X
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২
ট্রাভেলগ

মুক্তাগাছায় একদিন ঘোরাঘুরি

সোহেলী তাহমিনা
০৭ মার্চ ২০১৯, ১৮:০০আপডেট : ০৭ মার্চ ২০১৯, ১৮:২১

মুক্তাগাছা আটআনি জমিদার বাড়ির হাওয়াখানা ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তারাম কর্মকার নামে একজন বাসিন্দা ছিলেন। তিনি পিতলের তৈরি হাতলওয়ালা একটি লণ্ঠন নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে (নাটোর বা বগুড়া) আসা জমিদারদের স্বাগত জানান। হাতলটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘গাছা’ বলা হয়। তার এমন আতিথেয়তায় খুশি হয়ে জমিদারেরা এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ‘বিনোদবাড়ি’ পরিবর্তন করে ‘মুক্তাগাছা’ রাখেন।

ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল মোড় থেকে সারাদিনই মুক্তাগাছা ও জামালপুর যাওয়ার জন্য সিএনজি চালিত অটো ভাড়া নেওয়া যায়। রিজার্ভ করে গেলে মোটামুটি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা গুনতে হবে। দর কষাকষি করে খুব একটা লাভ নেই। সেখানে অটোচালকদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। খালা আর আমি অটো রিজার্ভ করিনি। জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া হিসেবেই গিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ থেকে মুক্তাগাছা যেতে মোটামুটি ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে।

জোড়া মন্দির মুক্তাগাছা বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে রাজবাড়ি যেতে ২০ টাকায় রিকশা ভাড়া করি। খুব অল্প সময়েই আমরা সেখানে পৌঁছাই। এটাই মুক্তাগাছার পর্যটনের কেন্দ্রস্থল বলা চলে। অবাক করা বিষয় হলো, এখানকার সব দর্শনীয় স্থান এই জমিদার বাড়ি থেকে ২-৩ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত। শহরজুড়েই আছে অসংখ্য মন্দির ও মিষ্টির দোকান। তবে ভ্রমণপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রাজবাড়িটি ও বিখ্যাত মণ্ডার দোকান একটিই আছে। যদিও প্রায় একই ধরনের রেসিপি অনুসরণ করে অন্যান্য দোকানেও মণ্ডা তৈরি হয়ে থাকে। তবে স্বাদ নিঃসন্দেহে ভিন্ন।

সরকারি শহীদ স্মৃতি কলেজ বর্তমানে সরকারি তত্ত্বাবধানে এই জমিদার বাড়ির সংস্কার কাজ চলছে। কিন্তু সেজন্য ঘুরে দেখায় কোনও বাধা পড়ে না। হয়তো আর মাস দুয়েক পর রাজবাড়িটির পুরনো জৌলুসের অনেকটাই আবারও দেখা যাবে। বকশিশের বিনিময়ে জমিদার বাড়ির পুরো ইতিহাস পর্যটকদের বিস্তারিত জানানোর জন্য মূল ফটকেই থাকেন অভিজ্ঞ গাইড। সাধারণত টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। তবে জমিদার বাড়িতে ডকুমেন্টারি বা রিপোর্টের কাজে গেলে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে লিখিত অনুমতি নিতে হবে।

রথ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তাগাছায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৫০-৬০ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তাগাছার আটআনি অঞ্চলের এই জমিদার বাড়িটি গড়ে তোলা হয়। অর্থাৎ এটি প্রায় ২৮০ বছরের পুরনো। জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে আছে নাটমন্দির, দুর্গামন্দির, রাজ রাজেশ্বরী মন্দির, তোষাখানা, লোহার নির্মিত দ্বিতল হাওয়াখানাসহ বেশ কয়েকটি ভবন। নাটমন্দিরের পশ্চিমাংশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চায়নের জন্য একসময় ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ছিল। এই অঞ্চলের দ্বিতীয় ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ভাবা হতো সেটিকে। অন্যটি কলকাতায় অবস্থিত। আমাদের জানানো হয়, মঞ্চটি পুনরায় স্থাপনের জন্য সব ধরনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ইতোমধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। সংস্কার কাজ শেষ হলে আবারও ওই মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে বলে আশা করা যায়।

হর রামেশ্বর মন্দির ও জোড়া মন্দির জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে বাঁ-দিকে তাকালেই দেখা যায় পাথরের শিব মন্দির। আর ঠিক ডানেই সরকারি শহীদ স্মৃতি কলেজ। এই ভবনও জমিদার বাড়ির একটি অংশ ছিল বলে শোনা যায়। কলেজের সামনের দিকে এগোলে ডানদিকে চোখে পড়বে জরাজীর্ণ পুরনো ভবন। এটি তৈরি করেছিলেন জমিদারেরা। বিপজ্জনক অবস্থায় এসব ভবনে এখনও বেশ কয়েকটি পরিবার বসবাস করছে। এর ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে ‘তিন শিব মন্দির’।

মুক্তাগাছা আটআনি জমিদার বাড়ি আরেকটু সামনে এগিয়ে বাঁ-দিকে গেলেই ডানদিকে রয়েছে ‘জোড়া মন্দির’। এর একটি ‘কালী মাতা মন্দির’, অন্যটি ‘শ্রী শ্রী আনন্দময়ী শিব মন্দির’। বাঁ-দিকে রয়েছে বিষ্ণুভক্ত হিন্দু ইসকন সম্প্রদায়ের ‘হর রামেশ্বর মন্দির’। এখান থেকেই মুক্তাগাছার রথযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে। জোড়া মন্দির প্রাঙ্গণে পুকুরের ধার ঘেঁষে একটি ছোট ব্রক্ষ্মা মন্দিরও আছে। এর উল্টোদিকে পুকুরের আরেক কোণে বর্তমানে একটি দুর্গা মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন জমিদার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর মা শ্রীমতি বিমলা দেবী এই জোড়া মন্দির তৈরির উদ্যোগ নেন। হিন্দু ‘রবিদাস সম্প্রদায়’ কার্তিক মাসে এই মন্দিরে দুই দিনের ‘কাত্যানী পূজা’র আয়োজন করে থাকে। স্থানীয়ভাবে এটি ‘সাত পূজা’ নামেও পরিচিত। ১৯৯৩ সালে মুক্তাগাছার আটআনি জমিদার বাড়ি ও পার্শ্ববর্তী চারটি মন্দির বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গোপাল পালের মণ্ডার দোকান কলেজের ঠিক উল্টোদিকের পথ ধরে সোজা এগোলেই রয়েছে মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান। আমরা সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে তারপর মিষ্টিমুখ করতে গিয়েছিলাম। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে শ্রী রাম গোপাল পাল এই মণ্ডা তৈরি করে তৎকালীন জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীকে পরিবেশন করেন। জমিদার খাবারটি এতই পছন্দ করেন যে, সেই সময় থেকে রাজপরিবারের অতিথিদের আপ্যায়নে মণ্ডা দেওয়া হতো। তখন থেকেই দোকানটি ‘গোপাল পালের মণ্ডার দোকান’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। রাজপরিবার এই মণ্ডা ব্যবসার সম্প্রসারণে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছিল।

মুক্তাগাছা আটআনি জমিদার বাড়ি ও এর ফলকলিপি প্রায় ২০০ বছর ধরে পাল পরিবারের সদস্যরা একইভাবে মণ্ডা তৈরি করে যাচ্ছেন। পরিবারটির পঞ্চম প্রজন্মে শ্রী রামেন্দ্রনাথ পাল ও তার ভাইয়েরা মিলে এটি পরিচালনা করছেন। প্রতিটি মণ্ডা ২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। দোকানের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে কাঠের তৈরি গোপাল পালের মূর্তি। সেখানে বসে মণ্ডা খাওয়া যায়, চাইলে প্যাকেট করে নিয়েও যাওয়া যায়। দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক ও মিষ্টিপ্রেমী প্রতিদিন এই দোকানে ভিড় করেন। মণ্ডা খেয়ে ও সঙ্গে করে নিয়ে আমরা ময়মনসিংহ শহরে ফিরে আসি।

ছবি: লেখক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্বপ্নের সাদা জার্সিতে ২৫ বছর
স্বপ্নের সাদা জার্সিতে ২৫ বছর
হলের ছাদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাফ
হলের ছাদ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাফ
ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ? দূর করার ৬ উপায় জেনে নিন
ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ? দূর করার ৬ উপায় জেনে নিন
খাগড়াছড়িতে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারিসহ ৬ নির্দেশনা
খাগড়াছড়িতে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারিসহ ৬ নির্দেশনা
সর্বাধিক পঠিত
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’