X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

আমার সামনেই রোহিঙ্গাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়: বিবিসি সাংবাদিকের ভাষ্য

বিদেশ ডেস্ক
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৩৪আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৩:৩২

বাংলাদেশে গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই এসেছে রাখাইনে মংডু, ভুটিয়াডং ও রাথেডং জেলা থেকে। এখানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এই অঞ্চলগুলোতে যাওয়া খুবই কঠিন। রাস্তা খারাপ ও সরকারের অনুমতিও পান না  সাংবাদিকরা।  

তবে সম্প্রতি সেখানে গিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিক জোনাথান হেড। মিয়ানমার সরকারের আয়োজিত এক সফরে অংশ নেন ১৮ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। সেই দলেই ছিলেন জোনাথান। ফিরে এসে তিনি জানিয়েছেন সেখানকার চিত্র। বলেছেন ভয়াবহতার কথা। বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তার অভিজ্ঞতা।

মংগডুতে পুলিশের উপস্থিতিতে এই মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিকরা

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই স্থানে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া মাত্রই রাজি হয়ে যান জোনাথান। কিন্তু যেহেতু এটা সরকারি সফর তাই স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট কিছু স্থান পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ছিলে তাদের। তবে এই কড়াকড়ির মধ্যেও প্রকৃত সত্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি।

জোনাথন বলেন, সরকারি বাহিনী এখন সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, অনেকেরই মতে এটা আত্মরক্ষা। এখন রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যেকোনও সরকারের জন্যই তা সামলানো কঠিন।   

স্থানীয় এক বৌদ্ধ ভিক্ষু দাবি করেন মুসলিমরা তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে

রাখাইনের রাজধানী সিতওয়াকে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাদের একা কাজ করতে নিষেধ ছিল। সন্ধ্যায় ৬টায় কারফিউ শুরু হয়ে যেত। ফলে অন্ধকারেও কাজ করার সুযোগ ছিল না। আগ্রহের জায়গায় যেতে চাইলেও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করা হয়। জোনাথান মনে করেন, নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আসলেই তারা উদ্বিগ্ন ছিল।

মিয়ানমারের নিম্নাঞ্চলের এই সফরে বেশিরভাগ সময় খুব খারাপ রাস্তা ও নৌকায় করে গতো সিতওয়া থেকে বুথিয়াডং যেতে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। সেখান থেকে একঘণ্টা সময় নিয়ে মায়ু পাহাড় পার হয়ে দিয়ে মংডু। সেখানেই চোখে পড়ে প্রথম ভস্মীভূত গ্রাম মিয়ো থু জি।

মুসলিমরা বৌদ্ধদের বাড়ি পোড়াচ্ছে বলে কিছু সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। জোনাথনের ভাষায় এগুলো সাজানো

বিবিসির অনুসন্ধানে পরে বেরিয়ে আসে ছবিতে থাকা নারী আসলে হিন্দু

সরকারে উদ্দেশ্য ছিলে রোহিঙ্গা পালিয়ে যাওয়ায় তাদের যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করা। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা শুনিয়েছেন। সেই সত্য ঢাকতেই সাংবাদিকদের সামনে অন্যরকম ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল সরকার। কিন্তু জোনাথান মনে করেন, সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথমে মংডুর ছোট একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সবাই মুসলিমদের উপর হামলার কথা শোনান। জানা গেছে, অনেক হিন্দু পরিবারও হামলার শিকার হয়েছেন। কারণ তারা দেখতে রোহিঙ্গাদের মতো।  

মংডুতে পুড়ে যাওয়া একটি গ্রাম

স্কুলে যখন সাংবাদিকরা পৌঁছান তখনও তাদের সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেননি কেউ। এরমধ্যেই একজন জানালেন, কিভাবে সেনাসদস্যরা গ্রামে গুলি চালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে একজন তাকে থামিয়ে দেন। 

এরপর তাদেরকে একটি বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভিক্ষুরা জানান,  মুসলিমরা তাদের বাড়ি ও গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তাদের ছবিও দেখানো হয়। কিন্তু তা খুবই অদ্ভূত ছিল বলে জানান বিবিসির সাংবাদিক।

