কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধের ইতিহাস নানাভাবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী জেরুজালেমকে শুধু ইসরায়েলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির ঘোষণার পর তা নতুন করে বিশ্বের সামনে চলে এসেছে। তৃতীয় ইন্তিফাদার (প্রতিরোধ যুদ্ধ) ডাকে ফিলিস্তিনজুড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। চলছে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের লড়াই। তিন সপ্তাহে চলা এই প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে তিনটি ছবি ফিলিস্তিনি জনগণের আন্দোলনের প্রতীক হয়ে সামনে চলে এসেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে তৃতীয় ইন্তিফাদার ডাক দেয় হামাস। প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান আন্দোলনের মধ্যে হেবরন, গাজা ও রামাল্লার কাছের নাবি সালেহ গ্রাম থেকে তোলা তিনটি ছবি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ছবি তিনটির প্রধান তিন ব্যক্তির দুই জন এখন ইসরায়েলি কারাগারে। অন্যজনকে ইসারায়েলি স্নাইপার মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে।
প্রথম ছবিতে দেখা যায়, হেবরনে চলা আন্দোলনের সময় একটি ১৬ বছরের কিশোরকে ঘিরে রেখেছে প্রায় ২০ জনের মতো ইসরায়েলি সেনা। কিশোরটির হাত ও চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফাওজি আল জুনায়েদি নামের ওই কিশোরের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাদের উপর পাথর ছোড়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আন্দোলন শুরুর প্রথমদিকেই তাকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়।
আন্দোলন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে আরেকটি ছবি অনলাইনে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছবিটির প্রধান বিষয় ২০০৮ সালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় দুই পা ও একটি কিডনি হারানো ৩০ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু থুরাইয়াহ। জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার পর আন্দোলন করায় গত ১৫ ডিসেম্বর ইসরায়েলি বাহিনী স্নাইপাররা তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ছবিতে দেখা যায়– তিনি একটি হুইল চেয়ারে বসে এক হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে ধরে স্লোগান দিচ্ছেন। কার্টুনিস্টরা তাৎক্ষণিকভাবে ছবিটিকে ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। আবু থুরাইয়াহ পাখায় ভর করে স্বর্গে উড়ে যাচ্ছেন এমন ছবি এঁকেছেন তারা।
ব্রাজিলিয়ান কার্টুনিস্ট কার্লোস লাত্তুফ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ৭১ হাজার ফলোয়ারের মধ্যে ছবিটি ছড়িয়ে দেন। নিজের আঁকা ফিলিস্তিনের নতুন প্রতীকের ছবিটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এর অল্পদিনের মধ্যেই আরেকটি ছবিতে সবার নজর কেড়েছে। ওই ছবিটি ছিল ১৬ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোরী আহিদ তামিমি। এক আত্মীয়ের মাথায় রাবার বুলেটের আঘাতের পর ইসরায়েলি বাহিনী তাদের বাড়ি তছনছ করছিল। ওই সময় তামিমি ইসরায়েলি সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন। তিনি চিৎকার করে সেনাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তখন ইসরায়েলি সেনারা কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পুরো ঘটনাটি মোবাইলে ধারণ করা হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর তাদের প্রতিক্রিয়া না দেখানোকেই ইসরায়েলের জন্য অপমানজনক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর খবরটি প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রধান খবর হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। পরে ১৯ ডিসেম্বর সকালেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারে বাধা দেওয়ায় তার মাকেও আটক করা হয়। এ ঘটনার পর তামিমি বীর হিসেবে অভিহিত হচ্ছেন। তার ছবি নিয়েও কার্টুন এবং আরবি ও ইংরেজি ভাষায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও তৈরি হয়েছে। জর্ডানের প্রিন্স আলি বিন হুসেইন পর্যন্ত এই ফিলিস্তিনি কিশোরীর প্রশংসা করে টুইটারে ছবি প্রকাশ করেছেন।
