গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি। এ ধরনের বাসস্থান শীত ও গরমের সময় বেশ আরামদায়ক। একসময় গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক টাকা-পয়সা ব্যয় করে মাটির বাড়ি তৈরি করতেন। তবে ইট, বালি ও সিমেন্টের আধুনিকতায় মাটির বাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামে রয়েছে ৩৩ বছর আগে বানানো ১০৮ কক্ষের একটি মাটির বাড়ি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এটি দেখতে আসেন।
নাটোর থেকে সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন সাব্বির হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লোকমুখে ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়িটির কথা শুনেছি। মাটি দিয়েও দোতলা বাড়ি বানানো যায় তা নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগের ধারণাই নেই। তাই সন্তানদের এটি দেখাতে নিয়ে এসেছি। এখানে না এলে জানতামই না মটি দিয়ে এত সুন্দর বাড়ি তৈরি করা সম্ভব।’
চেরাগপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবু শ্রী শবিনাথ মিত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানালেন, ১৯৮৬ সালে তিন বিঘা জমির ওপর এই মাটির বাড়ি তৈরি হয়। এর দৈর্ঘ্য ৩০০ ফুট ও প্রস্থ ১০০ ফুট। এটি দেখতে অনেকটা রাজপ্রাসাদের মতো। ৩৩ বছর আগে মাটির দোতলা বাড়িটি নির্মাণ করেন দুই সহোদর সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল। তিনি মনে করেন, সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে এই বাড়ি একটি পর্যটন স্পট হতে পারে।
মহাদেবপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোবারক হোসেন পারভেজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মাটির বাড়ি এটাই। এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেই আমরা। বাড়িটি দেখতে এসে পর্যটকরা রাতে থাকতে চাইলে উপজেলা প্রশাসন থেকে ডাকবাংলোর ব্যবস্থা করে দেই। ভ্রমণপ্রেমীদের বিশ্রামের জন্য বাড়িটিকে ঘিরে অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
বাড়িটির মালিক মৃত তাহের আলী মণ্ডলের ছেলে মাসুদ রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আমার বাবা ও চাচা উভয়ে শৌখিন মানুষ ছিলেন। তারা ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। আজ দু’জনের কেউ বেঁচে নেই। বাবা চার বছর আগে মারা গেছেন। আর চাচা মারা গেছেন ১০ বছর আগে। তবে তাদের এই স্মৃতি এখনও আছে।’
জানা গেছে, ৯৬টি বড় ও ১২টি ছোট কক্ষ রয়েছে বাড়িতে। এটি দেখার জন্য প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের সমাগম ঘটে। এর সৌন্দর্যবর্ধনে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে মাটির দোতলা বাড়ি নির্মাণ করতে ৯ মাস সময় লাগে। তবে তাহের আলী মণ্ডলের ছেলে জানান, এই বাড়ি বানাতে লেগেছিল প্রায় এক বছর। সেই সময় এর পেছনে কাজ করেছিল শতাধিক শ্রমিক। বাড়িসহ আশেপাশে তাদের মোট ২১ বিঘা জমি রয়েছে। বাড়িটি তৈরির জন্য একটি বিশাল পুকুর খনন করতে হয়েছিল।
আলিপুর গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, মাটির বাড়ি বানাতে মাটি, খড় ও পানি ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করতে হয়। তারপর ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল দিতে হয়। এই দেয়াল বানানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ একসঙ্গে বেশি উঁচু করে মাটির দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল বানাতে হয়। কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে এর ওপর একই উচ্চতার দেয়াল গড়ে তোলা যায়।
সমশের আলী মণ্ডলের স্ত্রী ফাতেমা বেওয়ার তথ্য অনুযায়ী, পায়ে হেঁটে একবার বাড়ির চারধারে ঘুরে আসতে ৭-৮ মিনিট লেগে যায়। ১০৮ কক্ষের এই বিশাল বাড়িতে প্রবেশের দরজা আছে ৭টি। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। তবে যেকোনও একটি দরজা দিয়ে যাওয়া যাবে ১০৮ কক্ষেই।