কর্নেলের দাবি সব বাড়ি পুড়িয়েছে মুসলিমরা

ছবিতে দেখা যায়, হজের টুপি পরা কিছু মানুষ আগুন দিচ্ছে। দেখা যায় একজন নারীকেও। পরে জানা গেছে, একজন হিন্দু নারী ও পুরুষকে মুসলিম সাজিয়ে এই ছবি তোলা হয়েছিল। সম্পূর্ণ বিষয়টিই সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি করেন জোনাথান।

সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ক স্থানীয় মন্ত্রী কর্নেল ফোন টিন্তের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিকরা। তিনি দাবি করেন, বাঙালি সন্ত্রাসীরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) গড়ে তুলেছে। তারা রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ও প্রত্যেক পরিবার থেকে একজনকে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করছে। আর যারা রাজি হচ্ছে না তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সামরিক অভিযানের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এর প্রমাণ কোথায়। রোহিঙ্গা নারীদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তাদের কেন ধর্ষণ করতে চাইবে?’

মংডুতে গ্রামবাসীরা ক্যামেরার সামনে কথা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। তারপরও কেউ কেউ নিরাপত্তা বাহিনীর চাপ, খাদ্য সংকট ও আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন।

হামলার দুই সপ্তাহ পর বৃষ্টির মওসুম হওয়ার পর এখন ধোঁয়া উঠছে কিছু বাড়ি থেকে

একজন তরুণ জানান, তিনি বাংলাদেশে পালাতে চান। কিন্তু তাদের নেতা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ফলে তাদের সেখানে থাকতে হচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কার ভয়ে তারা পালাতে চান। উত্তরে তারা জানান, সরকারের ভয়ে।

জোনাথন জানান, এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উপকূলীয় শহর আলেল থান ক্য়িাউ। এখানেই ২৫ আগস্ট আরসার সশস্ত্র যোদ্ধারা হামলা চালিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পথে আমরা গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দেই। সবগুলো গ্রামই ছিল খালি। আমরা নৌকা দেখি, একেবারে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে সেগুলো। রয়েছে ছাগল ও গরু। কিন্তু সেখানে কোনও মানুষ নেই। আলেল থান কিয়াউ ধূলিস্যাৎ অবস্থায় রয়েছে। একটি ক্লিনিকেরও একই অবস্থা। শুধু একটি সাইনবোর্ড রয়েছে যাতে দেখা যায় মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স দ্বারা এটি পরিচালিত হয়। উত্তর দিকে দূরে তাকালে আমরা চারটি সারিতে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে পাই এবং অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পাই। আমরা বুঝতে পারছিলাম আরও বেশি কিছু গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ লেফটেন্যান্ট  অং কিয়াউ মোয়ি তাদের জানান, কিভাবে হামলার আগাম খবর তারা পেয়েছিলেন। এরপর তিনি অমুসলিমদের ব্যারাকে নিরাপত্তার জন্য নিয়ে আসেন এবং তার লোকেরা সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। দুর্বৃত্তদের কাছে বন্দুক, তলোয়ার ও বিস্ফোরক ছিল। তিন ঘণ্টার যুদ্ধে তাদেরকে হটিয়ে দেওয়া হয়। ১৭ সশস্ত্র যোদ্ধা এবং এক অভিবাসন কর্মকর্তা নিহত হয়। এরপর মুসলিমরা পালাতে শুরু করে।

তবে হামলার দুই সপ্তাহ পর বৃষ্টির মওসুমেও কেন শহরের একাংশ থেকে ধোঁয়া উঠছে জানতে চাইলে জবাব দিতে গিয়ে জটিলতায় পড়েন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলতে চেষ্টা করেন, হয়ত কিছু মুসলমান থেকে গেছে এবং সম্প্রতি পালিয়ে যাওয়ার আগে নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে।

গাড়ি থেকে এই গ্রামটিই দেখেন সাংবাদিকরা

এরপর যখন তারা শহর থেকে ফিরছিলেন তখন একেবারে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটে। তারা ধানের ক্ষেতের পাশে গাছের ফাঁক দিয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে পান। ফেলে আসা পথে অনেক গ্রামের মতোই একটি ছিল এই গ্রাম। একেবারে রাস্তার পাশে। আগুন মাত্র লেগেছে। সাংবাদিকরা সবাই টহলরত পুলিশের উদ্দেশে গাড়ি থামানোর চিৎকার করেন। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই তারা পুলিশকে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যান। পুলিশ আমাদের বলে যে গ্রামে যাওয়া নিরাপদ নয় কিন্তু ততক্ষণে তারা প্রায় আগুন লাগা বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছেন।

জোনাথনের ভাষায়, আগুনে পোড়ার শব্দ ছিল চারদিকে। স্পষ্টতই মুসলিম নারীদের পোশাক কাদার ওপর ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে ছিল পেশিবহুল যুবকরা। তাদের হাতে তলোয়ার ও চাপাতি রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। ১৮ জন সাংবাদিক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। সাংবাদিকদের ক্যামেরা এড়ানোর চেষ্টা করে তারা। তাদের দুই জন গ্রামের আরও ভেতরে চলে যায়। সেখান থেকে বাকিদের নিয়ে এসে তারা পালিয়ে যায়।

কাছে গিয়ে দেখতে পান পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে

জোনাথন লিখেছেন, আমার এক সহকর্মী তাদের একজনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল। ওই যুবকদের দাবি, তারা রাখাইন বৌদ্ধ। তারা স্বীকার করে, পুলিশের সহযোগিতায় তারা বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে। গ্রামের ভেতরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমরা দেখি একটি মাদ্রাসার ছাদে মাত্র আগুন লাগানো হয়েছে। আরবি ভাষার পাঠ্যপুস্তক ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বাইরে। সেখানে একটি প্লাস্টিকের জগও রয়েছে যাতে করে পেট্রোল বহন করা হয়েছিল।

জোনাথন বলেন, এই গ্রামটির নাম ছিল গাউডু থার ইয়া। একটি মুসলিম গ্রাম। সেখানে কোনও মানুষের চিহ্ন চোখে পড়েনি। আগুন লাগানো রাখাইন যুবকরা আমাদের টহল পুলিশের পাশ দিয়ে চলে যায়। এ সময় অনেকের হাতেই ছিল লুট করা বিভিন্ন সামগ্রী। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বড় কয়েকটি পুলিশ ব্যারাকের কাছেই। কিন্তু এটি থামানোর জন্য কেউই কিছু করেনি।

/এমএইচ/এএ/
সম্পর্কিত
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হেড মাঝিকে গুলি করে হত্যা
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের উপায় খুঁজতে আশ্রয় শিবিরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেরির অজুহাত হতে পারে না’
সর্বশেষ খবর
আগামী বছর পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সফরে যাবে আয়ারল্যান্ড
আগামী বছর পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সফরে যাবে আয়ারল্যান্ড
বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে নারীদের তাড়া করে গুলি ছুড়লো বিএসএফ
বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে নারীদের তাড়া করে গুলি ছুড়লো বিএসএফ
এবারের পর্দা উঠছে অদ্ভুত মেজাজে!
কান উৎসব ২০২৪এবারের পর্দা উঠছে অদ্ভুত মেজাজে!
কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া?
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শুক্রবারও চলবে মেট্রোরেল
শুক্রবারও চলবে মেট্রোরেল
ইয়াহিয়া সিনওয়ার: যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, শেষও কি তার হাতে?
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনইয়াহিয়া সিনওয়ার: যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, শেষও কি তার হাতে?
আমরা সুন্দর একটি সম্পর্ক মেন্টেইন করি: জয়া আহসান
বাংলা ট্রিবিউনের দশম বর্ষপূর্তিআমরা সুন্দর একটি সম্পর্ক মেন্টেইন করি: জয়া আহসান
রেল মন্ত্রণালয়ের গাড়ি নিয়ে চুরি করতে গিয়ে গ্রেফতার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার
রেল মন্ত্রণালয়ের গাড়ি নিয়ে চুরি করতে গিয়ে গ্রেফতার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার