয়া বোধ করেন। তাহার ওপর কোনও প্রকারে অন্যের ওপর প্রাধান্যলাভ উদ্দেশ্য। উদরপূর্ত্তির পর, ধনে হউক বা অন্য প্রকারে হউক, লোকমধ্যে যথাসাধ্য প্রাধান্য লাভ করাকে মনুষ্যগণ আপনাদিগের জীবনের উদ্দেশ্য বিবেচনা করিয়া কার্য্য করে। এই প্রাধান্যলাভের উপায়, লোকের বিবেচনায় প্রধানতঃ ধন, তৎপরে রাজপদ ও যশঃ। অতএব ধন, পদ ও যশঃ মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া মুখে স্বীকৃত হউক বা না হউক, কার্যত মনুষ্যলোকে সর্ব্বাবদিসম্মত। এই তিনটির সমবায়, সমাজে সম্পদ্ বলিয়া পরিচিত। তিনটির একত্রীকরণ দুর্লভ, অতএব দুই একটি, বিশেষতঃ ধন থাকিলেই সম্পদ বর্তমান বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে। এই সম্পাদাকাঙ্ক্ষাই সমাজমধ্যে লোকজীবনের উদ্দেশ্যস্বরূপ অগ্রবর্ত্তী এবং ইহাই সমাজের ঘোরতর অনিষ্টের কারণ।”

ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী পরিচালিত ‘মায়ার জঞ্জাল’ দেখে এই প্রশ্নই মাথায় আসবে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? খ্যাতির যেমন বিড়ম্বনা থাকে, তেমনি মায়ারও যন্ত্রণা থাকে, মানুষের মায়া হয় নিজের প্রতি ও অপরের প্রতি। সম্পর্কের ছায়াতেই মায়ার জন্ম। সম্পর্কের প্রতি টান সমাজবদ্ধ মানুষের স্বভাবজাত, তবে এও তো ঠিক, সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে মানুষ আবার বেরুতেও চায়, পারে কি? বঙ্কিমের কথার শেষ থেকে যদি শুরু করি, তবে চলে যেতে হবে চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্যে, যেখানে ক্ষমতাধর জগা মিত্তির গোগ্রাসে ভাত গিলছিল, সাথে হাসির ভিডিও। বোঝা যায় অবৈধ উপায়ে উপার্জন করে সে ধনবান এবং সেটার জোরে সে লেবু দা ও সত্যের মতো লোক পালে, অর্থাৎ অন্যের ওপর তার প্রাধান্য রয়েছে। ছবির হাসপাতাল দৃশ্যেও এমন প্রাধান্যের এক রূপক আমরা দেখি বাঘের হরিণ শিকারের ভেতর দিয়ে। 

চলচ্চিত্রটি পরিচালক বিস্তার করেছেন তিনটি বৃত্তে। তারা আবার পরস্পরকে ছেদ করে যায়। ছেদনের পর তিন বৃত্ত অভিন্ন যে জায়গা উৎপন্ন করে সেটাই মানুষের খাঁটি বাসনা। বাসনার ভেতর মায়া ঘাপটি মেরে থাকে। তিন বৃত্তের অভিন্ন ভূমি বাদে বাকি অঞ্চল ‘জঞ্জাল’ই বটে, অপ্রীতিকর পরিণাম, অথবা মায়ার ছায়া, সমাজের বেড়াজাল, পিছু ছাড়ে না, কিন্তু তাকে বাদও দেওয়া যায় না। প্রথম বৃত্তে রয়েছে সত্য ও সরলা সরকার ওরফে বিউটি এবং তাদের আশপাশের লোকজন। দ্বিতীয় বৃত্তে রয়েছে চন্দন ও সোমার পরিবার। আর তৃতীয় বৃত্তে রয়েছে বড়লোক পাড়ার গগনচুম্বী এপার্টমেন্টে থাকা এক পরিবার, যেখানে এক বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল মানুষ জীবনসায়াহ্নে উপস্থিত হয়েছেন, নাম সুধাময়। সুধাময়, তার ছেলে, ছেলেবউ ও এক নাতনি নিয়ে এই বৃত্ত। এই তিন বৃত্ত যে তলের ওপর স্থাপিত তার নাম নগর বা শহর।    

