মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কোনও মসজিদ পরিদর্শন করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ সফর করেন তিনি। এটি ছিল তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআর এ খবর জানিয়েছে।
সফরের অংশ হিসেবে ট্রাম্প আমিরাতের যুবরাজ শেখ খালিদ বিন মোহাম্মদ আল নাহিয়ানের আমন্ত্রণে এই ঐতিহাসিক মসজিদ পরিদর্শন করেন। মসজিদে প্রবেশের আগে তিনি যথারীতি জুতা খুলে ফেলেন এবং মসজিদের অপূর্ব সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বলেন, এটা এত সুন্দর! সত্যিই অবিশ্বাস্য একটি সংস্কৃতি।
বিশ্ববিখ্যাত এই সাদা মার্বেলের গম্বুজ ও ফুলখচিত ইতালিয়ান পাথরের মেঝে বিশিষ্ট মসজিদটি শুধু উপাসনার স্থান নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকও। এটি পর্যটক, রাজনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক তারকাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
এই সফরে ট্রাম্পের সঙ্গে সৌদি আরব ও কাতার ঘুরে আসার পর আমিরাত ছিল তার তৃতীয় গন্তব্য। প্রতিটি দেশেই তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হয়—অ্যারাবিয়ান ঘোড়া, সম্মান প্রহরী ও নানা আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর ছিল আয়োজন।
ট্রাম্প ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার মধ্যস্থতায় আমিরাত-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ছিল ঐতিহাসিক আব্রাহাম চুক্তির অংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের প্রভাব বজায় রাখতে এ ধরনের সফর গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ট্রাম্প পরিবারের আর্থিক স্বার্থও এই অঞ্চলে বিস্তৃত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতারে ট্রাম্প ব্র্যান্ডের টাওয়ার ও গলফ রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছে। এমনকি আমিরাতের একটি বিনিয়োগ তহবিল ‘ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিন্যান্সিয়াল’ নামের একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রকল্পের মাধ্যমে ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ‘বিনান্স’ নামের একটি এক্সচেঞ্জে, যার সঙ্গে ট্রাম্প পরিবারের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের মসজিদে নজরদারি চালানোর কথা বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। অথচ এবার তিনি মুসলিমদের কাছে নতুন বার্তা দিচ্ছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কোনও মসজিদে কখনও যাননি। তবে বিশ্ব ইতিহাস অনুযায়ী, কয়েকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মসজিদ সফর করেছেন। ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার ১৯৫৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি মসজিদ উদ্বোধন করেন এবং ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার পর সেই একই মসজিদে বক্তব্য দেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। বারাক ওবামা ২০১৬ সালে বাল্টিমোরে একটি মসজিদ সফর করেন।
ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ও জামাতা জ্যারেড কুশনারও ২০২০ সালে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে এই মসজিদ সফর করেছিলেন। জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে একই মসজিদ পরিদর্শন করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম ভোটারদের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠেছে। নভেম্বরের নির্বাচনে মিশিগানের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে মুসলিম ও আরব ভোটাররা তৃতীয় দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে সুবিধা করে দেন। অনেকেই তখন বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিয়ে অবস্থানে হতাশ ছিলেন।
রমজানে হোয়াইট হাউজের ইফতার মাহফিলে ট্রাম্প বলেন, নভেম্বরে মুসলিম কমিউনিটি আমাদের পাশে ছিল। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনাদের পাশেই থাকব।
কিন্তু তার প্রশাসন পরে অভিবাসন নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। গাজার যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে এবং ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজাবাসীদের জন্য ত্রাণও পৌঁছাতে পারেনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় ট্রাম্প এক বিতর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা আরব নেতাদের কাছে একেবারেই অপ্রিয়। তিনি গাজা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি গর্বের সঙ্গে চাইব যুক্তরাষ্ট্র গাজার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করুক, এটিকে একটি স্বাধীনতার এলাকা বানানো হোক, ভালো কিছু ঘটুক।
শুক্রবার মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ করছেন ট্রাম্প। সৌদি আরব ও কাতারে রাজকীয় অভ্যর্থনার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে মসজিদ সফর ও কৌশলগত আলোচনা—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নতুন অবস্থান তৈরি হয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।