আফগানিস্তানে নারীদের জন্য মেডিক্যালে পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বুধবার (৪ ডিসেম্বর) তালেবান নেতাদের তাদের সাম্প্রতিক নির্দেশ আরোপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম অয়েস অব আমেরিকা এই খবর জানিয়েছে।
জাতিসংঘ ছাড়াও তালেবানকে এই নির্দেশ প্রত্যাহারের জন্য সম্মিলিতভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন অনেকেই।
সমালোচকরা বলছেন, ওই নির্দেশের ফলে আফগান নারী ও মেয়েদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অবশিষ্ট সুযোগ থেকে কার্যত বঞ্চিত করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহযোগিতা মিশন (ইউএনএএমএ) এক বিবৃতিতে সতর্ক করেছে, ‘খবরে প্রকাশিত নির্দেশটি প্রয়োগ করা হলে তা হবে নারী ও মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার অধিকারের ওপর আরও বিধিনিষেদের আরোপ।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবরে ইউএনএএমএ ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’। এ বিষয়টি সরকারি তালেবান চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে যাচাই করে দেখছে তারা। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে এমন কোনও সংবাদ এখনও পায়নি সংস্থাটি।
প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনও প্রকার আলোচনা করা নিষিদ্ধ জানিয়ে নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ভয়েস অব আমেরিকাকে জানিয়েছেন, তালেবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুনজাদার জারি করা এই নির্দেশ মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এর একদিন আগে, কাবুলে এক বৈঠকে মেডিক্যাল কলেজগুলোর প্রধানদের এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এই নির্দেশনার খবর বা আফগান রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সোমবারের বৈঠক নিয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেননি সেখানকার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিবান কর্মকর্তারা।
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, এই নির্দেশ আফগান স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র এই দেশটির ওপর ‘ক্ষতিকর প্রভাব’ ফেলতে পারে।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘ইউএনএএমএ বর্তমান কর্তৃপক্ষকে বলছে, গোটা দেশজুড়ে আফগান নারী ও মেয়েদের জীবনে এই নির্দেশের যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সে পরিপ্রেক্ষিতে এটি আরোপের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হোক।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দেশজুড়ে ৩০ হাজারেরও বেশি নারী ও মেয়ে আফগান মেডিকাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হয়েছিল। তাদের অনেকেরই মঙ্গলবার পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। এরইমধ্যে হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। যে সব নারী ধাত্রী ও নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তাদেরকে ক্লাসে ফিরে আসতে নিষেধ করা হয়।
মানবাধিকার কর্মীরা সতর্ক করে বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ধাত্রী ও নারী নার্সসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে লক্ষ লক্ষ নারী বঞ্চিত হবেন। কেননা, আফগান সমাজে তালেবান বহু প্রদেশেই পুরুষ চিকিৎসকদের নারীর চিকিৎসা করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এক বিবৃতিতে হিউমান রাইটস ওয়াচ সতর্ক করেছে, বিতর্কিত এই নির্দেশের কারণে নতুন নারী চিকিৎসাকর্মীর প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিলে ‘এর ফলাফল হবে বিনা কারণে নারীদের কষ্ট, দুঃখ,অসুস্থতা ও মৃত্যু। কেননা, তাদের চিকিৎসার জন্য কোনও নারী চিকিৎসা কর্মী থাকবেন না।’
একজন পদস্থ আফগান কর্মকর্তার বরাতে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, তিনি সতর্ক করেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী হলে দেশটি এত বড় একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে যা তালেবান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিষয়টির সংবেদনশীলতার জন্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নারীদের স্টাফ হিসেবে প্রশিক্ষণ না দিলে, দূর্গম এলাকাগুলোতে নারী ও শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।’
এই নিষেধাজ্ঞার খবরে মানবিক সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কায় জনগণের দূর্দশা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘কঠিন উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে।
বুধবার এক বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, ‘এই সিদ্ধান্তটি বিস্ময়করভাবে আরও একবার মৌলিক মানবাধিকার লংঘন ও আফগানিস্তানে নারীর শিক্ষালাভের ওপর অযৌক্তক আক্রমণ।’
বিবৃতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলে, ‘আমরা তালেবানকে এই বৈষম্যমূলক নীতি পাল্টানোর ও আফগানিদের জন্য শিক্ষা ও মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুযোগসহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও ত্রাণ গোষ্ঠীগুলো বলছে, হিবাতুল্লাহর জারি করা কয়েক ডজন নির্দেশ সেদেশে নারীদের কাজ ও শিক্ষা থেকে কঠিনভাবে বঞ্চিত করছে। দেশটি ইতোমধ্যেই বহু বছরের যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যতম মারাত্মক এক মানবিক সংকটের সম্মুখীন।
কাবুলের বর্তমান সরকার, যেটিকে কোনও দেশই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের নীতিকে শরিয়া যা ইসলামি আইনের সঙ্গে সামঞ্জন্যপূর্ণ বলে যুক্তি দেয়। সরকারের সমালোচনাকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে নাকচ করে দিয়েছে তারা।