এর মধ্যে তামিমির মুক্তির দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিন। সামাজিক মাধ্যমে মুক্তির দাবিতে শুরু হয়েছে দুটি হ্যাশট্যাগ।
জেরুজালেম নিয়ে মার্কিন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি বৈঠকের মন্তব্যে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল মালিকিও ছবি তিনটিকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বৃহস্পতিবারের ওই বৈঠকে মালিকি বলেন, দেশের জন্য আমাদের জনগণের দৃঢ়তা কিংবদন্তিতুল্য। মুক্তি ও অখণ্ডতার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা বৈধ। তাদের নিরাপত্তা ও সন্তানদের জন্য উন্নত জীবনের আশা প্রতিদিনই নতুনভাবে উজ্জীবিত হচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েলি হামলা তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।
ট্রাম্পের স্বীকৃতির পর এই তিনটি ছবি সম্পর্কে মালিকি জানান, নিরস্ত্র এক কিশোরকে পুরো সেনা ব্যাটিলিয়নের ঘিরে রেখেছে, গুলি করে পঙ্গু ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং এক সাহসী তরুণীকে বাড়ি থেকে অপহরণ করার অভিযোগ করেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
এর আগে দুইটি বড় ধরনের ইন্তিফাদার ডাক দিয়েছিল ফিলিস্তিন। প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তখন এটি ছিল মূলত একটি অসহযোগ আন্দোলন ও গেরিলা প্রতিরোধ। প্রথম ইন্তিফাদা চলাকালে শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বহু মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন হাজার হাজার মানুষ। প্রথম ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনিরা ব্যবহৃত টায়ার থেকে নেওয়া রবারের চাকতিতে একটি লোহার পেরেক ঢুকিয়ে এক ধরনের টায়ার ছিদ্রকারী যন্ত্র উদ্ভাবন করে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর প্রধান সড়কগুলোতে এ যন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
আর সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন কয়েক হাজার সেনা নিয়ে জেরুজালেমের পুরনো শহর (ওল্ড সিটি) এবং মসজিদুল আকসা ভ্রমণ করতে গেলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। ২০০০ সালে শুরু হয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকে।
মূলত ইন্তিফাদার মাধ্যমেই প্রতিবেশী কোনও আরব দেশের সহায়তা ছাড়া দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হন ফিলিস্তিনিরা। ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, হত্যাযজ্ঞের মুখেও তারা প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আলোচিত ছবি
ফিলিস্তিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়ও এমন কিছু ছবি মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রথম ইন্তিফাদায় সবচেয়ে আলোচিত ছবি তোলেন একটি আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কের একজন ক্যামেরাপারসন। এতে দেখা যায়, কথিত পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের শরীরের বিভিন্ন হাড় ভেঙে দিচ্ছে। ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়েতজাক রাবিনের নির্দেশে ফিলিস্তিনিদের শরীরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। ইসরায়েলি ক্যামেরাপারসন মোসি আলপার্ট ওই ছবি তোলেন।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি বিষয় ছিল ১২ বছরের বালক মোহাম্মদ আল দুররাহ। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে তাৎক্ষণিক তার মৃত্যু হয়। ওই সময় সন্তানকে বাঁচাতে তার বাবা শরীর দিয়ে আড়াল করে রক্ষার চেষ্টা করেন। ফ্রেঞ্চ সংবাদমাধ্যমের কর্মী তালাল আবু রাহমেহ এই ছবিটি তোলেন।
তালাল আবু রাহমেহ আল মনিটর নিউজকে বলেন, তার ফ্রেঞ্চ নিয়োগকর্তা আল দুররাহর ভিডিওটির সম্পাদনা ছাড়াই ইউটিউবে ছড়িয়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধেই উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে তোলেন। দুররাহর ভিডিওটি মানুষ গ্রহণ করেছিল কারণ এতে মানুষের আবেগকে তুলে ধরা হয়েছিল। তিনি বলেন, এটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আর যেই এটা দেখুক তার মধ্যেই বাবা হিসেবে নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার বাস্তব আবেগ জেগে উঠেছে। সূত্র: আল-জাজিরা।