ব্রিটিশ রাজনীতিতে চমক জাগানিয়া এক পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে ইউগভ। তাদের প্রকাশিত এই সমীক্ষা নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যদি এখন সাধারণ নির্বাচন হয়, তাহলে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম ইউকে দলই পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি আসনে জিততে পারে। জরিপে হাউজ অব কমন্সের ৬২৫টির মধ্যে ২৭১টি আসনে দলটির বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে। যা লেবার পার্টির অনুমানকৃত ১৭৮টি আসনের চেয়ে অনেক বেশি এবং কনজারভেটিভদের (৪৬ আসন) তুলনায় প্রায় ছয় গুণ।
এই নাটকীয় পূর্বাভাস শুধু রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিতই দেয় না, বরং এটি লন্ডনের বহুজাতিক, অভিবাসীপ্রধান সমাজের মধ্যেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ও মুসলিম ভোটারদের জন্য এটি এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে এসেছে।
চার ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এমপির অবস্থান ঝুঁকিতে
বর্তমানে লন্ডন থেকে লেবার পার্টির টিকিটে নির্বাচিত চারজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী এমপি রয়েছেন। তারা হলেন, রুশনারা আলী (বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো), আপসানা বেগম (পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজ), রূপা হক (ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন) এবং টিউলিপ সিদ্দিক (হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট)। তাদের নির্বাচনি এলাকা ঐতিহাসিকভাবে লেবার পার্টির ঘাঁটি হলেও ইউগভের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস বলছে, নতুন শক্তি হিসেবে রিফর্ম ইউকের উত্থানে এসব আসনেও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে মোট ৬ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫ জন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বাস করেন। যাদের অর্ধেকের বেশি বৃহত্তর লন্ডনের বাসিন্দা। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এলাকাতেই বাংলাদেশিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এই বিপুল ভোটব্যাংকের ওপর নির্ভর করে এতদিন ধরে টিকে ছিল লেবার পার্টি। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই নির্ভরতা আর নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।
আপসানা বেগমের হুইপ প্রত্যাহার ও দলীয় সংকট
সম্প্রতি লেবার এমপি আপসানা বেগম সংসদে একটি বিতর্কিত সংশোধনীতে ভোট দেওয়ার কারণে দল থেকে হুইপ হারিয়েছেন। তিনি শিশু ভাতা সংক্রান্ত বিতর্কে নিজের বিবেকের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে। এটি তার ভবিষ্যৎ মনোনয়নকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যদি তিনি দলীয় মনোনয়ন না পান, তবে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। যার ফলে লেবার ভোট ভাগাভাগি হতে পারে।
পূর্ব লন্ডনে অতীতে বহুবার দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশি প্রার্থীরা একই আসনে দাঁড়িয়ে লেবার বা প্রগতিশীল ভোট ভাগ করে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে রিফর্ম ইউকের মতো দলের জন্য দরজা খুলে যেতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও রিফর্ম ইউকের কৌশল
গাজায় যুদ্ধ, ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং অভিবাসন বিষয়ক প্রশ্নে লেবার ও কনজারভেটিভ উভয় দলকেই অনেক মুসলিম ভোটার বিরূপভাবে দেখছেন। পূর্ব লন্ডনের স্থানীয় নির্বাচনে সম্প্রতি একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাফল্য পেয়েছেন, যারা ওই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন।
এ প্রেক্ষাপটে রিফর্ম ইউকে নতুন কৌশল নিয়েছে। তারা এখন এমন মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় পটভূমির প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবছে, যারা অভিবাসী জনগোষ্ঠীর হতাশাকে কাজে লাগাতে পারবেন। দলের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে মুসলিম রাজনীতিক জিয়া ইউসুফের নিয়োগ ছিল সেই কৌশলেরই অংশ। ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ব লন্ডনের মতো নির্বাচনি এলাকাগুলোতে রিফর্ম ইউকে এবার ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বা মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করিয়ে আরও বিস্তৃত সমর্থন খুঁজবে।
অভিবাসন ইস্যুতে রিফর্ম ইউকের কঠোর অবস্থান
রিফর্ম ইউকে অভিবাসন সীমিতকরণের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা ‘নেট জিরো অভিবাসন’ নীতি চালুর কথা বলছে। এর অর্থ হচ্ছে আগত ও প্রস্থান করা অভিবাসীর সংখ্যা সমান রাখতে হবে। এতে দক্ষ কর্মী ভিসা, পরিবার পুনর্মিলন এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রদের প্রবেশে কঠোরতা আসবে।
এমন নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগত সম্প্রদায়গুলো। ২০২৩ সালে লন্ডনে নিট অভিবাসনের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার। এদের একটি বড় অংশ এসেছেন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়া থেকে। রিফর্ম ইউকের নীতিতে এই প্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যেতে পারে।
এছাড়া দলটি নাগরিকত্বের যোগ্যতা অর্জনের সময়সীমা ৫ বছর থেকে ১০ বছরে বাড়াতে চায় এবং নতুন অভিবাসীদের পাঁচ বছর চাকরি না করলে কোনও প্রকার সামাজিক ভাতা না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ফলে ব্রিটিশ বাংলাদেশি ও অন্যান্য বিএএমই সম্প্রদায়ের জন্য বসবাসের ব্যয় এবং চাপ অনেক বেড়ে যাবে।
সরকারি সেবায় কাটছাঁট ও এর প্রভাব
রিফর্ম ইউকে দাবি করছে তারা ‘অপচয় কমাবে’ এবং সরকারি সেবাগুলোতে ‘বড় আকারে হ্রাস’ চালু করবে। কিন্তু যেসব সম্প্রদায় সমাজকল্যাণ নির্ভরতার মধ্যে আছে, যেমন বাংলাদেশি ও অন্যান্য অভিবাসী জনগোষ্ঠী, তাদের জন্য এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় বাংলাদেশিদের দারিদ্র্যের হার বেশি এবং কর্মসংস্থান কম। ফলে যেকোনও ধরনের কল্যাণ সেবার হ্রাস সরাসরি তাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে।
সামনে কী আছে?
রিফর্ম ইউকের উত্থান শুধু ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নয়, বরং ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্যও এক গভীর প্রতিচিন্তার সময় নিয়ে এসেছে। ঐতিহাসিকভাবে যেসব এলাকা লেবার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাই এখন দ্বিধায় আছেন। একই সঙ্গে, নতুন রাজনৈতিক দল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে জাতিগত, অভিবাসী ও মুসলিম ভোটারদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্ককে। রিফর্ম ইউকের উত্থানের পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়, তবে তা কেবল দলবদল নয়, বরং ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর আমূল রূপান্তরের ইঙ্গিতও হতে পারে।
২০২৫ হোক কিংবা আরও পরে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন শুধু ব্রিটেনের সরকার পরিবর্তনের বিষয় নয়, এটি হয়ে উঠতে পারে ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিচয়ের পুনঃলিখনের সূচনাবিন্দু। বিশেষ করে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের জন্য এটি হবে নিজেদের অবস্থান নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার নির্বাচন।