X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

পুরান ঢাকার অলিগলিতে: লালবাগ রোডের চা আর আড্ডা

সোহেলী তাহমিনা
১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:০২আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৯:২৪

সুলতানি, মোগল, নবাবি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের পর আমাদের প্রাণের ঢাকা শহর ৪০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। ইতিহাসের কিছু কিছু অংশের প্রভাব কোথাও খুব বেশি, কোথাওবা একেবারেই নেই। ইতিহাস ও আধুনিকতাকে একসঙ্গে বয়ে চলেছে এই শহরের বিশেষ অংশ পুরান ঢাকা। এখানে ইতিহাস এখনও কথা বলে, ঐতিহ্য সগৌরবে মাথা উঁচু করে চলে। এই পুরান ঢাকার ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক স্থান, সংস্কৃতি খাবার নিয়ে জার্নির ধারাবাহিক আয়োজন।

বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পুরান ঢাকার বিস্তৃতি সামান্য। কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে আর নিজ গুণে খ্যাতি লাভ করা কয়েকটি রেস্তোরাঁতে পুরান ঢাকা সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন ইমারত। এসবের ইতিহাস প্রায় বিলুপ্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ভবন সরকারের অধীনে। কিছু ভবন অবশ্য ব্যক্তিমালিকানাধীন। আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই। তবুও প্রতিনিয়ত সংস্কারবিহীন এসব ভবনে বসবাস করছে মানুষ।

পুরান ঢাকা ঐতিহ্যের পাশাপাশি খাবারের জন্যও প্রসিদ্ধ। কিন্তু বিরিয়ানি ও ব্র্যান্ডেড রেস্তোরাঁর বাইরেও চমৎকার খাদ্যসামগ্রীর পসরা ছড়িয়ে রয়েছে এর আনাচে-কানাচে। এসব খাবারের পেছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে, সেই মালিক বা রন্ধনশিল্পীদের (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুটি ভূমিকাতে একই মানুষ রয়েছেন) কেউই প্রচারণায় আগ্রহী নন। তবে ঠিক প্রচারবিমুখও নন, কিন্তু প্রচারেই প্রসারে তারা আগ্রহী নন। যেমন চলছে, ভালোই তো!

সাগর খাবার ঘর নিউ মার্কেট পেরিয়ে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু এগোলেই লালবাগ রোড। এখানকার ল্যান্ডমার্ক ‘ছাপড়া মসজিদ’ থেকে একটু ভেতরের দিকে এগোলেই ভাজাভুজি খাবারের তিন-চারটি দোকান প্রায় পাশাপাশি দেখা যায়। এর মধ্যে সাগর খাবার ঘরে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। আমি এখানে নিয়মিতই বলা চলে। দোকানটিতে বিরিয়ানি বা পোলাও আর মিষ্টি জাতীয় তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। তবে সকালের দিকে খিচুড়ি আর নাশতায় পরোটার সঙ্গে সুজির হালুয়া থাকে। ভাত-ডাল-তরকারিও আছে। এছাড়া ভাজাভুজি সবই মিলবে। যারা একটু ঝোলসহ বটভুনা পছন্দ করেন, তারা এখানে আসতে পারেন। খাবারের দামও বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানকার বেশিরভাগ ক্রেতা নিয়মিত, ওয়েটাররাও তাদের চেনে। সেবার মানও উন্নত।

যদিও এখানকার খাবারের স্বাদ প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে আছে। তবে চায়ের দিক থেকে এটি একই ধরনের অন্যান্য রেস্তোরাঁর চেয়ে এগিয়ে। যদিও চায়ের মান ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। আড্ডাবাজরাই মূলত সাগর খাবার ঘরে বেশি আসে। চা-প্রেমীদের জন্য পুরান ঢাকার অলিগলিতে অসংখ্য টং বা আরও ছোট আকারের দোকান আছে। সার্বিক পরিবেশ ও সেবার মানের জন্যই এগুলোতে ভিড় হয় বলা চলে। আড্ডা ও আলোচনার জন্য এসব টং দোকান বেশ সুবিধাজনক স্থান। বটতলা থেকে সোজা এগিয়ে এলে হাতের বাঁ-দিকে পড়বে শেখ সাহেব বাজার দোতলা মসজিদ আর ডানদিকে বেশকিছু ছোট ছোট দোকান। সেগুলোতে চা-সহ বিভিন্ন দৈনন্দিন সামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে।

ফজর থেকে জোহর পর্যন্ত খোলা থাকে এই চায়ের দোকান শেখ সাহেব বাজার দোতলা মসজিদের কাছে প্রথম দোকানটি ভোরে ফজরের আজানের একটু পরেই খুলে যায়। নামাজের পরপরই এখানে চা-সহ বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট ও রুটি পাওয়া যায়। এই দোকান বন্ধ হয় দুপুর সাড়ে ১২টায় অর্থাৎ জোহরের নামাজের আগে। পুরান ঢাকার স্বাভাবিক নিয়মের ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় একটি ব্যতিক্রম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৃদ্ধ মালিক নিজেই একা এখানে কাজ করেন। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে একই নিয়মে দোকানটি চালিয়ে আসছেন তিনি। ব্যতিক্রম হয়নি কখনও। এই দোকানের আগে ৭৯টি রিকশাসহ একটি গ্যারেজের ব্যবসা ছিল তার। ৪০টি রিকশা চুরি হয়ে গেলে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এ কারণে নিজেই বাকি ৩৯টি বিক্রি করে দিয়ে চায়ের দোকান শুরু করেন। চায়ের স্বাদ মোটামুটি। কিন্তু সাতসকালে আশেপাশের সব দোকান যখন বন্ধ, তখন পথচারী ও শ্রমিকসহ সবার চায়ে চুমুক দিতে এর জুড়ি নেই।

দোকানে কর্মব্যস্ত মনির হোসেন ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে আরেকটি ছোট দোকান। এখানকার রং-চা বেশ! তবে প্রায় দেড় মাস ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমার কাছে লালবাগ রোডে যেকোনও ধরনের চায়ের জন্য সেরা মনে হয়েছে ‘মনির ভাই’-এর দোকান। এখানে শীতকালে সকাল-সন্ধ্যায় খাঁটি খেজুরের গুড়ের তৈরি দুধ-চায়ের কোনও বিকল্প এখনও পাইনি। সবসময় ভিড় লেগে থাকা ছোট্ট দোকানটি আড্ডার জন্যও সবার পছন্দের। মনির ভাইয়ের ব্যবহার অমায়িক। তিনি কখনও ‘চা বানাচ্ছেন না’ এমনটা দেখিনি। সকাল থেকে রাত ১২টা অবধি লাল রঙের টিন দিয়ে ঘেরা একাধারে তিনটি কেতলিতে তার কার্যক্রম চলছেই। ১০ বছর ধরে একই চিত্র। শুধু সামান্য স্থান পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ দিনে অবশ্য তার দোকান বন্ধ থাকে। এই তিনটি দোকানেই যেকোনও ধরনের চায়ের দাম প্রতি কাপ ৫ টাকা।

বিসমিল্লাহ ফাস্ট ফুড মনির ভাইয়ের দোকান থেকে একটু এগোলেই হাতের বাঁ-দিকে পড়বে কাশ্মিরী টোলা। সেদিকে না গিয়ে বরং সামনে এগিয়ে একইরকম দোকানের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে পড়বে ‘ছোট ভাঁট মসজিদ’, তারপর ‘বড় ভাঁট মসজিদ’। বড়টির প্রায় গা-ঘেঁষেই রয়েছে লালবাগ রোডের আরেক চমক বিসমিল্লাহ ফাস্ট ফুড। অত্যন্ত ছোট দোকান এটি। এখানকার ফাস্ট ফুড বেশ সাশ্রয়ী। এর গুণগত ও স্বাস্থ্যগত মান দারুণ। পুরান ঢাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার মুড়ি ভর্তা। এই ফাস্ট ফুডে মুড়ি ভর্তা ১০ টাকা প্লেট, বার্গার ২০ টাকা, চিকেন সাসলিক ২০ টাকা, নুডলস্ ১৫ টাকা প্লেট ও স্যুপ ৩০ টাকা বাটি। এখন পর্যন্ত এগুলোই খেয়েছি এখানে। পরিমাণ অনুযায়ী দামের তারতম্য রয়েছে। প্রতিটি খাবারই তুলনামূলক স্বল্প তেল-মসলায় তৈরি।

বিসমিল্লাহ ফাস্ট ফুডে বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা-১২টা পর্যন্ত সবসময়ই ভিড় দেখা যায়। তবে সব খাবার সবসময় পাওয়া যায় না। ক্রেতা চাহিদার কারণে ফুরিয়ে যায়। দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা হাজী মো. আমান উল্লাহ। একসময় একই ধরনের আরও তিনটি দোকান থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে এসে এই একটিই চালাচ্ছেন তিনি। সন্ধ্যার পর নাতিসহ কিছু সময়ের জন্য তিনি এখানে এসে বসেন। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক কর্মী এটি পরিচালনা করে থাকে।

ক্রিসেন্ট ক্লাব ও হাজী মো. আমান উল্লাহ প্রায় ৫০ বছর আগে কর্মজীবনের শুরুতে একই রোডে পান-বিড়ির দোকান ছিল হাজী সাহেবের। এই রোডে অবস্থিত ক্রিসেন্ট ক্লাবেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৪৫ সাল থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কার্যাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত এটি। তরুণদের পাশাপাশি বয়স্করাও এই ক্লাবে আড্ডা দেন। এখানে নারীদের জন্য আলাদা সেবা ও সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

* লালবাগ রোডেরই আরও কিছু চমক নিয়ে আগামী সপ্তাহে থাকবে পরের কিস্তি।

ছবি: লেখক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
অর্থ আত্মসাতের মামলাড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
তিন ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো রাজবাড়ীর ট্রেন চলাচল
তিন ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো রাজবাড়ীর ট্রেন চলাচল
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি