ঢাকা মহানগরীতে মশার দাপট এখন আর ঋতুভিত্তিক কোনও বিষয় নয়, বরং বছরজুড়ে চলমান এক নাগরিক সংকটে রূপ নিয়েছে। দিনের বেলায় ডেঙ্গু রোগবাহী এডিস, আর সন্ধ্যার পর কিউলেক্সের আক্রমণে অতিষ্ঠ নগরবাসী। বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণের সংখ্যা। যদিও বিশেষজ্ঞরা এতে শঙ্কিত না হয়ে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের—তারা করছে কী?
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, প্রতিদিন ঘরে-বাইরে মশার কামড়ে শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ জ্বর, চুলকানিসহ আরও কিছু রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে একদিকে ডেঙ্গু আতঙ্ক, অপরদিকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে অস্বস্তির।
মশাবাহিত রোগে মৃত্যুহার উদ্বেগজনক
এদিকে মশা যে নাগরিক জীবনের জন্য কতটা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, তা বিগত কয়েক বছরের ডেঙ্গু জ্বরে মারা যাওয়ার জরিপেই উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭৫ জন, ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭০৫। চলতি বছরেও জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪১১ জন। এর মধ্যে চার হাজার ৯০৭ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। আর এ বছর ডেঙ্গু রোগে মারা গেছেন ২৩ জন।
বরাবরের মতো মশা নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দুই সিটির
মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর শত কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস আসে। এরপরও মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও পরিবর্তন দেখা যায় না। বরাবরের মতো এবারও নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন।
এ বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এডিস মশার বিস্তার রোধে তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে দৈনিক দ্বিগুণ হারে কীটনাশক ছিটানোর ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ১৪ জুন থেকে ডিএসসিসি এলাকায় দৈনিক এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমে (ফগার মেশিন ব্যবহার করে) বর্তমানের বরাদ্দ ৩০ লিটারের পরিবর্তে ৬০ লিটার কীটনাশক ব্যবহার করবে।
এছাড়া মশককর্মীদের সকাল ও বিকালের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং কীটনাশক সঠিক অনুপাতে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত যাচাই করবে সংস্থাটি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি থেকে আরও জানানো হয়, বাড়ির ভেতর, আঙিনা ও ছাদের জমে থাকা পানির উৎসগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয়েছে অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং টিম। এছাড়া মশক নিধনে জনবল ঘাটতি পূরণে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এর বাইরে জনসচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনও বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি। চলতি মাসে আরেকটি সভাও করবে সংস্থাটি।
গত ১১ জুন অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘এডিস মশার বিস্তার রোধে আমরা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ১৪ জুন থেকে নতুন কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়ন শুরু হবে।’
অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে। হ্যান্ড-মাইক ও মেগাফোনের মাধ্যমে বার্তা প্রচারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এজন্য ৬ সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
ডিএনসিসি থেকে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ইউনিট চালুর জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রশাসক। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদনে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করা হবে এবং এক সপ্তাহ পরও লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে।
ডেঙ্গু বিষয়ক এক সভায় ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, মশকনিধন কর্মীদের কাজের গতি বাড়াতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের বিল সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট বন্ধ হয়। তবে দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির চুক্তিও বাতিল করা হবে। পাশাপাশি, খাল পরিষ্কারসহ মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে নগর কর্তৃপক্ষ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ডিএনসিসি।
অতিষ্ঠ নাগরিকরা, কার্যকর উদ্যোগের আশ্বাস
রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় মশার আধিক্য চরমে। সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় অতিষ্ঠ নগরবাসী চান কার্যকর উদ্যোগ।
মিরপুর ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা আজহার উদ্দিন বলেন, সন্ধ্যা হলে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। এমনিতেই তীব্র গরম, তার ওপর দরজা জানালা বন্ধ করলে যেন সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এত কিছুর পরেও মশা থেকে রক্ষা নাই। হাত-পা চুলকাতে চুলকাতে আমার স্ত্রী ও মেয়ের শরীরে দাগ বসে গেছে।’
মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা নাইম বলেন, বাইরে এসে একটা জায়গায় বসা যায় না, দাঁড়ানো যায় না। ঘরের ভেতরে সন্ধ্যার পর থেকে কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। তবু মশা দূর হয় না, অতিরিক্ত মশা বাড়ছে। এখন সিটি করপোরেশনের দিকে তাকিয়ে তো লাভ নেই। আল্লাহ ভরসা, তিনি যদি বাঁচিয়ে রাখেন।
ভয়াবহ অবস্থা ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোতে। উত্তরখান, দক্ষিণখান ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে খোলা খাল থাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে কয়েকগুণ। এ নিয়ে নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ তুলছেন স্থানীয়রা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নগর উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতির জন্য একদিকে নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, অপরদিকে নাগরিক অসচেতনতাও দায়ী।
সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশনে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত সভায় তারা পরামর্শ দিয়েছেন—মশা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধানের জন্য কেবল কীটনাশক নয়, প্রয়োজন নগরবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধি, পাশাপাশি আইন প্রয়োগ এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযানে সুশৃঙ্খল তদারকি।
ডেঙ্গু মোকাবিলার বিষয়ে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি গতানুগতিক অবস্থায় আছে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থাৎ সব জায়গায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কিট থাকা দরকার, যাতে দ্রুত এটি শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিচালনা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনও এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে তার এক কিলোমিটার এলাকায় বেশি নজর দিতে হবে। কারও জ্বর আছে কিনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কী অবস্থা, এগুলো সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু সেটা এখন হচ্ছে না। রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়ার চেয়ে রোগী কমানোর টার্গেট করা দরকার।