তুরস্কের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই নানা বিষয়ে বিবাদে জড়াচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। সর্বশেষ আঙ্কারা ঘোষণা করেছে, ভূমধ্যসাগরের একটি এলাকায় গ্যাস ড্রিলিং জরিপের জন্য তারা একটি জাহাজ পাঠাচ্ছে। এ কথা ঘোষণার পরই গ্রিসের সঙ্গে তাদের তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও। 
নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এমনিতেই তুরস্ক ও গ্রিসের সম্পর্ক ভালো নয়। তার ওপর তুরস্কের এই জাহাজ পাঠানোর খবরে গ্রিসের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। কারণ তুরস্কের দক্ষিণ উপকুলের কাছাকাছি ওই জায়গাটি গ্রিসেরও একটি দ্বীপের নিকটবর্তী।
মঙ্গলবার খবর বেরোয় যে, সাগরের ওই এলাকাটিতে টহল দেওয়ার জন্য দুই দেশেরই নৌবাহিনীর জাহাজগুলো তৈরি হচ্ছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে উস্কানির ব্যাপারে চুপ করে থাকাটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য ভুল হবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় রক্ষণশীল ব্লকের প্রধান ম্যানফ্রেড ওয়েবার বলেছেন, তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সময় এসে গেছে।
ইউরোপের নেতারা বলছেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক ও রাশিয়া তাদের তৎপরতা ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে এবং এতে তারা স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তুরস্ক যে সতর্কবার্তা ইস্যু করেছে তা অনভিপ্রেত এবং ভুল বার্তা দিচ্ছে।
গ্রিস বলছে, তুরস্ক গ্যাস অনুসন্ধান জাহাজ সংক্রান্ত যে সতর্কবার্তা দিয়েছে তা অবৈধ। কিন্তু তুরস্ক বলছে, তাদের জরিপ জাহাজটি তাদের উপকূলবর্তী সামুদ্রিক এলাকার মধ্যেই কাজ করছিল।
তুরস্ক আর গ্রিসের সম্পর্ক খারাপ কেন?
গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক এমনিতেই ভালো নয়। নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে-আসা অভিবাসীদের নিয়ে দুই দেশের বিবাদ রয়েছে। এ মাসের গোড়ার দিকে ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়া জাদুঘরকে ফের মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণা দেয় আঙ্কারা। ওই ঘোষণা গ্রিসকে মর্মাহত করে।
সবশেষ ভূমধ্যসাগরে আঙ্কারার জাহাজ পাঠানোর ঘোষণার পর গ্রিস বলেছে, তুরস্কে নৌবাহিনীর এই পদক্ষেপ গ্রিসের সার্বভৌম অধিকারের লঙ্ঘন। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোতাকিস এ নিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরিস্থিতি নিয়ে গ্রিসের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও কথা বলার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
ওরুচ রেইস নামের তুর্কি জরিপ জাহাজটি এখনও তুরস্কের আনাতোলিয়া বন্দরেই আছে। যে এলাকাটিতে জরিপ চালানো হবে বলে তুরস্কের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, তা সাইপ্রাস ও ক্রিট দ্বীপের মাঝখানে।
গ্রিসের সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে তুরস্ক ও গ্রিস দুই দেশেরই নৌবাহিনীর জাহাজগুলো গ্রিসের কাস্তেলোরিজো দ্বীপের কাছাকাছি একটি এলাকার দিকে যাচ্ছে; যা আবার তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে সামান্য দূরে।
হঠাৎ করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলো কেন?
তুরস্ক ও গ্রিস দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য। কিন্তু পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকা থেকে জ্বালানি আহরণের প্রতিযোগিতায় তারা হয়ে উঠেছে পরস্পরের প্রতিপক্ষ। সম্প্রতি সাইপ্রাস দ্বীপের উপকূলে সাগরে বিশাল গ্যাসের মজুত আবিষ্কৃত হয়। এরপরই দেশটির সরকার, গ্রিস, ইসরায়েল ও মিসর এই সম্পদ ব্যবহারের জন্য একযোগে কাজ করতে উদ্যোগী হয়। এ ব্যাপারে একটা চুক্তিও করা হয়েছে যে, ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে একটা দুই হাজার কিলোমিটার (১২০০ মাইল) দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মিত হবে এবং তা দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হবে ইউরোপে। এরপর গত বছর তুরস্ক সাইপ্রাসের পশ্চিম দিকে গ্যাসকূপ খনন জোরদার করে। এই এলাকাটি ১৯৭৪ সাল থেকেই বিভক্ত। তুরস্ক-নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাসকে একমাত্র আঙ্কারাই একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জ্বালানি সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা
নিজের নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাসকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিবেচনা করে তুরস্ক। ফলে আঙ্কারার যুক্তি, সাইপ্রাসের প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগি করতে হবে। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্ক লিবিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আঙ্কারার বক্তব্য, এর মাধ্যমে তারা তুরস্কের দক্ষিণ উপকূল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব তীর পর্যন্ত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা তৈরি করেছে।
মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি ক্ষমতা দখলের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এর জের ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আঙ্কারার বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায় মিসরের সিসি সরকার।
লিবিয়ার সঙ্গে তুরস্কের পানিসীমা চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে কায়রো। অন্যদিকে গ্রিস বলছে, আঙ্কারার দাবি অবাস্তব। কেননা, তুরস্ক ও লিবিয়ার মাঝখানে যে গ্রিসের একটি দ্বীপ ক্রিটের অবস্থান - তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
মে মাসের শেষ দিকে তুরস্ক ঘোষণা করে যে তারা আগামী মাসগুলোতে আরও পশ্চিমের কিছু এলাকায় গ্যাস কূপ খনন শুরুর পরিকল্পনা করছে। এ খবরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য গ্রিস ও সাইপ্রাসের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে খনন কাজ চালানোর জন্য টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিকে বেশ কয়েকটি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গ্রিসের রোডস ও ক্রিট দ্বীপের নিকটবর্তী সামুদ্রিক এলাকাও রয়েছে।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে বলেছেন, ‘সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে যে, তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রকে এ অঞ্চলের জ্বালানি সংক্রান্ত সমীকরণের বাইরে রাখা যাবে না।’
আইনি জটিলতাগুলো কী?
পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর এলাকায় গ্রিসের এমন বহু দ্বীপ আছে যা তুরস্কের খুব কাছে এবং উপকূল থেকে দেখা যায়। ফলে এখানে কার সমুদ্রসীমা কোথায়, তা নির্ধারণ করা একটি জটিল ব্যাপার। অতীতে এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেধে যাওয়ারও উপক্রম হয়েছিল।
গ্রিস যদি তার সমুদ্রসীমা ছয় মাইল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১২ মাইল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে তাহলে তুরস্কের যুক্তি অনুযায়ী তার নিজের সমুদ্রপথগুলো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রসীমা ছাড়াও এখানে আছে বিশেষ (এক্সক্লুসিভ) অর্থনৈতিক এলাকা। এর একটি হচ্ছে তুরস্ক আর লিবিয়ার মধ্যে। আরেকটি আছে সাইপ্রিয়ট বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা যাতে রয়েছে লেবানন, মিসর ও ইসরায়েল। এগুলোর সীমা হতে পারে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত।
গ্রিসের কাস্টেলোরিজোর অবস্থান হচ্ছে তুরস্কের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। গ্রিস বলছে, তুরস্ক যে এলাকায় ড্রিলিং জরিপ চালাবে বলে সতর্কবার্তা জারি করেছে; কাস্টেলোরিজোর উপকূলীয় এলাকার অনেকখানি তার মধ্যে পড়ে যায়।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে তাদের যেসব দ্বীপ রয়েছে সেগুলো তুরস্কের খুবই কাছে। তাই তারা তাদের চারপাশের অগভীর সমুদ্র এলাকাকে কন্টিনেন্টাল শেলফ অর্থাৎ তার নিজস্ব স্থলভাগের অংশ বলে দাবি করতে পারে না।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট গত মাসে বলেছেন, তুরস্কের মানুষকে তাদের মূল ভূখণ্ডে আটকে রাখতে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে; আঙ্কারা তা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। তুরস্ক জোর দিয়ে বলছে, তারা জাতিসংঘের সমুদ্র সংক্রান্ত আইন মেনেই কাজ করছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কড়া প্রতিক্রিয়া
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ ব্যাপারে গ্রিসের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস এথেন্স সফরে গিয়ে তুরস্কের প্রতি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় উসকানিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ওই অঞ্চল ঘুরে এসে সাইপ্রাস ও গ্রিসের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি তুরস্ক কর্তৃক দেশটির দুটির ‘সার্বভৌমত্ব লঙঘনের’ কড়া নিন্দা করে বলেছেন, ইইউ'র মেরিটাইম অঞ্চলে যে কেউ হুমকি সৃষ্টি করলে তার ওপর অবশ্যই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
বিশেষত লিবিয়া পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ফ্রান্সের সঙ্গেও তুরস্কের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। ইইউ-এর একজন মুখপাত্র আলোচনা ও পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর জোর দিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি।
