কাশ্মিরে জন্ম নেওয়া দুই গবেষক সামরীন মুসতাক ও মুদাছির আলম। এখন তারা দিল্লিতে থাকেন। ভূ-স্বর্গখ্যাত ওই উপত্যকায় রাষ্ট্রীয় সহিংসতার জেন্ডার-প্রশ্ন সামরীনের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। মুদাছির কাজ করছেন সেখানে মানবিক সহায়তা দানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ধারার স্বনামধন্য সাময়িকী জ্যাকোবিন-এ যৌথভাবে তারা লিখেছেন কাশ্মিরিদের ‘অস্তিত্বহীনতা’ নিয়ে। জানিয়েছেন, কাশ্মিরে টেলিফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকার বিপরীতে পুলিশ স্টেশন থেকে ৩০ সেকেন্ডের কল করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে আর ফোনের কাছে আসতে পরিবারগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। এই মর্যাদাহীন পরিস্থিতি আর চরম নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশের মধ্যে কী করে প্রাণ খুলে কথা বলবে মানুষ? ৩০ সেকেন্ডে কতোটুকু কথা বলা সম্ভব? এক স্থানীয় সাংবাদিক তাই বলেছেন, ‘কাশ্মিরের অভ্যন্তরেই কাশ্মির অদৃশ্য-অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে।’
গবেষক সামরীন আর মুদাছির জ্যাকোবিনে লিখেছেন, “৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সর্বশেষ আমাদের পরিবারের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পেরেছিলাম। আবার কখন কথা বলতে পারবো তা জানি না, বা আদৌ কথা বলতে পারবো কি না? তারা সতর্ক করেছিল। আর তখন থেকে এক গভীর নীরবতা চলছে। আমরা বারবার কল করলেও সেই একই যান্ত্রিক উত্তর আসছে, ‘নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে’।” তবে ১৪ আগস্ট ওই দুই গবেষক কিছু ফোনকল রিসিভ করেছেন, সে আলাপগুলো তারা জ্যাকোবিনে তুলে ধরেছেন। সেই ফোনালাপগুলো এমন:
টেলিফোন বেজে উঠলো, ‘কেমন আছ তুমি, আমরা সবাই এখানে ভালো আছি।’
−‘আমি ভালো আছি। ফোন করতে পারলে কী করে?’
জেলা পুলিশ লাইন থেকে ফোন করেছি।
−বিরক্তিকর কিছু করো না দয়া করে। আমরা বরং কথা না বলেও থাকতে পারব, তবু ওদের সহায়তা নিও না।
অন্যপাশে হাসির শব্দ শোনা যায়। ৩০ সেকেন্ড পর ফোন কেটে যায়।
আরকেটা ফোনকল এমন।
কেমন আছ, এখানে আমরা সব ভালো।
−আমি ভালো আছি। তোমাদের ওখানে কেউ গ্রেফতার হয়েছে।
দ্রুততার সঙ্গে উত্তর: না না কিছু না...
ফোনকল শেষ।
অপর একটি আলাপ:
‘তুমি কি আমাদের মেয়েকে জানিয়ে দিতে পারবে, এখানে আমরা সবাই ঠিকঠাক আছি।’
−সত্যিই ঠিক আছো তো? কিছু লাগবে কি তোমাদের? লাগবে কিছু?
উত্তর মেলে না।
আরেকটি ফোনালাপ:
‘টিভি বিতর্কে আসতে পারবে, মা তোমাকে দেখতে চায়।’
−সত্যি?
হুম, তিনি মনে করছেন, তোমার মুখটা একবার দেখার জন্য এটাই একমাত্র উপায়।
−আমি চেষ্টা করব।
ফোনকল শেষ।
গবেষক সামরীন আর মুদাছির লিখেছেন, ৫ আগস্ট ভোর থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলছে। প্রাথমিকভাবে উপত্যকা থেকে আসা কিছু খবরে জানা গেছে মানুষদের বাড়ির বাইরে স্বাধীনভাবে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। বেশিরভাগ জায়গায় ঈদের জামাত বন্ধ রাখা হয়; সরকারই সিদ্ধান্ত দেয় কোন মসজিদ খোলা রাখা যাবে, কোনটা যাবে না। বড় ধরনের ধরপাকড়ের খবরও পাওয়া গেছে: রাজনীতিক (স্বাধীনতাপন্থী ও ভারতপন্থী), অ্যাকাডেমিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীদের আটক করা হয়েছে নির্বিচারে। ল্যান্ডলাইন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগের সব উপায় বন্ধ রাখা হয়েছে আর তা এখনও বন্ধ রয়েছে। সামরীন আর মুদাছির মনে করছেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মিরিদের সংঘটিত না হতে দেওয়ার পরিষ্কার কৌশল এটা। একইসঙ্গে সরকার তাদের অদৃশ্য করতে চায়, যেন তারা বিশ্বকে তাদের পরিস্থিতি না জানাতে পারে।
অবরোধের কয়েক দিন আগে যখন দ্রুত অতিরিক্ত সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয় তখন কাশ্মিরে গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে যে বড় ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট গুজব সত্যি হয়, যখন মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে। গবেষক সামরীন আর মুদাছির লিখেছেন, দীর্ঘদিন থেকেই হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির চেষ্টায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরকে পথের কাঁটা বিবেচনা করে আসছে ভারতের ডানপন্থীরা। ৩৭০ ধারা বাতিল সেই রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরই অংশবিশেষ। সঙ্গে তারা কাশ্মিরি জনগণকে শিক্ষা দিতে চায় এটা বুঝিয়ে যে, আজাদির (স্বাধীনতার) আকাঙ্ক্ষাই তাদের জন্য সবথেকে বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
তবে কাশ্মিরের বাস্তবতাকে কেবল ডানপন্থী পদক্ষেপ আকারে দেখতে নারাজ ওই দুই গবেষক। তারা বলছেন, ‘১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত কাশ্মিরিদের উপেক্ষা করেছে, ক্ষমতাহীন করেছে, বঞ্চিত আর অধিকারচ্যুত করেছে। সাত দশক ধরে দিল্লির ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন; ভারত রাষ্ট্র সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে যেনতেনভাবে অকার্যকর করে রেখেছে। এজন্য তারা ভোট জালিয়াতি, স্বাধীনতাপন্থী নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ, আইন পরিচালনা, পুতুল সরকার বসানো এবং জনগোষ্ঠীকে নৃশংসভাবে নিপীড়নসহ যে উপায় প্রয়োজন তাই ব্যবহার করেছে।’
ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে সামনে এনে সামরীন আর মুদাছির লিখেছেন, ১৯৮০’র দশকের শেষ ভাগে কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র লড়াই তীব্র হলে নিপীড়ন জোরালো হয়। তখন থেকে ৭০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আট হাজারের বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ছয় হাজারের বেশি মানুষের সন্ধান মিলেছে গণকবরে। নির্যাতন ও ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর ভারতীয় সেনাসদস্যদের কাঠামোবদ্ধ সহিংসতাকে নির্লজ্জভাবে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সামরীন আর মুদাছির দাবি করেছেন, এই সহিংস ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে ৩৭০ ধারা বাতিল। ‘কাশ্মিরিদের আশঙ্কা যে কোনও ভারতীয় কাশ্মিরের ভূমি কেনার অধিকার পেলে তাদের নিজ বাড়ি থেকে বাস্তুচ্যুত হতে বেশি সময় লাগবে না। তাদের এই আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতোমধ্যে মোদি সরকার এক বিনিয়োগ সম্মেলন ও উন্নয়ন পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে। এর পরিষ্কার লক্ষ্য ভিন্নমতাবলম্বী অঞ্চল ও সেখানকার মানুষের ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। কাশ্মিরকে মূলধারার সঙ্গে এই একীভূত করার চেষ্টা কাশ্মিরিদের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান।’