ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে একটি রাষ্ট্রেরই জন্ম হয়েছিল, তার নাম বাংলাদেশ। মাতৃভাষাকে কেড়ে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল পাকিস্তানের সরকার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকরা। তার সূত্র ধরেই একাত্তরে বাংলাদেশে স্বাধীনতা এসেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি প্রথম যিনি তুলেছিলেন সেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে খোদ বাংলাদেশেই সবাই ভুলতে বসেছেন। আর পশ্চিমবঙ্গে তাকে সেভাবে কেউ চেনেন না। কিন্তু এই অমর ভাষা সৈনিকের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আজও ছুটে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানি, বর্তমানে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক প্রবাসী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম।
কলকাতায় এবার তার উদ্যোগে হচ্ছে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে আলোচনাসভা। শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রথীন্দ্র মঞ্চে হবে বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎকে নিয়ে এই আলোচনা। এতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে মূল প্রবন্ধটি পাঠ করবেন নুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে থাকবেন শহীদের কনিষ্ঠ কন্যা মনিষা পুরকায়স্থ।
মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কংগ্রেস দলের টিকিটে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান তার এই দাবি নাকচ করে দেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর ‘এবডো’ প্রয়োাগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আবদুল করিমের নেতৃত্বে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।’
নুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাতৃভাষার দাবিতে আমরা একটা দেশ পেলাম। কিন্তু তার অন্যতম স্থপতিকে আমরা ভুলে গেলাম। তিনি যদি ওই দাবি না করতেন তাহলে আমাদের পরিচয় উর্দুভাষাভাষী হতো। আমি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেছি। আগরতলা ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছি। আমি এই দায়ভার এড়াতে পারি না। তাই বিশ্বজুড়ে প্রতিটি বাঙালির কাছে তার অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কলকাতাসহ ভারতের বাঙালিদের জানা উচিত কীভাবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো। আর এর মূলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদানের কথা। আমি দেখেছি বাংলাদেশের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ কলকাতার মানুষের। এই কলকাতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র ছিল। আমি কলকাতার মানুষের কাছে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাই এই আয়োজন। এটা বলতে পারেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা, বাংলাভাষার আন্দোলনের স্থপতি শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার ঋণশোধের সামান্য প্রচেষ্টা।’