প্রথম বৃত্তের বয়ান পরিচালক তৈরি করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিষাক্ত প্রেম’ গল্পটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে। মানিকের গল্পে সরলা যৌনকর্মী। তার সাথে সত্য মেশে চুরির উদ্দেশ্যেই এবং তাকে বিষও প্রয়োগ করে, কিন্তু মৃতপথযাত্রী সরলাকে ফেলে সে গয়নাগাটি নিয়ে সটকে পড়তে পারে না। মায়ার বাঁধন সত্যকে বিচলিত করে তোলে। চলচ্চিত্রেও তাই। সেখানে সরলা নামধারণ করে বিউটি। বিউটিকে সত্য ভালোবাসে সেটা বোঝা যায়। সেই ভালোবাসার টানেই সে অতিরিক্ত নেশাদ্রব্য খাইয়ে, চুরি করে পালানোর বদলে, বিউটিকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছোটে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সত্য। সত্য যখন কারাবন্দী, তখন নিষিদ্ধ মাদক সরবরাহের অপরাধে পুলিশ আটক করে চন্দনকে। এই চন্দনের কাছ থেকেই সত্য মাদক সংগ্রহ করে মিশিয়ে দিয়েছিল বিউটির মদে। সত্য ও চন্দনের এই সংযোগটি পরিচালকের নিজস্ব। 

একটি দৃশ্যে ঋত্বিক ও অপি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি গল্প ‘সুবালা’ও এই ছবির অনুপ্রেরণা। গল্পে সুবালার স্বামীর নাম থাকে হরেন। চলচ্চিত্রে হরেন হয়ে যায় চন্দন আর সুবালা হয়ে যায় সোমা। তবে পরিচালক ইন্দ্রনীল, মানিকের দুই গল্প থেকে অতিঅল্পই গ্রহণ করেছেন। বলা যায়, শুধু সম্পর্ক, বাসনা ও মায়ার টানই তার আগ্রহের জায়গা। মানিকের গল্পে হরেন নিজের বাচ্চা চুরি করে স্ত্রী সুবালার কাছ থেকে। সুবালার ভিক্ষাবৃত্তি তার সহ্য হয় না, কারণ সে নিজে কর্মবিমুখ হলেও স্ত্রীর অমর্যাদা সে সহ্য করতে পারে না। সন্তানকেও হরেন ভিক্ষায় বসাতে চায় না। তাই সন্তানকে চুরি করে ভিক্ষাবৃত্তি ঠেকাতে চায় হরেন। কিন্তু দুধের শিশুকে মাতৃস্তন্য দিতে তাকে ফিরতে হয় সুবালার কাছে। তখন অন্যের জিনিসপত্র চুরির দায়ে পুলিশ হরেনকে আটক করে। এই গল্পে অল্প করে হলেও স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি হরেনের একটা মায়া উঁকি দিয়ে যায়। 

চলচ্চিত্রে স্ত্রী সোমার অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ সহ্য হয় না চন্দনের। তাই একসময় শ্রমিক ইউনিয়ন করা চন্দন, স্ত্রীকে ঝিগিরি থেকে ছুটিয়ে আনতে বেছে নেয় অবৈধ পথ। উপার্জন বেশি হলে স্ত্রীকে আর ঘরের বাইরে বেরুতে হবে না, এমনটাই চিন্তা চন্দনের। বলা বাহুল্য নয়, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই চন্দন সেটা করে। তবে স্ত্রীকে সে ভালোও বাসে। সোমাও নিজের পরিবার, বিশেষ করে ছেলের পড়ালেখার কথা ভেবে ঝিয়ের কাজে যায়, ধনী পরিবারে। যেখানে বৃদ্ধ সুধাময়ের দেখভাল করতে হয় তাকে। তৃতীয় বৃত্তের এই কাহিনিটি পরিচালকের নিজের। 

এই তিন বৃত্তেই আমরা দেখব মানবিক সম্পর্ক, দায়বদ্ধতা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। সত্যের প্রতি বিউটির বিশ্বাস। আবার বিউটির প্রতি মাছের আড়ৎদার গণেশের ভালোবাসা। চন্দন, সন্তান ও পরিবারের প্রতি সোমার দায়বদ্ধতা। বৃদ্ধ শ্বশুর সুধাময়ের প্রতি ছেলেবউয়ের দায়িত্ববোধ। এসব মানবিক সম্পর্ক থেকে যা উদ্ভূত হয়, সেটাই মায়া। মায়ার জন্মালে তার খেসারতও দিতে হয়। এই মায়ার কারণেই অনেক সময় পরিত্যাজ্য জেনেও অনেক সম্পর্ক মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না, অস্বীকার করতে পারে না। কখনও আবার মায়া ত্যাগ করে ছেড়েও দিতে হয়। জগা মিত্তিরের পোষা গুণ্ডা সত্যের প্রতি বিশ্বাস ছিলো বিউটির। সত্য খারাপ ছেলে, কিন্তু তার সাথে কখনও কিছু করবে না, এই বিশ্বাস ছিলো বিউটির। কিন্তু এই বিশ্বাসের মূল্য বিউটিকে দিতে হয়, অলক্ষ্যে বিষ পান করে। মানে জানটাই জলাঞ্জলি দেওয়ার মতো দশা। সত্যই তার প্রাণ কেড়ে নেওয়ার আয়োজন করে, কিন্তু ছেড়ে যেতে পারে না। হাসপাতালে নিয়ে যায়। এটাই মায়া। ওদিকে, দায়িত্বজ্ঞানহীন চন্দনের ওপর ভরসা করে ঠকতে হয় সোমাকে। সোমা ভেবেছিল চন্দন নেশা ছেড়ে কাজে মন দিয়েছে, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ধারণা ভুল হয় সোমার। প্রতারিত হওয়ার পরও যে সোমা চন্দনের প্রতি করুণা অনুভব করে, সেটাই মায়া। তৃতীয় পরিবারে ছেলেবউ সুধাময়ের দেখভালের জন্য সোমাকে নিয়োগ করে। স্বামী চন্দন স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে দেখে কাজটি ছেড়ে দিতে চায় সোমা, কিন্তু সুধাময় তাকে বলে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে। এটা শুধু সোমার সিদ্ধান্ত ও সুধাময়ের পরামর্শ নয়, পারস্পরিক মায়াও বটে। 

এই তিন পরিবারের মানুষের ভেতর সম্পর্কের যে টানাপোড়েন: নির্ভরতা, আস্থা ও দায়িত্বশীলতার বিপরীতে বিশ্বাসভঙ্গ, অনাস্থা ও অস্বস্তি তৈরি হতে দেখি আমরা, সেটি যেন নগরে প্রতিদিন আমাদের ব্যবহৃত নানাবিধ দ্রব্যের উপযোগিতা গ্রহণের পর বর্জ্য তৈরির মতোই, উদ্বৃত্ত, জঞ্জাল। যা কুড়িয়ে নিয়ে যায় সেই ময়লা কুড়োনি মেয়েটা। যে মাছ ব্যবসায়ী, বিউটির বাঁধা বাবু গণেশের কাছ থেকেও অর্থভিক্ষা নেয় না। তার শহরের জঞ্জাল কুড়নোতেই আনন্দ। ময়লা কুড়োনি মেয়েটি যেন স্বয়ং শহর, সকল কলুষ শুষে নেওয়াই এই সত্তার কাজ। যেভাবে নগর নাগরিকদের সম্পর্কের উদ্বৃত্তগুলোকে হজম করে নেয়, ঠিক সেভাবে নগরের ময়লাকে সেই মেয়েটি ভরে নেয় নিজের বস্তায়। এই সত্তাকে সময়ের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। 

ইন্দ্রনীলের এই চলচ্চিত্রে শব্দ নিয়ে কিছু কাজ রয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। চন্দনকে যখন ভরসা করে সোমা ঝিয়ের কাজটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তখনই সে খবর পায় অপরাধ করে চন্দন কারাগারে। এই খবরটি নিজের কাছেই কেমন পরিহাসের মতো ঠেকে সোমার। সে বৃদ্ধ সুধাময়কে নিয়ে সকালবেলা গিয়েছিল খোলা মাঠে, যেখানে বয়স্ক মানুষরা তনুমন ঠিক রাখার জন্য হো-হো করে হাসে। চন্দনের কারাগারে যাওয়ার খবর সোমার ভরসা ও আস্থাই ব্যঙ্গ হয়ে ফিরে আসে, সশব্দে এসে আছড়ে পড়ে সোমার কানে। শব্দের মন্তাজ এখানে চমৎকার দ্যোতনা তৈরি করে। তবে কিছু জায়গা শব্দ নিয়ে আরও কাজ করার অবকাশ ছিলো। কোথাও কোথাও মোবাইল ফোনের আলাপন ঢেকে যায় আশপাশের শব্দে।

অভিনয়ের কথা বললে, সোমার চরিত্রে অপি করিম, চন্দনের চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী ও সুধাময়ের চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক কথায় অপূর্ব কাজ করেছেন। মনেই হয়নি তারা অভিনয় করছেন। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, তিনি বড়লোক বাড়ির গাড়িচালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, মুস্তাফিজ শাহীন। থিয়েটার করা ঢাকার শাহীন কলকাতার বলার ঢঙটি ভালোই রপ্ত করেছেন। কিন্তু কলকাতার গুণ্ডা সত্যের ভূমিকায় অভিনয় করা সোহেল রানার উচ্চারণ ঢাকাকে অতিক্রম করতে পারেনি। ঠিক একই কথা খাটে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিউটির বেলাতেও, বিউটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ। তার বোলচালে পূর্ববঙ্গের টান থাকাটাই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তার কণ্ঠে পশ্চিমবঙ্গের টানই ধরা পড়েছে। অবশ্য চলচ্চিত্রে বিউটি চরিত্রটি অনেক আগে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে এসেছে, কলকাতা এসে তার বাচনভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেছে ধরে নিলে আর সমস্যা থাকে না। এদের অভিনয় গড়পড়তা ঠেকেছে।

বিধান রিবেরু চলচ্চিত্রের শুরুর যে দৃশ্য, যেখানে আমরা জগা মিত্তিরকে খেতে দেখি এবং একজন দশাসই চেহারার লোক ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই দৃশ্যটি ভিন্নভাবে করা যেত বলে মনে হয়। লেকের ধারে, রোদের ভেতর টেবিল পেতে ওভাবে কেউ ভাত খায় কি না কে জানে! গোটা ছবিতে, এই দৃশ্যটি না থাকলেও খুব একটা সমস্যা হতো বলে মনে হয় না। শুধু গিমিক তৈরির জন্য দৃশ্যটির সংযোজন, এমনটাই মনে হয়েছে। ঠিক তেমনি সত্য যখন বিউটিকে পান উপহার দিতে যায়, তখন শীৎকারের শব্দও আরোপিত বলে মনে হয়। না হলেও চলতো। এরকমভাবে পরিচালক ছবির আরও কয়েকটি জায়গাকে যৌনগন্ধী করেছেন, সেগুলোর আদৌ প্রয়োজন ছিলো কি না তা ভেবে দেখার ফুরসত আছে। এসব বাদ দিলেও ছবির ভেতরকার মানবীয় সম্পর্কের রসায়ন বুঝতে দর্শকের কোনও সমস্যা হতো না।

ওই যে শুরুতে আলাপ তুলেছিলাম, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? বা মানুষ নিজে কি জানে এই জীবন নিয়ে সে কি করবে? জীবনের কাছে তার চাওয়া পাওয়া কতটুকু? এই হিসেব মেলানোর হাহাকার যেন শেষ হয় না। এই হাহাকারের আরেক নাম বাসনা। সত্যের বাসনা সে বড়লোক হবে। বিউটির বাসনা সে ফেলে আসা সংসার পাবে, অন্তত একটা ফ্ল্যাট, গণেশ বাবুর কাছে সে ওটাই চায়। গণেশ বাবুর ব্যবসা আছে, কিন্তু মাছের ব্যবসা, সে মাছের ব্যবসায়ী হতে চায়নি, অন্যকিছু হওয়ার বাসনা ছিলো তার ভেতর। চন্দনের বাসনা ছিলো শ্রমিকের অধিকার আদায়, কিন্তু সে নিজেই অকর্মণ্য, তারপরও সে চায় স্ত্রী সোমা ঘরে থাকুক, পুরুষতান্ত্রিক বাসনা। সোমা চায় সন্তান ভালো বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হোক। সে চায় স্বামী চন্দন দায়িত্বশীল হোক। সুধাময় জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অন্তত একটা কথা বলার লোক চায়। যে মানুষটির শয়নকক্ষে চার্লস চ্যাপলিন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, মহাশ্বেতা দেবী ও বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা, সেই মানুষটি নিঃসঙ্গতা চায় না, সে জীবনের বাকি সময়টা গল্প করে কাটিয়ে দিতে চায়। ছেলে, ছেলেবউ ও নাতনি সকলেই তো ভীষণ ব্যস্ত, এই নগরজীবনে, তার সাথে কথা বলার লোক কোথায়? এইসকল বাসনার চক্রই চলচ্চিত্রে স্থাপিত হয়েছে নগরের প্রেক্ষাপটে।

