X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

বিলাওয়াল ভুট্টোর ইউটার্নের নেপথ্যে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০১আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৩৪

১৯ জানুয়ারি, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের তিন সপ্তাহ পূর্বে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি)-এর চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। 

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার ছোট ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন)-এর সমালোচনা করে সাক্ষাৎকারে পিপিপি প্রধান বলেছিলেন, দলটির নীতি দেশটির অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সাক্ষাৎকারগ্রহিতা বিলাওয়ালের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর কোনও দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে পিপিপি কি পিএমএলএন-এর সঙ্গে জোট সরকার গঠনে রাজি হবে। জবাবে পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবারের ৩৫ বছর বয়সী তরুণ বংশধর খোলাখুলি জবাব দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, পিএমএলএন’র সঙ্গে পিপিপি জোট সরকার গঠন করবে, এমনটি আপনাকে কে বলেছে? আমি আগেও বলেছি: আমাকে প্রথমবার বোকা বানিয়েছেন, এ লজ্জা আপনার, দ্বিতীয়বার বোকা বানিয়েছেন, এ লজ্জা আমার।

চার সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বিলাওয়ালের বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি পিএমএলএনসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি একটি জোট সরকার গঠনে নেতাদের সম্মতির কথা ঘোষণা দিয়েছেন।

৮ ফেব্রুয়ারির ভোটের পাঁচ দিন পর জারদারি বলেন, ‘আল্লাহ সহায়, আমরা পাকিস্তানকে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করব।’ অতীতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে বিরোধিতা হয়। এটি ছিল নির্বাচনি বিরোধিতা, আদর্শগত বিরোধিতা নয়।’

নির্বাচনে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি ৯৩ আসনে জয়ী হয়েছে। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সরকারি সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দমনপীড়নের মধ্যেও দলটি সমর্থিত প্রার্থীরা এই জয় পেয়েছেন। এমনকি জানুয়ারিতে দলটিতে তাদের নির্বাচনি প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া হয়নি।

এরপরও নির্বাচনে দলটি দেশটির জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পিটিআইয়ের দাবি, বড় ধরনের কারচুপির মাধ্যমে ভোট চুরি করা না হলে তাদের দল আরও বেশি আসনে জয়ী হত।

পিএমএলএন ৭৫টি আসনে জয় পেয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা পিপিপি পেয়েছে ৫৪ আসন। ২০১৮ সালের তুলনায় পিপিপি এবার ১১টি আসন বেশি পেয়েছে। সব মিলিয়ে ১১টি দল আসন পেয়েছে, ছয়টি দল পেয়েছে একটি করে আসন। 

২৬৬টি আসনের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন হয় ১৩৪টি আসন। ফলাফলে স্পষ্ট কোনও দল এককভাবে সরকার গঠন পারবে না। 

পিপিপির একার পক্ষে জোটে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আসন নেই। কিন্তু তাদের হাতে যথেষ্ট সংখ্যক আসন রয়েছে যা দিয়ে তারা কিংমেকারের ভূমিকায় আসতে পারছে। পাকিস্তানে পরবর্তী সরকার কারা গঠন করবে তা নির্ধারণ করতে পারবে তারা।

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য ও সিনিয়র পিপিপি নেতা তাজ হায়দার বলেছেন, যে কারও সঙ্গে জোট গঠন করে দেশে স্থিতিশীলতা আনতে প্রস্তুত ছিল তার দল।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান এমন ভয়াবহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে থাকায় এই বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ সম্পর্কে অবগত আমরা। সরকার গঠনকারী যেকোনও দলকে সমর্থন জানাবে পিপিপি। পিএমএলএন আমাদের কাছে এসেছে, পিটিআই আসেনি। বস্তুত তারা আমাদের অপমান করে বলেছে, আমরা আপনাদের সঙ্গে বসব না।’

গত সপ্তাহে গঠিত ছয় দলীয় জোটটির নেতৃত্বে রয়েছে পিএমএলএন ও পিপিপি। ধারণা করা হচ্ছে পাকিস্তানে পরবর্তী সরকার তারাই গঠন করবে। তাদের রয়েছে ১৫০টির বেশি আসন। 

জোটের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নাম উঠে এসেছে শাহবাজ শরিফের নাম। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এই সরকার গঠনের ফলে পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এর পুনর্জন্ম ঘটবে। 

শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী করে পিডিএম জোট ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এর আগে ইমরান খানের পিটিআই সরকারকে পার্লামেন্টে আস্থাভোটে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল।

পিডিএম সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। মন্ত্রিসভায় পিপিপির আরও কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন। তাদের শাসনামলে পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বল হয়। ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়, লাখো মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছিলেন। 

এবার বিলাওয়াল বলেছেন, পিপিপি মন্ত্রিসভায় যোগ দেবে না। 

এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে পিপিপির ভাইস প্রেসিডেন্ট শেরি রেহমান বলেছেন, রাজনীতি সব সময় অন্যকে হারিয়ে জয়ী হওয়া নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি যারাই সরকার গঠন করুক না কেন তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, পার্লামেন্টে ও দেশে জনগণকে আশা দিতে চায় পিপিপি।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্দিষ্ট সুবিধা এড়িয়ে যাওয়া এবং তৃণমূলে কাজের সময় ও সুযোগের ব্যবহার জনগণকে দেখিয়ে দেবে যে, রাজনীতি শুধু পৃষ্ঠপোষকতা নয়, বরং ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও জলবায়ুর চাপে থাকা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসা।’

পিডিএম-এর এক সংবাদ সম্মেলনে পিএমএলএন নেতা শাহবাজ শরিফ। ফাইল ছবি: ইপিএ

তবে স্বাধীন বিশ্লেষকরা জোটে যোগদান নিয়ে পিপিপির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। 

লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক মেহমাল সরফ্রাজ বলেন, ‘কোনও দল, বিশেষ করে পিপিপির জন্য এটি কোনও আদর্শ পরিস্থিতি নয়। কোনও দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। একটি জোট সরকার একমাত্র সমাধান। পিপিপি বিদ্যমান ব্যবস্থায় থাকতে চায়।’

আরেক বিশ্লেষক মাজিদ নিজামি বলেছেন, মনে হচ্ছে, পিপিপি ভোটারদের কাছে জবাবদিহির মধ্যে না থেকে ক্ষমতাশীল পদে থাকার কৌশল ঘিরে এগোচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘তারা প্রেসিডেন্ট, সাধারণ পরিষদের স্পিকার, সিনেটের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রভাবশালী সাংবিধানিক পদ চাইছে। এসব পদে দলের নেতারা থাকায় জবাবদিহির মুখে না থেকেও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকবে।’ 

নিজামি আরও বলেছেন, পার্লামেন্টে যেকোনও বিল পাস করতে হলে পিপিপির সমর্থন প্রয়োজন হবে পিএমএলএন’র। ফলে পিপিপি সত্যিকার অর্থে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থাকবে। পিটিআইয়ের প্রতি পুনর্মিলনমূলক ভূমিকা নিতে পিএমএলএন পরামর্শ দেওয়ার জন্য পিপিপির এটি একটি ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি মনে করি না তারা পিএমএলএনকে বাদ দিয়ে জোট পাল্টাবে। 

মন্ত্রিসভার সদস্য না হওয়ার বিষয়ে পিপিপির হায়দার আরেকটি কারণের কথা তুলে ধরছেন। আর তা হলো অনেক পাকিস্তানি নাগরিকের কাছে ভোটের ফল নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। 

এরপরও নিজামি মনে করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক থাকলেও ছোট কয়েকটি দলকে নিয়ে নতুন পিপিপি-পিএমএলএন জোট যে পিডিএম-এর আরেকটি সংস্করণ তা এড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘পিটিআই ও কারাবন্দি নেতা ইমরান খান সব সময় অভিযোগ করে আসছেন এই দলগুলো সবসময় একে অপরকে সহযোগিতা করে। আবারও একই আখ্যানের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’ 

পাকিস্তানের রাজনীতিতে পিএমএলএন ও পিপিপির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ৯ বছর বাদ দিয়ে ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিল দল দুটি। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত পাকিস্তান ছিল সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করা পারভেজ মুশাররফের শাসনের অধীনে।

২০১৮ পাকিস্তানি সেনা কাঠামোর সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন পিটিআইয়ের ইমরান খান। তিনি বারবার বলেছেন, পিপিপি ও পিএমএলএন, কয়েক দশক ধরে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি কোনও অংশীদারিত্বে জড়াবেন না।

বেশ কয়েকটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন পিটিআই নেতা। তার দাবি, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ৮ ফেব্রুয়ারির ভোটে বিভক্ত জনরায়ের পরও ইমরান খান নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছে।

পিপিপি নেতা হায়দারের দাবি, এই দৃষ্টিভঙ্গি সহায়ক নয়। তিনি বলেন, ‘পিটিআই চাইলে নিজেদের সব দরজা বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু আমরা তা করব না। আমাদের দেশ যে সংকটের মুখে রয়েছে তা মোকাবিলার জন্য সব দলকে একটি মঞ্চে নিয়ে আসতে আমরা উদ্যোগ নেব। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। ঐক্যের জন্য যদি আমাদের এক পা পেছাতে হয়, তবে আমরা তা করব।’

সূত্র: আল জাজিরা

/এএ/
সম্পর্কিত
যুদ্ধবিরতির আলোচনা নস্যাৎ করছেন নেতানিয়াহু, অভিযোগ হামাসের
ইসরায়েলে বন্ধ আল জাজিরার সম্প্রচার
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
সর্বশেষ খবর
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী