X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

দরবেশ কুতুবের মসজিদে

জাকারিয়া মণ্ডল
১৩ মার্চ ২০২০, ১২:৫০আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২০, ১৮:০৬

পাঁচ পীরের মাজারের পেছনে কুতুব শাহ মসজিদ (ছবি: অনিক খান) সকাল থেকেই টিপটিপ ঝরছিল। দুপুর নাগাদ ঝুম বৃষ্টি নামলো অষ্টগ্রামের আকাশে। কারও মতে, আটটি গ্রাম নিয়ে গঠিত বলে এই জনপদের নাম অষ্টগ্রাম। চতুর্দশ শতকে শাহজালালের সঙ্গী কুতুব শাহসহ আটজন আউলিয়া এখানে এলে তাদের নামে ‘অষ্টগ্রাম’ নামকরণ হয় বলেও মত মেলে।

১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত জেমস রেনেলের মানচিত্রে ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি স্থানের সঙ্গে আটগাঁও নামে অষ্টগ্রামের অবস্থান দেখানো হয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ লিটারেরি মানচিত্রেও অষ্টগ্রাম লেখা হয়েছে।

এ জনপদের পূর্বে মেঘনার ওপাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগর ও হবিগঞ্জের লাখাই, উত্তর ও পশ্চিমে ধনু নদীর পাড়ে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন ও ইটনা এবং দক্ষিণে ঘোড়াউত্রার ওপাশে বাজিতপুর। অষ্টগ্রামকে তাই হাওরের মধ্যবর্তী জনপদ বলা চলে। জলবেষ্টিত ভূখণ্ডে সবসময়ই খোলা হাওয়া খেলে বলে এখানকার বৃষ্টিটা বেশ শীতল। সেই বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিচ্ছে ঐতিহাসিক এক মসজিদ। অনিন্দ্যসুন্দর তার রূপ। দেয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে রেখেছে ইতিহাস, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি।

অটুট আদি কাঠামোতে সুলতানি ও মোগল আমলের নির্মাণশৈলীর মিশেল। তাই এর নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ আছে। কারও মতে, সুলতানি আমলের শেষদিকে এটি নির্মিত। পরবর্তী সময়ে মোগল সংস্কারের প্রলেপ পড়েছে আদি কাঠামোতে। কেউবা এটিকে পুরোপুরি মোগল আমলেরই স্থাপনা মনে করেন। সিলেট থেকে আসা বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহ এই মসজিদ নির্মাণ করেন বলে জনশ্রুতি প্রচলিত। তাই এটি কুতুবশাহ মসজিদ নামে পরিচিত।

পশ্চিম দিক থেকে কুতুব শাহ মসজিদ (ছবি: অনিক খান) মসজিদটির কাঠামো আয়তাকার। উত্তর-দক্ষিণে ১৪ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে আট মিটার দীর্ঘ। ছাদ জুড়ে পাঁচটি গম্বুজ। মাঝেরটি তুলনামূলক বড়। কার্নিশগুলো বাংলার চৌচালা ঘরের চেয়েও অধিক বাঁকা। পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়াল প্রায় দেড় মিটার, উত্তর ও দক্ষিণের দেয়াল প্রায় সোয়া এক মিটার প্রশস্ত। পশ্চিম দেয়ালের ভেতরের দিকে তিনটি মিহরাব।

বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির চিত্রফলকের অলঙ্করণ, প্যানেলের কারুকাজ। চারটি কোণে আট কোণা মিনার বা ট্যারেট। বলয়াকারের স্ফীতরেখায় অলঙ্কৃত। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে মোট সাতটি প্রবেশপথ। প্রতিটিতেই অর্ধ বৃত্তাকার খিলান। সেই ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দেই এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে।

