প্রায় দুই সপ্তাহের সংঘর্ষ শেষে মঙ্গলবার ভোরে ইরান ও ইসরায়েল এক অঘোষিত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও শান্তির পথে একে নিছক ‘বিরতি’ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও তার কার্যকারিতা শুরুর আগেই উভয় পক্ষ শেষ মুহূর্তে হামলা চালায়।
যুদ্ধবিরতির পূর্বঘোষিত সময় সোমবার ভোর ৪টা (তেহরান সময়)। তার কিছু আগেই ইসরায়েল পশ্চিম ইরানে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। জবাবে ইরান সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা শুরু ঘোষণা করে। তবে তার ঠিক আগে তেহরানের নির্দেশে তেল আবিব, হাইফা ও বেয়ারশেভায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
ইরানি কর্মকর্তারা জানান, এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল ‘সীমিত প্রতিশোধ’, নতুন করে যুদ্ধ ছড়ানো নয়। লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধবিরতির আগে সামরিক দিক থেকে শেষ কথা বলা।
এর আগে রবিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে জিবিইউ-৫৭ বাংকার ধ্বংসকারী বোমা ছোড়ে। এর পাল্টা জবাবে ইরান আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ওই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টকম কমান্ডের কেন্দ্র।
এই হামলাকে ইরান কোডনেম দেয়, ‘বিজয়ের সংবাদ’। তারা দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্র ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল, তার পাল্টা হিসেবেই ইরানও ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। তবে কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল, মাত্র একটি প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করে।
এই হামলা কোথাও প্রাণহানির উদ্দেশ্যে হয়নি জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, ‘খুব দুর্বল হামলা ছিল। ইরান আগে থেকেই সতর্ক করেছিল, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। এটাই এখন শান্তির সময়।
কিন্তু কূটনৈতিক সমীকরণ ছিল জটিল। উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো দ্রুত এই হামলার নিন্দা জানায়। সৌদি আরব কাতারের পাশে থাকার ঘোষণা দেয়। কাতার এই হামলাকে ‘সার্বভৌমত্বে আঘাত’ বলে নিন্দা জানায়, তবে একইসঙ্গে ইসরায়েলকেও দায়ী করে বলেছে, ‘তেহরানে হামলাই এই সঙ্কটের মূল উৎস।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কাতার এই উত্তপ্ত পরিবেশে নিজেকে শুধু ভুক্তভোগী নয়, বরং মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তারা একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়, যা দ্রুত জিসিসি সদস্যদের সমর্থন পায়।
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির জন্য হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তেল এখান দিয়েই পরিবাহিত হয়। কোনও বড় সংঘর্ষ এই অঞ্চলকে ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে ঠেলে দিতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার ঘোষণা দেন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। তিনি একে ‘মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য জয়’ বলে উল্লেখ করেন।
তবে ইরান খুব সতর্ক। দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক আব্বাস আরাঘচি এক্সে লিখেছেন, ইসরায়েল যদি সকাল ৪টার মধ্যে হামলা বন্ধ করে, ইরান আর জবাব দেবে না।
শান্তির ছায়া, কিন্তু ভিত নড়বড়ে
যুদ্ধবিরতির বাস্তবতা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ১২ দিনের এই সংঘর্ষ নতুন ভূরাজনৈতিক ক্ষত সৃষ্টি করেছে, আঞ্চলিক জোট ভেঙে পড়েছে, জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে উঠেছে।
স্থায়ী শান্তি আনতে হলে যেসব শর্ত দরকার—দোষ স্বীকার, ক্ষতির স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক নিন্দা ও নিশ্চয়তা—এগুলোর কোনোটাই এখন বাস্তব নয়। ইসরায়েল ও ইরান কেউই দায় স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়, কেউই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আন্তর্জাতিক কাঠামোতে আস্থা রাখে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের চোখে এই যুদ্ধবিরতি তেমনই এক বিরতি, যেটা ইসরায়েলকে পুনরায় অস্ত্র মজুত ও প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির সুযোগ দেয়। গাজা, লেবানন বা সিরিয়ার মতো পুরনো অভিজ্ঞতাই এর ভিত্তি।
মূল সমস্যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির পরিণতি এখনও অনিশ্চিত। ইসরায়েল গোপনে ইরানের স্থাপনায় হামলা চালায় এই সন্দেহে যে, তেহরান পরমাণু সক্ষমতা সীমার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। ইরান এটাকে সার্বভৌম অধিকার বলে দাবি করে।
এই সংঘাত ইরানকে পরমাণু কার্যক্রম থেকে বিরত করেনি, বরং আরও দৃঢ় করেছে। একজন কূটনীতিক বলেন, তারা লড়েছে হাল ছাড়তে নয়, বরং অধিকার ধরে রাখতে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলি চাপে ও ইরানি প্রতিরোধের মধ্যে পড়েছে।
তেহরান স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেদেরকে সরিয়ে রাখে, তবে লড়াই শুধু ইসরায়েল আর ইরানের মধ্যেই থাকবে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড