ডেঙ্গু মোকাবিলায় একটি বড় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য নতুন আশার আলো জাগাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল এক ধরনের উলবাকিয়াসংক্রমিত এডিস ইজিপ্টি মশা সফলভাবে তৈরি করেছেন। এটি ঢাকা শহরের স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। এটিকে ‘ভালো মশা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই অগ্রগতি বাংলাদেশকে ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত বা আর্বোভাইরাল ভাইরাস সংক্রমণ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে একটি নিরাপদ, জৈবিক পদ্ধতি ব্যবহারের নতুন দ্বার উন্মোচন করছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআর,বি।
এই গবেষণা দলে রয়েছেন– অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআর বার্গহোফার মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআর,বি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিজ্ঞানীরা। গবেষণাটি সম্প্রতি জার্নাল দ্য নেচারের সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে প্রকাশিত হয়েছে।
আইসিডিডিআর,বি জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য হুমকি। ২০২৩ সালে রেকর্ড সংখ্যক ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ১ হাজার ৭০০ এরও বেশি মৃত্যু হয়; যা এখন পর্যন্ত ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর। নগরায়ন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণ তাপমাত্রা ডেঙ্গুর প্রাথমিক বাহক এডিস মশার বিস্তারকে বাড়িয়ে তুলছে। অন্যদিকে প্রচলিত কীটনাশকনির্ভর মশা নিয়ন্ত্রণে মশাদের মধ্যে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। এ জন্য পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানীরা আরও টেকসই সমাধান খুঁজতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ‘ভালো মশা’ ব্যবহারের কৌশল।
গবেষকদের মতে, উলবাকিয়া ব্যবহারের কারণ হলো, এটি এডিস মশায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করে, কিন্তু মানুষ বা পরিবেশের কোনও ক্ষতি করে না। উলবাকিয়া একটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া; যা প্রজাপতি, ফলের মাছি এবং কিছু মশার দেহে স্বাভাবিকভাবেই থাকে কিন্তু এডিস মশায় থাকে না। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ বা প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে না এবং কামড় বা সংস্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়ায় না।
তাদের মতে, এডিস মশায় উলবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দুটি কৌশলে মশাবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রথমটি হলো দমন কৌশল, যেখানে শুধু পুরুষ উলবাকিয়া মশা বা ভালো মশা পরিবেশে ছাড়া হয়। এই পুরুষরা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়, স্ত্রী মশার ডিম ফোটে না; ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। দ্বিতীয়টি হলো প্রতিস্থাপন কৌশল, যেখানে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ‘ভালো মশা’ ছাড়া হয় এবং উলবাকিয়াআক্রান্ত স্ত্রী মশারা প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ব্যাকটেরিয়া বয়ে বেড়ায় ও ছড়িয়ে দেয়। তারা উলবাকিয়া আক্রান্ত বা আক্রান্ত নয় এমন পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হলেও তাদের বংশধর উলবাকিয়া বহন করে এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত বন্য মশাদের প্রতিস্থাপন করে। এই দুটি কৌশলই বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিস্থাপন কৌশল ব্যবহার করে গত এক দশকে ডেঙ্গু রোগ ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও মশা কমানোর পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সফলতা দেখা গেছে।
গবেষণা দলটি স্ট্রেইনের ডেঙ্গু প্রতিরোধ ক্ষমতা মূল্যায়ন করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, উলবাকিয়াযুক্ত এই মশাগুলো উলবাকিয়াবিহীন সাধারণ মশার তুলনায় ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতা ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম। গবেষকরা পরীক্ষাগারের খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় এই মশাগুলোর বিভিন্ন দিকও পরিমাপ করেছেন, যেমন- প্রজননক্ষমতা (ডিমের সংখ্যা), উর্বরতা (ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার হার) এবং টিকে থাকার ক্ষমতা (২৮ দিন পর মৃত মশার অনুপাত)। দেখা গেছে, ঢাকার জন্য অভিযোজিত এই ভালো মশাগুলো টিকে থাকা ও প্রজননের ক্ষেত্রে স্থানীয় মশাগুলোর সমান সক্ষম, যা পরিবেশে এদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘পরিবেশে মশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত নয়। এগুলো হলো ভালো মশা, যাদের দেহে থাকে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী। উলবাকিয়া অনেক দেশেই নিরাপদে ব্যবহার হয়েছে এবং এটি ডেঙ্গু ও অনুরূপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি প্রতিরক্ষার পথ খুলে দিতে পারে।’
এই গবেষণার প্রধান লেখক হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, ‘এই গবেষণা বাংলাদেশের জন্য মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পরীক্ষাগারের ফলাফল আশাব্যঞ্জক, তবে বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য সতর্ক পরিকল্পনা ও পরীক্ষা প্রয়োজন। ডেঙ্গু ছাড়াও এই ভালো মশা অন্যান্য উদ্ভবশীল ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। উলবাকিয়া জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের সংক্রমণও প্রতিরোধ করতে সক্ষম বলে প্রমাণ রয়েছে।’
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘উলবাকিয়াযুক্ত ভালো মশা ব্যবহারের এই সম্ভাবনাময় পদ্ধতির সফল প্রয়োগে পূর্ববর্তী আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত। মাঠপর্যায়ের সফল পরীক্ষার পরেই কেবল এটিকে ব্যাপকভাবে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা উচিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ডেঙ্গু টিকা গবেষণায়ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। স্থানীয় পরীক্ষার মাধ্যমে টিকা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী; যা দেশের ডেঙ্গু সমস্যার একটি সমন্বিত সমাধান দিতে পারবে।’