X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
মুখোমুখি

পিতৃপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, এটাই হলো মুশকিল: কবীর সুমন

মাহমুদ মানজুর
মাহমুদ মানজুর
২১ অক্টোবর ২০২২, ১০:২২আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৪

২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবরের পর আর ঢাকা-মুখো হননি কবীর সুমন। ঠিক ১৩ বছর পর প্রায় একই দিনে (১৩ অক্টোবর) ঢাকার মাটিতে পা রাখেন আধুনিক বাংলা গানের এই কিংবদন্তি। নেমেই মুখোমুখি হন প্রায় একই অভিজ্ঞতার। মানে নির্দিষ্ট স্থানে গান পরিবেশনায় বাধা! আগেরবার ছিল নাট্যকর্মীদের পক্ষ থেকে। এবার বাধা আসে পুলিশের তরফে। সেজন্য আগে থেকেই নির্ধারিত শাহবাগ জাদুঘরের হলরুম অনুমতি পায়নি এবার। পরে অবশ্য গাইবার অনুমতি মেলে শাহবাগের অদূরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে; ১৩ বছর আগেও যিনি শিল্পকলা থেকে বাধা পেয়ে গান শুনিয়েছিলেন এখানেই! এবার এখানে সুমন গান শুনিয়ে মুগ্ধতায় ভাসান ১৫ এবং ১৮ অক্টোবর। আজ (২১ অক্টোবর) একই স্থানে হচ্ছে সুমনের এই সফরের শেষ পরিবেশনা। তবে সুমনের শেষ সফরের সঙ্গে এবারের পার্থক্য একটাই- এবার তিনি মুখোমুখি হননি কোনও গণমাধ্যমের। যেমনটা খোলাবই হয়েছিলেন ১৩ বছর আগের ঢাকা সফরে, ইস্কাটনে সাংবাদিক শফিক রেহমানের নিরিবিলি বাসায়। সেই একান্ত ও প্রাণবন্ত আলাপের প্রায় পুরোটা তুলে ধরা হলো হুবহু; যা প্রকাশ হয়নি আগে।

১৩ বছর আগে সুমনের সঙ্গে সাংবাদিক জাহিদ আকবর, মাহমুদ মানজুর, শাহ আলম সাজু ও মনজুর কাদের জিয়া/ ছবি: মুজাহিদ সামিউল্লাহ মাহমুদ মানজুর: দেড় বছর পর আজ (১৫ অক্টোবর, ২০০৯) আবারও ঢাকার মঞ্চে গাইবেন। এর মাঝে খানিক ভুল বোঝাবুঝি অথবা অপ্রীতিকর ঘটনা জন্ম নিয়েছে। শিল্পকলা থেকে ভেন্যু পাল্টে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে স্থানান্তর হলো। এসব নিয়ে আপনি কি খানিক বিচলিত বা ক্ষুব্ধ?

কবীর সুমন: দেখুন বিচলিত কিংবা ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু হয়নি। হলেও আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চাই না। তবে এটুকু সত্যি, বিমান থেকে নেমে যখন গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন আমার সঙ্গে আমার সু-রসিক বন্ধুবর শফিক রেহমান ছিলেন, আরও ছিলেন আমার পুত্রতুল্য অনুষ্ঠান আয়োজক মীর আরিফ বিল্লাহ। গাড়িতে বসে জানতে পারলাম- বাংলাদেশের সুধীজনরা অনেকেই আমার কনসার্ট নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। শুনে আমি হিসাব মেলাতে পারিনি। সত্যি বলতে আমি কষ্টই পেলাম। বাড়ি ফিরে আমার স্ত্রী সাবিনা’র (কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন) সঙ্গেও ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করি। দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়ে আয়োজককে বললাম, যে করেই হোক সুধীজন এবং শিল্পকলার সম্মান রক্ষার্থে ভেন্যুটা পরিবর্তন করা হোক। কারণ আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমাকে এ দেশে আসার ভিসা দিয়েছেন বলে, একইভাবে কৃতজ্ঞ আমাকে গাইবার জন্য তিন মাস আগেই শিল্পকলা তার মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন বলে। ফলে আমি এও চাই না- এই দুটি পক্ষ আমার কারণে সুধীজনদের চাপের মুখে পড়ুক। গান-বাজনা নিয়ে বৈরিতা হোক এটা আমি মনেপ্রাণে চাই না।

মাহমুদ মানজুর: সংবাদ সম্মেলনে আপনি সাল উল্লেখ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে তহবিল সংগ্রহে পাশে ছিলেন। বিদেশেও একাধিক বাংলাদেশি সংগঠনের আমন্ত্রণে বিনে পয়সায় গান করেছেন। এসব বলার কারণ কি, আপনার ঋণের কথা ঢাকার সুধীজনদের মনে করিয়ে দেওয়া? যারা আপনার কনসার্টের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে?

কবীর সুমন: আমাকে মার্জনা করবেন। আমি মোটেও তেমন কিছু বলতে বা বোঝাতে চাইনি। এসব বলার কারণ ঢাকা’র সঙ্গে আমার স্মৃতিটুকু কিংবা ভালোবাসাগুলো প্রকাশ করা। এসব আমার সুখস্মৃতি। শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতেও আমি গান করে কখনও তেমন কোনও টাকা-পয়সা পাইনি। জীবনের অনেকটাই কেটে গেছে বিভিন্ন সংকটের জন্য গান করে। এখানে ঋণের বিষয় নয়, আমি নিজেই হয়তো এমনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তা না হলে বন্ধুবর আসাদুজ্জামান নূর অনুরোধ করলেই আমি কেন সিডর দুর্গতদের জন্য গিটার হাতে দাঁড়িয়ে যাবো? কেনই বা অস্ট্রেলিয়ার বঙ্গবন্ধু পরিষদের আমন্ত্রণে সাবিনাকে সঙ্গে নিয়ে উড়াল দেবো। এর সবই তো মনের টান। হ্যাঁ, এটা ঠিক যখন এসব জায়গা থেকে মাঝে মধ্যে একটু আধটু কষ্ট পাই তখন নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে।

মাহমুদ মানজুর: এক্ষেত্রে আপনি হয়তো একটু ভুল বার্তা পেয়েছেন। নাট্যকর্মীরা আপনার বিরোধিতা করছে না, তাদের বিরোধিতা নাটকের মঞ্চে বাণিজ্যিক কনসার্টের বিরুদ্ধে।

কবীর সুমন: সে যাই হোক না কেন। সুধীজনদের প্রতি আমার কোনও বিরোধ কিংবা ক্ষোভ নেই। এটা আগেও বলেছি। তাদের অথবা আপনাদের সবার মঙ্গলের জন্যই তো আজকের কনসার্টের ঠিকানা বদল করেছি।

মাহমুদ মানজুর: সুমন চট্টোপাধ্যায়। যিনি আধুনিক বাংলা গানকে পাল্টে দিয়েছেন এক ঝাপটায়। যে ধারাটি এখনও অব্যাহত রেখেছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন অগণিত মানুষকে। আপনি কি মনে করেন, গানের ভাষায় সেই ধার এবং ধারাটি অন্যদের মধ্য দিয়ে অব্যাহত রয়েছে এখনও?

কবীর সুমন: এখানে বলে রাখা ভালো, আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমার নাম কবীর সুমন। এ নামেই নির্বাচিত হয়েছি জনপ্রতিনিধি হিসেবে। এ নামেই ভারত সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করি। আমার পাসপোর্ট নামও কবীর সুমন।

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমন মাহমুদ মানজুর: মার্জনা করবেন। চট্টোপাধ্যায় হিসেবেই শিল্পী সুমনকে আমরা চিনেছি। ফলে কথায় কথায় ওই পদবীটি চলে আসে। গানের ধারা প্রসঙ্গে প্রশ্ন ছিল...

কবীর সুমন: এটা বুঝতে অনেক সময় লাগবে বন্ধু। চট করে বোঝা যায় না। গান তো হচ্ছে। এটা ভালো লাগার এবং না লাগার জিনিস। গান তো হয়, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ইদানীং আর সবকিছু শোনাও হয় না। আর একটা ঘটনা যখন ঘটে তার একটা বাজার তৈরি হয়। তখন অনেকেই আসেন তাদের গান নিয়ে ওই ধারাটিকে পুঁজি করে। কিন্তু তার আগে যে একটা সলতে পাকানো’র ব্যাপার থাকে মানে প্রস্তুতিটা, সবার কিন্তু সেটা থাকে না। উৎসাহের মাথায় সবাই চলে আসছে। এটা সব দেশে সবখানেই হয়েছে, হচ্ছে। আগামীতেও হবে। ফলে বেশিদিন টানা যায় না। একটা জায়গায় ঘুরতে থাকে সবাই। দুই বাংলাতেই দেখছি- গানটা একটা জায়গায় ঘুরছে। এটা একটা ভালো জিজ্ঞাসা আপনার। তবে সবকিছু সময়ই নির্ধারণ করবে কোন ধারাটি কখন কার মধ্য দিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকবে।

মাহমুদ মানজুর: একসঙ্গে দুটি প্রসঙ্গ। প্রথমটি বাংলাদেশের শিল্পী-কুশলী-সাংবাদিকদের ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তিতে খানিক হয়রানি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে এপারের টিভি চ্যানেল ওপারে ঝিরঝির...

কবীর সুমন: আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি। তবে এসব প্রসঙ্গে মন্তব্য করার আগে পরিষ্কার বলতে চাই, এখানে আমি লোকসভার সদস্য হিসেবে আসিনি। ফলে আমি ভারতের একজন সাধারণ নাগরিক এবং বাংলা গানের শিল্পী হিসেবেই যা বলার বলছি। প্রথম অভিযোগটি সম্পর্কে আমি খুব একটা পরিচিত নই। আমি প্রায়ই দেখি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন কনসার্ট ও নাট্যোৎসবে নিজেও অংশ নিই। আমার মনে হয় এটা তেমন কোনও বড় সমস্যা নয়। তবে বাংলাদেশের চ্যানেল সেখানে কেন দেখা যায় না, ভারতের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে দু’দেশের প্রতিই এমন প্রশ্ন আমারও। আমি টিভিকর্মী ছিলাম দীর্ঘকাল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আবার বলছি, সংসদ সদস্য হিসেবে বলছি না। আমি ভারতের নাগরিক হিসেবে বলছি। মনে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গে টিভি চ্যানেল অনেক পরে এসেছে। একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের বাড়িতে বিশেষ অ্যান্টেনা লাগানো হতো বিটিভি দেখার জন্য। বাংলাদেশের নাটকগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। অথচ এখন ঘটছে পুরো উল্টোটা। এটা দুঃখের।

মাহমুদ মানজুর: আপনি তো উদ্যোগ নিতে পারেন। এমপি হিসেবে না হলেও শিল্পী অথবা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে...

কবীর সুমন: হ্যাঁ, আমি শিল্পী হিসেবে এটা আলাপ করতেই পারি সেখানে। আমি একজন টিভিকর্মী হিসেবেও আলাপ করতে পারি। আমার ধারণা, কথার কথা বলছি- জিয়াউর রহমানের অসামান্য উদ্যোগ সার্ক-এর মাধ্যমে যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো প্রস্তাবনা তোলা যায়, তাহলে একটা সুফল হয়তো আসতে পারে। এছাড়া জোরালো কূটনৈতিক আলাপের মাধ্যমেও কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এ তাড়নাটা বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে থাকতে হবে।

মাহমুদ মানজুর: রাজনীতিতে নাকি গানে? ইদানীং কোনটাতে বেশি ব্যস্ত থাকেন?

কবীর সুমন: মনে রাখা দরকার, আমি শিল্পী থেকে রাজনীতিতে যাইনি, গণআন্দোলন থেকে গেছি। আমি গণআন্দোলনের লোক। আমার স্ব-ধর্ম সংগীত। এটা থেকে বিচ্যুত হতে পারবো না। এখনও প্রতি সকালে আমি গানটা রেয়াজ করি। লেখার চেষ্টা করি প্রায় প্রতিদিন।

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমন মাহমুদ মানজুর: কবীর সুমনের কাছ থেকে আমরা অনেক তীক্ষ্ণ গান পেয়েছি। সে তীক্ষ্ণতায় এখন কি একটু ভাটা পড়ছে? মার্জনা করবেন...

কবীর সুমন: আমার শেষ দুটো অ্যালবাম ‘নন্দীগ্রাম’ এবং ‘প্রতিরোধ’। দুটোই রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে এবং ভয়ঙ্কর চোখা চোখা জিনিস আছে এসব গানে। যেদিকে সব যাচ্ছে তাতে তীক্ষ্ণতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি হিসেবে বলুন আর গীতিকবি হিসেবে বলুন, তার প্রতিফলন তো গানে ঘটেই। এখন আপনার যদি মনে হয় আমি তীক্ষ্ণতা হারাচ্ছি, সেটা আপনি মনে করতেই পারেন।

মাহমুদ মানজুর: আপনার ইচ্ছের কথা শুনতে চাই। গান ও রাজনীতি নিয়ে।

কবীর সুমন: আমার ইচ্ছেতে তো আর সব হবে না! সত্যি বলছি গান-বাজনা করতে আর ভালো লাগে না। বয়স হয়েছে। তবুও করতে হয়। গানের ক্ষেত্রে ইদানীং বারবার মনে হয় যদি একটা নতুন ফর্ম পাওয়া যেতো, তাহলে বেশ হতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যায় না এই পরিবর্তনের জন্য। বিশেষ করে আমার খুব ইচ্ছে রাগসংগীত কিংবা বাংলা খেয়াল নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু ভাষাগুলো হবে আধুনিক, মানে ওই বাংলায় রাগপ্রধান গান মানেই তো পৌরাণিক কথা-বার্তা। সেসব বদলে আধুনিক লিরিক নিয়ে যদি কাজ করা যায় তাহলে বেশ হতো। যদি এমন করে ফর্ম ভাঙা যেত তাহলে খুব আনন্দ পেতাম। সেটা তো হচ্ছে না। কারণ হচ্ছে টাকাটা দেবে কে? পাশ্চাত্যে যেমন স্টেট অপেরা থাকে, সেসব রাষ্ট্র চালায়। আমাদের দেশে সেটা দুর্বল। শিল্পী-মিউজিশিয়ানদের দোষ দেওয়া যায় না। আবার সঠিক কাজটির জন্য সঠিক লোকও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই হলো অবস্থা। আবার ভাবছি ফিল্ম করতে পারলে হয়তো ভালো হতো। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করছি। টাকা পাওয়া মুশকিল। ফিল্ম হচ্ছে ফর্ম। এটা যদি করতে পারতাম খুব মজা পেতাম।

মাহমুদ মানজুর: আর রাজনীতি? মনে পড়ে ‘টেলিফোন লাইন’ শীর্ষক আপনার একটা গানের কথা। ঘুষের বিনিময়ে টেলিফোন লাইন পায়নি বলে ছেলেটি ক্ষোভে অপমানে আত্মহত্যা করে। এমন অসংখ্য ঘটনাকে ঘিরে আপনি অসংখ্য গান তৈরি করেছেন। মানুষের মনে জাগিয়েছেন প্রতিবাদ আর স্বপ্নের জাল। এখন এমপি হয়ে তার কতটা জবাব দিতে পারছেন? নাকি গানের কথা অডিও ফিতাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন?

কবীর সুমন: ধুর! আমি পাঁচ বছরের একজন সংসদ সদস্য। আমি পলিটিক্যাল লোক, পলিটিক্সের লোক নই। আমি হাইলি পলিটিক্যাল একটা মানুষ। কাজেই আপনি বলতে পারেন একটা মস্ত বড় আন্দোলন আমাকে ছুড়ে দিয়েছে একটা জায়গায়, মানে লোকসভার সদস্য হয়েছি। সবকিছু এত সহজে পাল্টানো যায় না।

মাহমুদ মানজুর: পুরনো রাষ্ট্র কাঠামো পাল্টানো যায় না- এটা যেমন ঠিক, আবার গানে গানে যে প্রতিবাদ আর প্রত্যাশা জুগিয়েছেন সেটারও তো একটা মূল্য থাকা চাই...

কবীর সুমন: দেখুন গ্রুন্টার গ্রাস একটা কথা বলেছেন- মানুষ আপস করে বাঁচে, কিন্তু কবিতা আপস চেনে না। আপনি যদি পলিটিক্সের কথা ভাবেন, এখানে আপস করতে হয়। পদ্য লিখতে হলে আপস করতে হচ্ছে না। যেমন ধরুন, আমার এক খালাকে আমি পছন্দই করি না। কিন্তু তিনি একটা কথা বললে আমাকে শুনতে হয়, মানতেও হয় মাঝে মধ্যে। খালা বলেও ডাকতে হয়। এটাই জীবন। কিন্তু শিল্প আপস জানে না। ফলে আপনি যে বলছেন টেলিফোন লাইনের জন্য আত্মহত্যা, এসব বিভিন্ন স্থান-সময় থেকে নেওয়া। পিট সিগার এটাকে বলতেন টপিক্যাল সং। এসব গানের মধ্য দিয়ে আপনার আমার মধ্যে যে দাবি তৈরি হয়, সেটা থেকে ফল আসবে- এমনটা আশা করতে নেই। আমি একটা উদাহরণ দিই, আগে ভাবতাম সংসদীয় গণতন্ত্র আমার পোষাবে না। মানে সরকারকে কবীর সুমনের খুব একটা দরকার নেই। সাবিনা ইয়াসমিনেরও দরকার নেই। সরকারকে আমার কিংবা আমার স্ত্রীর দরকার হয় পাসপোর্ট নবায়নের সময়। এর বাইরে দরকার নেই। যাদের জন্য সরকারের বড় বেশি দরকার তাদের পাশে সরকার সেই অর্থে কখনোই থাকে না, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে। 

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমন মাহমুদ মানজুর: আপনি গানে গানেও বলেছেন ‘সরকারের দরকার নেই’। আবার সেই সরকারের মধ্যেই এখন বাস করছেন! বিষয়টি...

কবীর সুমন: আমি সেখানটাতে আসছি। এবার আমি সংসদ সদস্য হিসেবেই বলছি। আমার যে এলাকা সেখানে প্রায় ৮০ লাখের ওপর মানুষ। তাদের প্রথম অভাব হলো পানি। পানি নেই, রাস্তা নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। একটা ডিপ টিউবওয়েল বসাতে গেলেও আমার পার্লামেন্ট দরকার হচ্ছে। এখন আমি যদি কবিতা গানে বিপ্লব করি আর বলি সংসদীয় গণতন্ত্র মানি না, তাহলে গণতন্ত্রওয়ালারা বলবে- মেনো না, যাও। আবার টিউবওয়েলটাও বসছে না। ফলে একটু সমঝোতারও দরকার আছে। সংসদীয় গণতন্ত্র না মানলে ভালো স্লোগান হবে, গান-কবিতা হবে, কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হবে না। অতীত এবং বর্তমান অভিজ্ঞতা থেকে এসব বলছি। বুঝতে পেরেছেন...।

মাহমুদ মানজুর: জি। প্রচলিত আছে বিপ্লবী থেকে ক্ষমতায় গেলে মত বদলে যায়। আপনি কি মনে করেন?

কবীর সুমন: এটা কিছুটা সত্য, কিছুটা সত্য নয়। সারা পৃথিবীতেই এমন অনেকে আছেন যারা একটি বিশেষ ব্যাংকে টাকা জমান, একটি বিশেষ ক্লাবের সদস্য হয়ে যান। আবার অনেকে আছেন কাজটাই করেন। এর মধ্যে লক্ষ্য শতভাগ থাকলে হয়তো শেষ করতে পারছেন মাত্র ৪৫ ভাগ। অর্থাৎ কম হলেও কাজটা তো হচ্ছে। কাজ তো কেউ না কেউ করছেনই। সবাই যে ক্ষমতায় গেলে রূপ বদলান সেটা তো বলা যাবে না। তা না হলে তো দেশগুলো চলতো না। অনেকে ফট করে বলে বাঙালি অলস। আরে ভাই! এই যে মাথার ওপর পাখাটা চলছে, এগুলো চলছে কী করে? চাঁদের লোক কিংবা আমেরিকার লোকেরা তো এসে ঘুরিয়ে দিচ্ছে না। বাঙালিরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিজলী জ্বালাচ্ছেন, পাখার বাতাস খাচ্ছেন অথচ গণআন্দোলনে দেশের জন্য গলা ফাটানো স্লোগান ধরছেন।

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমন

মাহমুদ মানজুর: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাই। সাম্প্রতিক সময়ে কী লিখছেন, কী পড়ছেন?

কবীর সুমন: ইচ্ছে হলো আর লিখে ফেললাম তা কিন্তু নয়। গান লেখাটা আবেগের বিষয় নয়। এটা হচ্ছে অনুশীলন। জীবনে এত লিখেছি, পুনরাবৃত্তি হয়ে যাবে এই ভেবে ইদানীং লিখতে ভয় হয়। তাই নিয়মিত লেখা হয় না। তবে লেখা উচিত। যেমন সবশেষ কথা-সুর সম্পন্ন করেছি ‘কতদিন আগেকার কথা’ শীর্ষক একটি গানের। যেটা আজ (শুক্রবার) মঞ্চে গাইবো। এছাড়া গানটা নিয়মিত করবার চেষ্টা করি শত ব্যস্ততার মাঝেও। আর ইদানীং বেশিরভাগ গানই গাইছেন আমার স্ত্রী। আর পড়ার কথা বললে বলবো, জনপ্রতিনিধি হিসেবে সারাদিন আইন প্রণয়নের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হচ্ছে। আইনের বই আর ইতিহাসের বই প্রচুর পড়তে হচ্ছে। ১২০ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৭৪৩ জন জনপ্রতিনিধির একজন হয়ে আইন প্রণয়নে দারুণ হিমশিম খাচ্ছি। তবুও এর মাঝখানে সাম্প্রতিক সময়ে বার্টন রাসেলের ‘ফ্যাক্ট এন ফিকশন’ নামের একটি পুরনো বই পড়ছি। আর বাংলা কবিতা আমার খুব একটা পড়া হয় না। কবিতার মধ্যে ঘুরেফিরে পাবলো নেরুদার ওপরেই ভর করি।

মাহমুদ মানজুর: আপনি আপনার গানের মধ্য দিয়ে যুগান্তরের পথে বেঁচে থাকবেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবুও সংগীতের দীর্ঘ জীবনে তেমন কোনও উত্তরসূরি আছে কি?

কবীর সুমন: আগেই বলেছি স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ইদানীং আমার সব গানই কণ্ঠে তুলছেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। এর বাইরেও আছে। বেঙ্গালুরুতে কতগুলো ছেলে আছে। ওরা পেশাদার না। কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা চিকিৎসক। ছেলেগুলো মহারসিক। এদের দু’একজন অনেক ভালো কাজ করছে। তবে পেশাদার না। মুশকিলটা এখানেই। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষা। যেমন আপনি বাংলার কীর্তন, বাংলার পল্লীগীতি সম্পূর্ণ এড়িয়ে বাংলা গানে থাকতে পারবেন না। বাংলার রামপ্রসাদী সুর, বাউল-পল্লীগীতি অনবদ্য। এসব রস যদি না নিতে পারি তাহলে বাংলা গান চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। পিতৃপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, এই প্রজন্মের বেলায় এটাই হলো বড় মুশকিল। অনেক তো বললাম কথা। এবার একটা সিগারেট খাওয়ার পাপ করতে পারি?

মাহমুদ মানজুর: অবশ্যই, কেন নয়! কিন্তু পাপ বলার হেতু কি?

কবীর সুমন: হেতু হচ্ছে এই, সারাদেশে সিগারেট বারণ! যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবে না, ধর্ষণও না, সিগারেট বন্ধ করলো। সিগারেট খেয়ে বউ ঠেঙ্গিয়েছে এমন কোনও উদাহরণ কোথাও আছে? কিন্তু খড়গটা নেমে এলো ওই সিগারেটের ওপর। যার কোনও মানে হয় না। ফলে লোকসভার সেন্টার হলে অনেক কষ্ট করে একটা ঘর পেয়েছি আমরা ক’জনে মিলে। সেখানে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে অঘোষিত স্মোকার্স রিপাবলিক গড়ে তুলেছি। হা হা হা... 

(মজার ছলে কথাগুলো বলতে বলতে সদালাপী কবীর সুমন সিগারেট হাতে কফির পেয়ালায় দীর্ঘ আয়েশি চুমুক দিলেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আহ!’)

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমন

** সাক্ষাৎকারটি ১৩ বছর আগে ১৪ অক্টোবর ২০০৯ সালে ইস্কাটন গার্ডেনে সাংবাদিক শফিক রেহমানের বাসায় বসে নেওয়া।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এমএম/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সুমনের গানের রেশ ধরে...
সুমনের গানের রেশ ধরে...
হাসপাতাল থেকে কবীর সুমন: চিন্তা করবেন না
হাসপাতাল থেকে কবীর সুমন: চিন্তা করবেন না
স্মৃতিকাতর গোলাম আলি, সুমনের খেয়াল
স্মরণে ওস্তাদ রশিদ খান স্মৃতিকাতর গোলাম আলি, সুমনের খেয়াল
জন্মদিনে কবীর সুমন: রাস্তায় গান গাইবো
জন্মদিনে কবীর সুমন: রাস্তায় গান গাইবো
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
শিল্পকলায় মঞ্চায়িত হলো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ‘হি-রোজ’
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…