ইসরায়েলি টানা হামলায় বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখন কঠিন লড়াইয়ে লিপ্ত হামাস। কমান্ডার সংকট, সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান এবং ইরানের সম্ভাব্য সমর্থনহীনতার মাঝে এই ইসলামপন্থি সংগঠনটি টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
হামাসের ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র জানায়, সংগঠনটি এখন বিকেন্দ্রীকৃত পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। কিছু যোদ্ধা স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। অন্যদিকে ইসরায়েল খোলাখুলি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে। তারা হামাসের আধিপত্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ১৬টি হামাস-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও সূত্র, ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা জানান, হামাসের কেন্দ্রীভূত কমান্ড ধ্বংস হয়ে গেছে। সংগঠনটি এখন সীমিত পরিসরে আকস্মিক হামলা চালাতে পারলেও বড় পরিসরে অভিযান পরিচালনায় অক্ষম।
দীর্ঘ ২০ মাসের সংঘাতে ইসরায়েল গাজার ভূগর্ভস্থ শত শত কিলোমিটার সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছে এবং আনুমানিক ২০ হাজারের বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
ইসরায়েলের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, হামাসের যোদ্ধাদের গড় বয়স প্রতিদিনই কমছে। কারণ সংগঠনটি বর্তমানে গাজার বাস্তুচ্যুত, দরিদ্র ও বেকার তরুণদের মধ্যে থেকে নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে।
চারটি সূত্র জানিয়েছে, রাফাহ অঞ্চলে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় হামাসবিরোধী এক গোত্র নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে হত্যার জন্য বিশেষ বাহিনী পাঠানো হলেও এখনও তাকে ধরতে পারেনি হামাস। এই বিদ্রোহী নেতা গাজার পূর্বাঞ্চলীয় রাফাহ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছেন। সেখানে তার অনুসারীরা খাদ্য সহায়তার ট্রাকের পাহারায় নিয়োজিত।
তবে হামাস তাকে ‘ইসরায়েলের দালাল’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছে এবং জানিয়ে দিয়েছে, আবু শাবাবের ‘গ্যাং’ নির্মূল করতে কঠোর আঘাত করা হবে।
হামাসের রাজনৈতিক নেতা সামি আবু জুহরি রয়টার্সকে বলেন, সংগঠনটি যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করছে। তবে আত্মসমর্পণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমরা আলোচনায় প্রস্তুত এবং সব জিম্মিকে একসঙ্গে মুক্তি দিতে রাজি আছি।
রয়টার্সকে একটি সূত্র জানায়, হামাস এখন যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া। কারণ যুদ্ধবিরতি হলে ক্লান্ত গাজাবাসীর জন্য স্বস্তি আসবে এবং সংগঠনটি নিজের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দমন করতে পারবে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে কিছু হামাসবিরোধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়ে সমর্থন দিচ্ছে তার সরকার। যদিও আবু শাবাবের দল দাবি করেছে, ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ তাদের নেই এবং তাদের লক্ষ্য কেবল মানবিক সহায়তা রক্ষা করা।
তবে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব বিদ্রোহী বাহিনী গাজায় বিশৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা ভাঙতে চায়।
ইরান দীর্ঘদিন ধরে হামাসের প্রধান সামরিক মিত্র হলেও সম্প্রতি ইসরায়েলের ইরানে চালানো বিমান হামলা এবং মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি এই সম্পর্ককে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদির হত্যার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। তিনি হামাসের সঙ্গে সমন্বয়কারী প্রধান ব্যক্তি ছিলেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
এক হামাস ঘনিষ্ঠ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, ইরানের সমর্থন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থ, প্রশিক্ষণ ও সামরিক কৌশলে এই অনিশ্চয়তা আমাদের কৌশলেও প্রভাব ফেলবে।
বৈরুতের কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়াজিদ সাইঘ বলেন, হামাস এখন কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এটা শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক অস্তিত্বেরও লড়াই।
তিনি মনে করেন, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে হামাস হয়তো গাজা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর যুদ্ধ শেষ হলে হয়তো তাদের আর শাসকগোষ্ঠী হিসেবে কেউ গ্রহণও করবে না।
৫৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে যুদ্ধবিরতির জন্য। তবে নেতানিয়াহু পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন হামাস নেতাদের গাজা ত্যাগ করতে হবে। যা হামাসের কাছে আত্মসমর্পণের শামিল।
এক হামাস সূত্র রয়টার্সকে বলেছেন, আমরা বিশ্বাস রাখছি। কিন্তু বাস্তবতা খুব ভালো দেখাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটে নিপতিত হামাস আজ সেই শক্তিশালী সংগঠন নয়, যারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫১ জনকে অপহরণ করেছিল। তবু গাজার বিধ্বস্ত ভূখণ্ডে তারা এখনও টিকে আছে ক্ষীণ ক্ষমতা, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে।