চীনে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনা ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে। তা নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে জটিলতা। ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে অনেক কৌশলী প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। যদি ‘ভুল নামকরণ’ হয় তাহলে তা কূটনৈতিক সংকটও তৈরি করতে পারে।
২০০৯ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলের উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ডেকেছিলেন। রহস্যজনক একটি ফ্লু ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে এবং যে কোনও সময় দেশটির প্রথম আক্রান্তের কথা ঘোষণা করার খবর জানা যাচ্ছিল। স্থানীয় একটি হাসপাতাল থেকে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য রাখলেও দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, ইয়াকভ লিৎজম্যান জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাননি। তিনি বলেন, “আমরা এই ভাইরাসকে ‘মেক্সিকান ফ্লু’ বলে ডাকব। আমরা এটিকে ‘সোয়াইন ফ্লু’ বলব না”।
ভাইরাসটির আনুষ্ঠানিক নাম এইচ১এন১ হলেও সোয়াইন ফ্লু নামেই এটি পরিচিতি পেয়ে গেছে। ইসরায়েল এটিকে মেক্সিকান ফ্লু নামে আখ্যায়িত করার কারণ হলো সোয়াইন ফ্লু নামটি দেশটির ইহুদি ও মুসলিম নাগরিকদের চরম অপমানজনক। অনেকে ধর্মীয় কারণে শুকরকে হারাম মনে করেন। মেক্সিকান ফ্লু ভাইরাসের নামকরণে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করা হয়েছে। যে স্থানে ভাইরাসটির উপস্থিতি বা আবিষ্কার হয় সেই স্থানের নামের নামকরণ করার রীতি প্রচলিত আছে।
মার্বুর্গ ভাইরাসের কথা ধরা যাক। হেমোরজিক জ্বরের নামকরণ করা হয়েছে জার্মানি ইউনিভার্সিটির শহরের নামে; হেন্ড্রা ভাইরাস। এতে ব্রিসবেনের শহতলীর নাম রয়েছে, যেখানে এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। জিকা হলো উগান্ডার একটি বন; ফুজিয়ান ফ্লু চীনের একটি প্রদেশের নামে; ইবোলাও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গোর একটি নদীর নাম; এবং বহুল পরিচিত ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু।
ইসরায়েলি ঘটনার ক্ষেত্রে দেশটিতে নিযুক্ত মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত তার দেশের নামে ভাইরাসের নামকরণ করাকে অবমাননাকর উল্লেখ করে সরকারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। স্বাভাবিকভাবেই কোনও দেশ চায় না কোনও প্রাণঘাতী ভাইরাসের সঙ্গে তাদের নাম জড়িয়ে পড়ুক। শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল রাজি হয় ভাইরাসটির আসল নাম সোয়াইন ফ্লু না পাল্টাতে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা চীনের উহানে আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাস নিয়েও প্রায় একই ধরনের জটিলতার মুখে পড়েছিলেন। ভাইরাসটি শনাক্ত ও ছড়িয়ে পড়ার শুরুতে বেশ কয়েকটি নাম বিবেচনা করা হয়েছিল। উহান ফ্লু, উহান করোনা ভাইরাস, করোনাভাইরাস, ২০১৯-এনকোভ এবং দীর্ঘ আরেকটি নাম ‘উহান সিফুড মার্কেট নিউমোনিয়া ভাইরাস’।
১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটির আনুষ্ঠানিক নাম ঘোষণা করে এক সংবাদ সম্মেলনে। নতুন করোনা ভাইরাসের সৃষ্ট রোগের নাম দেওয়া হয় ‘কোভিড-১৯’।
কিন্তু এই সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অব ভাইরাসেস একটি নথি প্রস্তাব করে। যাতে ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়, সেভিয়ার অ্যাকুইট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস টু বা ‘সার্স-কভ-২’। প্রস্তাবিত এই নামকরণে এটি সার্স ভাইরাসের কাছাকাছি বলে হাজির হয়।
অদ্ভুত হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক মুখপাত্র ‘সায়েন্স’ সাময়িকীকে জানান, তারা ভাইরাসটির এই নাম ব্যবহার করবেন না। কারণ সার্স শব্দটি আরও বেশি আতঙ্ক ছড়াবে। যদিও অনেক সংবাদমাধ্যম এখনও এটিকে করোনাভাইরাস হিসেবেই আখ্যায়িত করছে। অনেকে আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া রোগের নামটি ব্যবহার করছে। কেউ কেউ একসঙ্গে ব্যবহার করছে রোগ ও ভাইরাসটির গোত্রের নাম।
ভাইরাসের নামকরণের স্বীকৃতি প্রক্রিয়া হলো, ভাইরাসের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার নিশ্চিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা কয়েকটি নাম সুপারিশ করে পাঠান ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অব ভাইরাসেস’র কাছে। কমিটি তাদের পাঠানো নাম থেকে একটি নির্বাচন করে।
সমস্যা হলো ভাইরাসের দুটি নাম থাকে। যেমন- আমরা নিজেদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি, যদিও আমাদের আনুষ্ঠানিক প্রজাতি হলো হোমো স্যাপিয়েন্স। প্রজাতির নামের মতোই, ভাইরাসের আনুষ্ঠানিক নাম ছাড়া প্রচলিত বা সাধারণ নাম ঠিক করা যায় না। সাধারণত একটি আরেকটির সঙ্গে মিলে যায় করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট সৃষ্ট জটিল পরিস্থিতি এড়াতে। কিন্তু সব সময় তা ঘটে না।
একটি নামে সবার সম্মত না হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো বিশ্বে এখন ৭ হাজার ১১১টি ভাষায় কোটি কোটি শব্দ হয়েছে। একটি ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় খারাপভাবে উপস্থাপিত হবে না এমন শব্দ খুঁজে পাওয়া অবাক করার মতো কঠিন। যদি ভুল শব্দ বেছে নেওয়া হয়, তাহলে তা পুরো একটি অঞ্চলকে কলঙ্কিত করতে বা কোনও একটি খাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে, এমনকি কূটনৈতিক সংকটও শুরু হতে পারে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথ (এনএইচএস)-র ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জেন্স কুন বলেন, ‘এটি খুব জটিল বিষয় যা নিয়ে মানুষ খুব একটা ভাবে না। এটি মানুষকে ভাবায় ভিন্ন উপায়ে। জীবনের অনেক কিছুই বিতর্কিত। কিন্তু যখন নামকরণের বিষয় আসে তখন মানুষ একেবারে চূড়ান্ত ক্ষুব্ধ হয়।’
ভাইরাসের আনুষ্ঠানিক নামকরণে যত বেশি সময় লাগে মানুষ তত বেশি প্রচলিত নাম ব্যবহার করে ও তা টিকে যায়। যেমন, এইচ১এন১ ভাইরাসটির সাধারণভাবে সোয়াইন ফ্লু হিসেবেই পরিচিত।
জেন্স কুনের মতে, ‘মানুষ যাতে করে কোনও ভাইরাসের কথা বলতে একই শব্দ ব্যবহার করে সেটি নিশ্চিতের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রজাতির নাম সঠিকভাবে নির্ধারণ করা’।
ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হলো, তা হতে হবে অদ্বিতীয়। নতুন ভাইরাসকে উহান করোনাভাইরাস আখ্যায়িত করলে জটিলতা তৈরি হতো বলে জানান জেন্স কুন। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি অব ভাইরাসেস’র সদস্য এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘ইতোমধ্যে ১৭ বা তার বেশি উহান ভাইরাস রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রিকেট ভাইরাস থেকে মশা ভাইরাস। বেশির ভাগই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া কোনও নামের সঙ্গে এই ভাইরাসগুলোর নামের মিল থাকলে তা বিষয়টিকে জটিল করে তুলবে এবং গবেষণাও কঠিন হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, নামটি হতে হবে সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয়। কুন বলেন, ‘মিডল ইস্ট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম (মার্স) নামটি আমার কাছে উদ্ভট লাগে। অনেক সময় শব্দগুলোর ধারাবাহিকতা মনে রাখা কঠিন। নাম যদি এত দুর্বহ হয় তাহলে মানুষ সহসাই তা ব্যবহার করবে না। ফলে আমাদের কোনও সুন্দর ও আঁটসাঁট নাম দরকার। যেমন , মিসেলস। এটি খুব সুন্দর শব্দ-বন্ধ।’
শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভাইরাসের নামকরণ যেনও যত সম্ভব কম মানুষকে আহত করে। জেন্স কুন বলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটি মনে হয় তাহলো বেশিরভাগ মানুষ নামকে শুধুই নামকরণ হিসেবে দেখতে রাজি না। যা নেই তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং অনেক সময় তা হয়ে যায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’।
এসব সম্ভাব্য জটিলতা এড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসের নামকরণে কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, মানুষ, প্রাণি ও স্থানের নাম একত্রিত না করতে। শুধু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর লক্ষণগুলো তুলে ধরতে হবে। তবুও বিতর্ক থাকছেই।
‘সেভিয়ার অ্যাকুইট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম (সার্স) নামটি এই নির্দেশিকা যথাযথভাবে মেনেই করা হয়েছে। তবু হংকংয়ের কর্মকর্তারা এটিকে ‘অ্যাটিপিক্যাল নিউমোনিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ সার্স-এর সঙ্গে হংকং স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিওনের (হংকং এসএআর) অনেক মিল রয়েছে। ফলে নতুন করোনা ভাইরাসের নামকরণ যদি ‘সার্স-কোভ-২’ করা হয় তাহলে হংকংয়ের মানুষেরা খুশি হবে না তা নিশ্চিত। সূত্র: বিবিসি।