বিশ্ব চলচ্চিত্রের তীর্থস্থান বলা হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবকে। ৭৬ বছর ধরে ফ্রান্সের কানসৈকতে বসছে এই মহাযজ্ঞ। যেখানে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে বসে সর্বোচ্চ সিনেমেলা। গেল দুই দশক ধরে হলিউডের পাশাপাশি বলিউড তারকা-নির্মাতারা এতে অংশ নিয়ে বেশ নজর কাড়ছেন।
ফলে প্রতিবছরই বলিউডপ্রেমীদের নজর থাকে লালগালিচা হয়ে ভারতীয় প্যাভিলিয়নের দিকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার চতুর্থ দিন (১৯ মে) পর্যন্ত ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, সারা আলি খান, উর্বশি রাউতেলা, ম্রুনাল ঠাকুর, এশা গুপ্তা ও ডায়ানা পেন্টির দেখা মিলেছে। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দূত হিসেবে আলোকিত করছেন ৭৬তম কান উৎসব। মডেল হিসেবে কানে এলেও প্রত্যেকেই অংশ নিয়েছেন কানসৈকতের ভারতীয় প্যাভিলিয়নসহ বিভিন্ন স্টলে।
এরমধ্যে চার দিনের উৎসবে বাংলা ট্রিবিউন-এর ক্যামেরায় একেবারে ব্যতিক্রম হয়ে ধরা দিলেন বলিউডের অন্যতম সুন্দরী উর্বশি রাউতেলা। যিনি বাংলাদেশেও বেশ পরিচিত, কারণ ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশের স্বপন আহমেদ পরিচালিত ‘পরবাসিনী’ সিনেমায়।
অনেকটা সেই আবদারেই উৎসবের তৃতীয় দিন (১৮ মে) সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের লালগালিচা লাগোয়া সিঁড়ির মুখে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হয় রাউতেলার। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানাতেই বেগুনি রঙের গাঢ় লিপস্টিকে আঁকা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। যদিও তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, কানেও ফোন। এরমধ্যে পাপারাজ্জিদের শাটার চললো মিনিটখানেক।
সাধারণত, পালে দে ফেস্টিভ্যালের লালগালিচা দিয়ে হেঁটে ওপরে উঠে এই সিঁড়ি দিয়েই তারকারা নেমে চলে যান নিজ হোটেলে কিংবা প্যাভিলিয়ন কিংবা অন্য কোনও বৈঠকে। আর ফটক থেকে তারকাদের তুলে নেয় উৎসবের অফিসিয়াল ট্রান্সপোর্ট পার্টনার বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের ঝাঁ চকচকে লেটেস্ট মডেলের যেকোনও একটা গাড়ি।
বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সন্ধ্যায় অদ্ভুত সুন্দর এক লেহেঙ্গা আর কড়া মেকআপে লালগালিচা মাড়িয়ে মাত্রই উর্বশি নেমেছেন সিঁড়ি বেয়ে, উৎসবের বাইরে নির্দিষ্ট কোথাও যাওয়ার জন্য। কিন্তু ফটকে এসে ফটোগ্রাফারদের পেলেও পাচ্ছিলেন না তাকে বহন করার গাড়ি। ফলে ফটোগ্রাফার আর উৎসুক ফ্যানদের মাঝেই কানের রাস্তায় অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো উর্বশিকে। পালে ভবনের সিঁড়ির গোড়ায় এভাবে অন্তত ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তারকারাও লালগালিচা মাড়িয়ে এই পথে এসে চলেও গেছেন নিজ নিজ গন্তব্যে।
কিন্তু উর্বশি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন ডানে-বামে তাকিয়ে। এরমধ্যে তিনি গুনে গুনে তার এজেন্টকে ফোন করেছেন ২১ বার। প্রতিবারই নিচুস্বরে ধমকে যাচ্ছেন ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটিকে। উর্বশির একটাই প্রশ্ন, ‘হোয়্যার ইজ মাই কার?’ (আমার গাড়ি কোথায়)
এরমধ্যে সেই সিঁড়ির বেড়ি পেরিয়ে গাড়ি পার্কিংয়েও ছুটে গেছেন উর্বশি, তাকে বহনের জন্য নির্ধারিত বাহনের খোঁজে। পাননি, ফিরে এসে ফের দাঁড়িয়ে ছিলেন বেড়ির ভেতর।
এর মাঝে একটু আলাপ হলো ‘পরবাসিনী’র সঙ্গে। বললেন, ‘আই লাভ বাংলাদেশ। একটি ছবি করেছি সেখানে। সামনে আরও করার ইচ্ছে আছে।’
কথা বললেন বটে, তবে সেটি ছিলো রোবটের মতো। কারণ, তখনও তিনি তার মুঠোফোনটি ডায়াল করেই যাচ্ছেন।
আরও বিব্রতকর বিষয়– উর্বশির পর যে তারকারা একটু পরপর আসছিলেন, তাদের কাছেও রাইড শেয়ারিংয়ের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু উর্বশিকে কেউ সাঁয় দেননি। এমনকি উপস্থিত ফটোগ্রাফাররাও একটা সময় গুরুত্বহীন ভেবে ক্লিক বন্ধ করেছেন তাকে পেছনে ফেলে।
পালে ভবনের কোণে বলিউড সুন্দরীর এমন অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে এগিয়ে এলেন ইসরায়েলের এক নারী চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক। হেদভা নামের এই নারী মাতৃত্বসুলভ আচরণ করেন রুক্ষ গ্ল্যামারাস কিংবা অপমানে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উর্বশির প্রতি। এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘চলো আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
এই বলে হেদভা উর্বশির হাত ধরে পালে ভবনের কোণে সড়ক থেকে নেমে পড়েন রাস্তায়। যেখান দিয়ে লাইন ধরে আসা যাওয়া করছিল তারকাদের জন্য বরাদ্দ বিএমডব্লিউগুলো। চলতি পথে হেদভা অন্তত ৯টি গাড়ি থামালেন। উর্বশির পরিচয় ও পরিস্থিতি জানিয়ে লিফট দেওয়ার অনুরোধ করলেন, কিন্তু একজনও সেটিকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে মানলেন না।
অবশেষে পালে ভবন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেদভার হাত ধরে অসহায় হেঁটে গেলেন উর্বশি রাউতেলা। টানা ৪৫ মিনিটের এই অসহায় সময়ের পুরোটা সময় ফোন ডায়াল করে গেছেন উর্বশি, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে আশ্বাস মিললেও গাড়ির দেখা আর পেলেন না। অবশেষে পুরো পথটাই হেঁটে গেলেন বলিউডের এই নায়িকা। যার সবটুকু ধারণ করেছে বাংলা ট্রিবিউনের ছবিয়াল সুধাময় সরকার।
উর্বশি মাইলখানেক পথ হাঁটলেন বটে, তবে সারাক্ষণই তার কানে ছিল ফোন, কণ্ঠে ছিল ধমক আর চোখে ছিল নিজের পরনের লম্বা গাউনটির পেছনের দিকে। কারণ, হাঁটার ফলে তার গাউনের পেছনের ঝুলন্ত অংশটি ক্ষয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ! সেই ভেবে উর্বশির মন চিন চিন করছিল বটে!
মাইল অতিক্রম করে উর্বশি রাউতেলা জেব্রা ক্রসিং ধরে রাস্তার ওপারে যখন চলে গেলেন, তখনও তিনি হাঁটছিলেন। তার এই একা ও অসহায় পথচলা কোথায় শেষ হয়েছে সেটা অবশ্য জানা যায়নি। কারণ এরমধ্যে ৪৫ মিনিট পার।
তবে উর্বশি উৎসব এলাকা ছেড়ে রাস্তার ওপারে চলে যাওয়ার পর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তাকে সাহায্যকারী ইসরায়েলি গোটু ফিল্মসের প্রধান কর্তা হেদভার। তিনি বলেন, ‘দেখুন, উনি সত্যিই বিপদে পড়েছিলেন আজ। তার ছবি তোলার অনেক মানুষ ছিল বটে, কিন্তু হেল্প করার কেউ ছিল না। এজন্য আমি যেচে এগিয়ে যাই। এতটা পথ তার হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছি। মানুষ হিসেবে এটা আমার কর্তব্য ছিল। যদিও আমি তাকে চিনি না।’
এরপর হেদভা জানতে চাইলেন, উর্বশির নাম ও পরিচয়। জেনে, খুশিই হলেন। টুকে নিলেন উর্বশির নামের বানানটিও। সঙ্গে এটুকুও বলে গেলেন হেদভা, ‘ও এতটাই বিচলিত ছিল আজ, এরমধ্যে আসলে তোমাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার মুড ছিল না। মাইন্ড কোরো না।’
কথাটি বলে যাওয়ার কারণ, হেদভা ভেবেছেন ৪৫ মিনিট ধরে তাদের দুই জনকে ক্যামেরা তাক করে ফলো করার মানেই হচ্ছে ইন্টারভিউ প্রত্যাশা করা। ভুল ভাবেননি মানবিক এই ইসরায়েলি।
এদিকে একই দিন (১৮ মে) লালগালিচায় পা মাড়িয়েছেন ঐশ্বরিয়া রাই। যদিও গালিচার বাইরে তাকে আর দেখা যায়নি। উৎসবের প্রথম দিনই কান অভিষেক হলো সারা আলি খানের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন লালগালিচায় উঠেছেন এশা গুপ্তা, রাউতেলা, ম্রুনাল ঠাকুর। চতুর্থ দিন (১৯ মে) হেঁটেছেন ডায়ানা পেন্টি। ভারত থেকে আরও হাঁটার কথা রয়েছে সানি লিওনি, আনুশকা শর্মার।
এছাড়া রোজ দুপুর ও সন্ধ্যায় কান উৎসবের লালগালিচায় ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে নিয়ম করে। যাতে অংশ নেন বিশ্বের নামি মডেল, শিল্পী ও নির্মাতারা।
দক্ষিণ ফ্রান্সের কানসৈকতে ৭৬তম এই উৎসবের পর্দা নামবে ২৭ মে। সমাপনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হবে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর ২৭তম সিনেমা ‘এলেমেন্টাল’।
উর্বশি রাউতেলার ছবি তুলেছেন প্রতিবেদক