আরও একটি বিষয় নগরকে পেছনে রেখে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন, তা হলো সম্পদাকাঙ্ক্ষাজাত শ্রেণি বিভাজন। ধনী হতে চাওয়া সত্য যখন নিজের ভবনের বারান্দা থেকে নীচে ছিন্নমূল মানুষদের দেখে, তখন শ্রেণি বিভাজন যেমন স্পষ্ট হয়, নিম্নবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত, ঠিক তেমনি নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের ফারাকটা চোখে পড়ে নিজেদের একতলা, অকিঞ্চিৎকর বাড়ি থেকে সোমা যখন সুউচ্চ ভবনে ঝিগিরি করতে লিফটযোগে উপরের তলায় ওঠে। শ্রেণি সচেতনতার ইঙ্গিত পরিচালক দিয়ে দেন চন্দনের বরাত দিয়ে, তাকে তিনি শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং সেখানে দেয়ালে দেখা যায় টাঙানো রয়েছে মার্কস-লেনিনের ছবি। এই দৃশ্যটি বেখেয়ালে জুড়ে দেওয়া কোনও নিছক দৃশ্য নয়। চন্দনের মনোবেদনার এটাও বোধ করি একটা কারণ, যে বুর্জোয়াদের সে ঘৃণা করে এসেছে, তাদেরই ঘরে তার স্ত্রী শ্রম বিক্রি করে। কিন্তু সে ভালো করেই জানে, সে নিরুপায়। 

নগরের ভেতর শ্রেণি বৈষম্য, মানবিক সম্পর্কের তারতম্য ও দুর্গম্য বাসনার বয়ান নিয়েই তৈরি হয়েছে ইন্দ্রনীলের ‘মায়ার জঞ্জাল’ বা ইংরেজিতে ‘Debris of Desire’; এই নামের ভেতরেই এক ধরনের চাপা বেদনা আছে, যন্ত্রণার ছাপ আছে, পুষ্প ও কণ্টকের সম্পর্ক জারি আছে। মায়া ছাড়া মানুষ অচল, অথচ এই মায়াই পায়ে পায়ে শেকল হয়ে দাঁড়ায়। বাসনা ছাড়া মানুষ হয় না, পরিতাপের বিষয় বাসনা কখনও পূরণ হয় না। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, অথচ এই সমাজই আবার বিভাজিত। এসব বৈপরীত্য নিয়েই মানুষের জীবন। তবে ঐক্য-অনৈক্য, শুদ্ধ-অশুদ্ধ ও সুর-অসুরের ভেতরেও মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য থাকা বাঞ্ছনীয়, কী সেটা? বঙ্কিম বলছেন, “বস্তুতঃ সকল প্রকার মানসিক বৃত্তির সম্যক অনুশীলন, সম্পূর্ণ স্ফূর্তি ও যথোচিত উন্নতি ও বিশুদ্ধিই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য।” 

ছবির শেষে রাস্তায় পড়ে থাকা, ফেলে দেওয়া বোতলটি কুড়িয়ে রাস্তা জঞ্জালমুক্ত করার দৃশ্যটি বোধকরি জীবনের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত, সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়ে যায়। প্রযোজক জসীম আহমেদ ও নির্মাতা ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী

মায়ার জঞ্জাল
পরিচালক: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী
প্রযোজক: জসীম আহমেদ
চিত্রনাট্যকার: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ও সুগত সিনহা
অভিনয়ে: অপি করিম, ঋত্বিক চক্রবর্তী, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, সোহেল মণ্ডল, শাওলি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ

লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক; বিচারক, ফিপরেস্কি, কান চলচ্চিত্র ৭৫তম উৎসব

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

/এমএম/
সম্পর্কিত
কলকাতা ফিল্মফেয়ারে ঢাকাই অভিনেত্রীদের দাপট
কলকাতা ফিল্মফেয়ারে ঢাকাই অভিনেত্রীদের দাপট
ওয়েব সিরিজে মাহফুজ-অপি, আড়াই মিনিটে যা দেখা গেলো
ওয়েব সিরিজে মাহফুজ-অপি, আড়াই মিনিটে যা দেখা গেলো
এক মিনিটে ওয়েব সিরিজের মাহফুজ আহমেদ
এক মিনিটে ওয়েব সিরিজের মাহফুজ আহমেদ
‘প্রহেলিকা’র পর মাহফুজ আহমেদের ‘অদৃশ্য’ চমক
‘প্রহেলিকা’র পর মাহফুজ আহমেদের ‘অদৃশ্য’ চমক
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
কান উৎসব ২০২৪কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন