বিলাসবহুল ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বিশাল সবুজ ট্রেন, এ যেন চলন্ত দুর্গ। এই ট্রেন দিয়েই রাশিয়া সফরে গেছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে করতে রাশিয়ায় পৌঁছান তিনি। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
২০১১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সাতবার আন্তর্জাতিক সফর করেছেন কিম। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেছেন দুইবার। এসব ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় হলুদ রঙের ট্রেন ব্যবহার করেছেন। এই ট্রেনটি তার খুব পছন্দের।
কেন ট্রেন?
২০১৮ সালে ট্রেনে বেইজিং সফর করেন কিম। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে হ্যানয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ট্রেন ভ্রমণ করেন তিনি। কিম বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখার করার জন্য ট্রেন ব্যবহার করেন।
এই ট্রেন পরিবার থেকেই পেয়েছেন। কিমের বাবা কিম জং ইল বেশিরভাগ সময়ে ট্রেনে যাতায়াত করতেন। কারণ আকাশ পথে বিমানে উঠা নিয়ে তার ভয় ছিল। তাই তিনি সাঁজোয়া ট্রেনে চীন ও রাশিয়ায় স্থলপথে সফরে যেতেন। আকাশ পথে ভ্রমণ করতে পারেন না বলেই বিদেশ সফর কম করতেন।
২০০১ সালে ইল একবার ট্রেনে পিয়ংইয়ং থেকে মস্কো গিয়েছিলেন। এই দুই স্থানের দূরত্ব ছিল ২০ হাজার কিলোমিটার। সেই সফরে তার প্রায় ২৪ দিন সময় লেগেছিল। উত্তর কোরিয়ার সরকারি বক্তব্য অনুসারে, কিম জং ইল ২০১১ সালে একটি সরকারি কাজে ট্রেন ভ্রমণে থাকার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এই ট্রেন কতটা নিরাপদ?
পিয়ংইয়ংয়ের একটি কারখানায় তৈরি প্রায় একই ধরনের আরও কয়েকটি ট্রেন আছে। কিম বিভিন্ন সফরে এই ট্রেনগুলো ব্যবহার করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার একীভূতকরণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এই ট্রেনের ডাক নাম হচ্ছে চলন্ত দুর্গ। এটির জানালা, দেয়াল ও মেঝে পুরোপুরি বুলেটপ্রুফ। শুধু তাই না, যে কোনও ভারি বিস্ফোরণেও এই ট্রেনের ক্ষতি করতে পারবে না। হঠাৎ কোনও আক্রমণ হলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র মজুদ আছে এই ট্রেনে। পালানোর জন্য হেলিকপ্টারও আছে।
কিমের ট্রেনের গতি কত?
এই ট্রেন ঘণ্টায় মাত্র ৫৫ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করে। কারণ এই ট্রেনের ভেতর ভারী অস্ত্র ও জিনিসপত্র রয়েছে। মূলত এই কারণে এর গতি কম। তাছাড়া এই ট্রেনে ৯০ টি বগি রয়েছে। সবগুলো বগিই ভারী সরঞ্জামে ভর্তি।
ফলে বলা যায়, চলন্ত দুর্গটি অত্যন্ত গীর গতি সম্পন্ন। একবার ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন কিম। ওই সফরে তার ৬৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। কিন্তু এত সময় লাগলেও ট্রেনের একটি সুবিধা আছে। কারণ তুলনামূলক অপ্রত্যাশিত আক্রমণ থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায়।
দক্ষিণ কোরীয় মন্ত্রণালয় বলেছে, যদি বিমান আক্রমণ হয় তাহলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু ট্রেনের যাত্রাপথ সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া আরও চ্যালেঞ্জিং।
এই ট্রেন কতটা বিলাসবহুল?
কিমের ট্রেন অনেক বিলাসবহুল। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, ট্রেনের ভেতর গোলাপি চামড়ার সোফা এবং মজবুত কাঠের আসবাব রয়েছে। বৈঠক করার জন্য রয়েছে দীর্ঘ একটি টেবিল।
ট্রেনটির সবচেয়ে ভালো বর্ণনা দিয়েছেন কনস্ট্যান্টিন পুলিকভস্কি। তিনি রুশ কর্মকর্তা ও কিমের বাবা কিম জং ইলের সঙ্গে ট্রেনটিতে সফর করেছিলেন। ‘ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ নামে একটি বইয়ে ইলের সঙ্গে রাশিয়ার ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করেছেন পুলিকভস্কি। ট্রেনের মধ্যে সরবরাহ করা খাবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন—রাশিয়ান, চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানি এবং ফরাসি যেকোনও খাবার সেখানে পাওয়া যেত। ট্রেনে বিনোদনের জন্য বেশকিছু তরুণ গায়িকা ছিলেন। যাদেরকে ‘লেডি কন্ডাক্টর’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিম কি কখনও বিমানে সফর করেছেন?
৩৯ বছর বয়সী কিম এখন পর্যন্ত সাত বার বিদেশ সফর করেছেন। তার মধ্যে চারবারই চীন সফর করেছেন। আর বাকী তিনবার রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর। শেষ দুটি সফর ছিল ট্রাম্পের সঙ্গে সম্মেলন।
কিম তার বাবার মতো বিমানে চড়তে ভয় পান না। তিনি তিনবার বিমান ভ্রমণ করেছেন। তার মধ্যে দুইবার চীনে ও একবার সিঙ্গাপুরে। সুইজারল্যান্ডে বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন কিম জং উন। সেখানে যেতে নিশ্চয়ই বিমানে চড়তে হয়েছিল।
২০১৮ সালের মে মাসে প্রথম আন্তর্জাতিক রুটে উড়েছিলেন কিম জং উন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে দালিয়ান শহরে গিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, এর আগে দেশের ভেতরে ব্যক্তিগত বিমানে চড়ে একাধিকবার ঘোরাঘুরি করেছেন তিনি।
২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অলিম্পিক আয়োজনে উচ্চপর্যায়ের ডেলিগেট হিসেবে বোন কিম ইয়ো জংকে নিয়ে বিমানে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তাকে ইউক্রেন নির্মিত আন্তোনোভ–১৪৮ বিমানও ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রচারিত তথ্যচিত্রে এমনটিই দেখানো হয়েছে।
২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত একটি ফুটেজে কিম জং উনকে দেশীয় নির্মিত একটি ছোট্ট বিমান চালাতে দেখা গেছে।