X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
স্মরণে মোস্তফা কামাল সৈয়দ

স্বপ্নে এসে ঠিকই বলবেন, ‘লাগাম টানেন’

বিনোদন ডেস্ক
৩১ মে ২০২০, ২১:৩৯আপডেট : ৩১ মে ২০২০, ২৩:০৫

টিভি ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ করোনাভাইরাসের কাছে পরাজয় মেনে নিলেন ৩১ মে দুপুরে। তার এই প্রস্থানে মিডিয়ায় নেমেছে শোকের ছায়া। বিটিভি থেকে এনটিভি, মোট পাঁচ দশকের সফল কর্মজীবন কাটিয়েছেন এই নন্দিতজন। পর্দার আড়ালের মানুষ হিসেবে তার অবদান আলাদা করে চোখে লাগার মতো। তাকে বলা হয় টিভি-মাধ্যমের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। যার আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে দেশের টিভি শিল্পে। সেসব ভেবেই স্মৃতিকাতর হলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং বর্তমানে চ্যানেল নাইন-এর অনুষ্ঠান প্রধান তানভীর খান। লিখেছেন, নিজের চোখে দেখা একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দকে নিয়ে— তানভীর খান ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ

কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তোলা আমার শেষ ছবি এটি। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, আমার ছোট বোনের বিয়েতে এসেছিলেন তিনি।

কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঠিক কবে হলো, এখন আর মনে নেই। তবে ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে আমি এনটিভি’তে জয়েন করি প্রোগ্রাম ডিপার্টমেন্টে, উনার আন্ডারে। প্রথমে ঠিক করতে পারছিলাম না কি ডাকবো উনাকে। কারণ, উনি ডেকে বললেন ‘আপনার বাবা আর আমি বন্ধু মানুষ।’ আমি তখন মনে মনে ঠিক করে নিলাম ‘কামাল চাচা’ বলবো। কিন্তু চাচা বলা হলো না, কামাল ভাই আরেকদিন ডেকে বললেন, ‘আপনি আমার কলিগ, আমরা একসাথে কাজ করবো। তাই এখানে চাচা-মামা ডাকবেন না, ভাই বলবেন।’
তারপর আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম, উনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন! আমি উনাকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করার জন্য। তিনি আমাকে সাসপেন্সে রেখে বললেন, ‘তুমি তো বলবোই না, তবে আপনি করে কেন বলি সেটা অন্য কোনোদিন বলবো।’
এরপর আমার যাত্রা শুরু উনার সঙ্গে। আমাকে কোনও কাজ দিতেন না। শুধু বলতেন, ‘প্ল্যান করেন’। এদিকে দিপু মাহমুদ আর আলমগীর হোসেন (আমার সঙ্গে জয়েন করা অপর ২ প্রযোজক) হরদম কাজ করে চলছেন। আমি ভাবলাম, কি ব্যাপার আমাকে উনি কাজ দেয় না কেন!
অবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারির বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শিল্প সাহিত্যে একুশ’ নামক একটা প্রোগ্রাম বানাতে বললেন। আমার তো মাথায় হাত, এত ভারি প্রোগ্রাম করবো কেমন করে! তারপর বললেন, বাজেট ৩ হাজার টাকা! উপস্থাপক একজন আর অতিথি দুজন। আমি বললাম সেট-ট্রলি-খাওয়া এগুলো...। উনি বললেন, ‘করেন আগে...।’ যাই হোক জোড়াতালি দিয়ে সেট বানিয়ে অনুষ্ঠান বানিয়ে ফেললাম। এরপর আমি হয়ে গেলাম ‘গরিব প্রডিউসার’ (মানে সব সস্তা বাজেটের প্রোগ্রাম আমাকে দিয়ে করাতো)।
এতকিছুর পরেও লোকটাকে আমার ভালো লাগার কোনও কারণই ছিল না। তবে খুব অবাক হয়ে দেখতাম, বড় বড় ডিরেক্টর-প্রডিউসার, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা এবং অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। এটা তখন আমার কাছে একটা বিস্ময়কর বিষয় ছিল।
তারপর ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ নামের ২টা রিয়ালিটি শো করে আমি তো আকাশে উঠে গেলাম (২০০৫-২০০৬)। তখন নিজেকে কি জানি ভাবতাম! জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় (অর্থ, পরিচিতি আর বিদেশ ভ্রমণের বিবেচনায়) কাটাচ্ছিলাম।
২০০৭ সালে উনি একদিন ডেকে বললেন, ‘আমি আপনাকে আপনি বলি কেন জানেন, কারণ আমি আপনার ভেতর একজন ভালো নির্মাতা আর অনুষ্ঠান প্রধানকে দেখতে পাই। তাই আপনাকে আপনি করে বলি।’ কথাগুলা আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল সেদিন।
সেদিনের পর থেকে উনি প্রতিদিন আমার রুমে এসে গল্প করতেন। একদিন এসে বললেন, ‘লাগাম টেনে ধরেন।’ যার অর্থ তখন বুঝিনি আমি। কিন্তু উনার গল্প করাটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। গল্পের ছলে উনি আমাকে আমার পারসোনালিটি বদলে দিলেন, আমি বুঝতে পারলাম না।
এরপর এনটিভি’তে আগুন, মালিকদের জেল, সুন্দরবন হোটেলে অফিস, মালিকানা জটিলতা এবং সর্বশেষ আমাকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। সবার দিকে তাকালেই তখন ভয় লাগতো। মনে হতো, এই লোকটি বোধহয় ষড়যন্ত্রকারী! সেই অবিশ্বাসের সময়ে কামাল ভাই আমাকে ছায়া দিয়েছিলেন বটগাছের মতো। ঠান্ডা থাকতে শিখিয়েছিলেন।
২০১১ সালে এনটিভি’কে বিদায়ের পালা। কামাল ভাই রুমে এসে আমার বাবার মতো হয়ে গেলেন। আমরা দুজনই আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। উনি একটা অনুরোধ করলেন আমাকে। বললেন, ‘আপনার ব্যবহার করা কম্পিউটারটা কি আমি নিতে পারি?’ উনি চাইলে তো তখনকার সবচেয়ে লেটেস্ট কম্পিউটারটা নিজের টেবিলে রাখতে পারতেন। কামাল ভাই কী চাইলেন এটা? উনি জানালেন, আমার ব্যবহার করাটাই তিনি নেবেন। আমি জানি, অফিস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উনার টেবিলে আমার সেই কম্পিউটারটি যত্নে ছিল।
২০০৪ থেকে ২০২০। আমি এখন অন্য চ্যানেলে কাজ করি। ঠিক উনার পদেই আছি।অনেক জ্বালিয়েছি মানুষটাকে। কারণে অকারণে ফোন দিয়েছি। উনি কথা বলতেন ঠিক যেন আমার বন্ধুর মতো। উনি আমাকে যেকোনও সমস্যার সমাধান দিতেন ঠিক আমার বাবার মতো। গত ৩/৪ বছর উনি উনার মতো কাজ করতে পারছিলেন না, সেটা বলতেন। আর কোথাও দেখা হলে আমাকে ধরে বলতেন, ‘বিগ ম্যান’।
আমার প্রতিটা কাজ উনি মনোযোগ দিয়ে দেখতেন।
আজ আপনি চলে গেলেন। আমার বটগাছটা মাথার ওপর থেকে সরে গেল। জানি, যেখানে গেছেন ওখান থেকেই দেখবেন আমাকে। স্বপ্নে এসে ঠিকই বলবেন, ‘লাগাম টানেন’।
কারণ, এই অধমকে ‘তানভীর খান’ বানানোর কারিগর তো আপনিই, একজন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। আপনিই যদি আমার লাগাম না ধরেন, কে আর রুখবে আমায়?

লেখক: অনুষ্ঠান প্রধান, চ্যানেল নাইন

করোনায় মারা গেলেন এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ

এই প্রথমবার উনি নাকে ঘষা দেননি!

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!