যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল গোপনে আলোচনা করছে গাজা ভূখণ্ডে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সাময়িক প্রশাসন গঠনের বিষয়ে। এমনটাই জানিয়েছেন বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও অবগত পাঁচ ব্যক্তি। তারা বলেছেন, আলোচনাটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, ইরাক যুদ্ধের পর এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সামরিক-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হতে পারে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এমন একটি প্রস্তাব, যেখানে একজন মার্কিন কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী প্রশাসন গাজা পরিচালনা করবে। গাজা নিরস্ত্রীকরণ ও স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসা এবং একটি টেকসই ফিলিস্তিনি প্রশাসনের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত এটি কাজ করবে।
এই সম্ভাব্য মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনার সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সরেজমিন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হবে এ প্রশাসন কত দিন চলবে। সংশ্লিষ্ট পাঁচজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ প্রস্তাব অনেকটা ২০০৩ সালে ইরাকে গঠিত ‘কোয়ালিশন প্রোভিশনাল অথরিটি’র মতো। ওই সময় ইরাক যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠন করেছিল, যা পরে স্থানীয় বিদ্রোহের মুখে পড়ে এবং এক বছরের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।
সূত্রগুলো আরও জানায়, প্রস্তাবিত প্রশাসনে অন্য দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। যদিও নির্দিষ্ট কোনও দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এই প্রশাসনে ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটদের স্থান দেওয়ার কথা বলা হলেও হামাস কিংবা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এতে থাকবে না।
গাজা শাসনকারী হামাস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছে। গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া অফিসের পরিচালক ইসমাইল আল-থাওবাতা বলেন, আমাদের জনগণ নিজেরাই তাদের শাসক বেছে নেবে। কোনও বিদেশি রাষ্ট্র বা মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এপ্রিলে আমিরাত-নিয়ন্ত্রিত স্কাই নিউজ আরাবিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সার বলেছিলেন, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ‘আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে’ গাজা পরিচালিত হতে পারে। যেখানে ‘মধ্যপন্থি আরব দেশগুলো’ অংশ নেবে এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের দিকনির্দেশনায় কাজ করবে। তবে কোন দেশগুলো এই তত্ত্বাবধানে থাকবে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করেনি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়ও কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
রয়টার্সের পক্ষ থেকে মন্তব্য চাওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র সরাসরি পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, আমরা শান্তি চাই এবং জিম্মিদের অবিলম্বে মুক্তি চাই। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার: আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি এবং আমরা শান্তির পক্ষে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি অস্থায়ী প্রশাসন গঠনের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রকে আরও গভীরভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলবে। মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র ও প্রতিপক্ষ উভয় পক্ষই এটিকে দখলদারত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষত, ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য শর্ত দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অন্তর্ভুক্তি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশ্বাসযোগ্য রোডম্যাপ থাকতে হবে।
তবে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্ব, বিশেষ করে নেতানিয়াহু সরকার, স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের গাজায় ভূমিকা রাখার বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করে।
নেতানিয়াহু সোমবার ঘোষণা দিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আরও প্রসারিত হবে। ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ আরও বেশি গাজাবাসীকে স্থানচ্যুত করা হবে। এখনও ৫৯ জন ইসরায়েলি জিম্মি গাজায় বন্দি আছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েল সরকার প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে ‘স্বেচ্ছায়’ দেশত্যাগে উৎসাহিত করলেও গোপনে এমন কিছু পরিকল্পনাও বিবেচনায় রেখেছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের থেকে গাজা খালি করার চেয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তা রয়েছে।
এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে গাজায় পুনর্গঠন সীমিত করে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন, এলাকা বিভাজন এবং স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন।
সূত্রগুলো বলছে, এসব আলোচনার চূড়ান্ত রূপরেখা এখনও নির্ধারিত হয়নি। প্রস্তাবটি কার পক্ষ থেকে এসেছে বা নেতৃত্বে কে থাকবেন, তাও এখনও অনির্ধারিত। তবে এটি যে ভবিষ্যতের গাজার জন্য একটি বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হতে চলেছে, সে বিষয়ে কারও সংশয় নেই।