আটকোণা মিনারের গায়ে অলঙ্করণ (ছবি: অনিক খান) পাঠোদ্ধারের আগেই শিলালিপি হাপিস হয়ে যাওয়ায় এই মসজিদ নির্মাণের সাল নিশ্চিত হওয়া যায় না। ‘গ্লিমসেস অব ঢাকা’ গ্রন্থে সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর লিখেছেন, ঈসা খাঁ’র সঙ্গে যুদ্ধে জিতে ১৫৭৬ থেকে ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগলরা অষ্টগ্রামে থাকে। তাই ‘অষ্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে আবুল কাসেম মনে করেন, ওই সময়েই গড়ে তোলা হয় মসজিদটি। অধ্যাপক আহমদ হাসান দানিও মনে করেন, ষোড়শ শতকের শেষদিকে এই মসজিদ নির্মিত।

মসজিদের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণ (ছবি: অনিক খান) কিন্তু ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া মসজিদটি মোগল আমলের প্রথম দিকে নির্মিত বলে অনুমান করেছেন। তার মতে, পাঠান রাজত্বের শেষ দিকে ঈসা খাঁ মসনদ-ই-আলা ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। এখানে মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সুবেদার ইসলাম খানের আমলে, ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। তাই মোগল অধিকারের পরে যদি এটি নির্মিত হয়ে থাকে তাহলে তা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় দশকের আগে হতে পারে না। আর যদি ঈসা খাঁর আমলে এই মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে তবে তা ষোড়শ শতকের শেষ দশকে হতে পারে।

তবে মোগল বিদ্বেষী বারো ভূঁইয়া নেতা ঈসা খাঁর আমলে নির্মিত মসজিদে এত বেশি মোগল প্রভাব থাকার কথা নয়। এতে অতিসঙ্গত কারণেই ধারণা করা যায় যে, মসজিদটি মোগল আমলের গোড়ার দিকে নির্মিত। খুব সম্ভবত সেই অঞ্চলের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মধ্যে সুলতানি আমলের স্থাপত্যকৌশলের ধারা তখন পর্যন্ত টিকে ছিল। তাই এতে সুলতানি আমলের প্রভাব বিদ্যমান।

কুতুব শাহ মসজিদের সামনে পাঁচ পীরের মাজার (ছবি: অনিক খান) মসজিদের দক্ষিণে একসারিতে পাঁচটি পাকা কবর। অনুচ্চ বেদীর ওপরে নির্মিত। কবরের দেয়ালে ক্ষয়ে যেতে যেতে পোড়ামাটির কিছু অলঙ্করণ তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এগুলো পাঁচ পীরের মাজার বলে পরিচিত। ভক্তরা তাই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখেন।

বৃষ্টি থামলেও মসজিদ, মাজার সারির দেয়াল ভিজে সপসপে। মাজারের বেদিও সিক্ত। গলে জমে যাওয়া মোম আরও যেন আঁট বেঁধেছে বৃষ্টি শুষে। বৃষ্টিধোয়া লাল দেয়ালে দ্যুতি ঠিকরোচ্ছে।

মাজারের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণ (ছবি: অনিক খান) অনতিদূরে একটি একক কবর। ওপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির ছাঁট পড়েনি এর গায়ে। শুকনো কাপড়ের নিচে ঢাকা পড়া বাঁধানো কবরে কুতুব শাহ শায়িত বলে জনশ্রুতি প্রচলিত। স্থানীয় সংস্কৃতিতে তার প্রভাব ব্যাপক। তার নামের দোহাই দিলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায় সমাজে! কুতুব শাহের নিষেধ থাকায় এখনও গাভী দিয়ে হাল চাষ করে না অষ্টগ্রামের মানুষ।

মসজিদের উল্টো দিকে সরু রাস্তার ওপাশে একটা দীঘি। এখান থেকে কষ্টিপাথরের একটি মূর্তি উদ্ধারের কথা উল্লেখ আছে ‘অষ্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে। দীঘি ও মসজিদের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তাটা ধরে খানিক এগোলে হাতের বাঁয়ে দেখা যায় বিশাল দীঘি। বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাখা পাড় পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওপাড়ে বিশাল বট। তার ওপাশে হাবেলি বা হাওলি বাড়ি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মুহররম অনুষ্ঠান হয় এখানে। শিয়া নয়, এটি সুন্নিদের অনুষ্ঠান। এতে শরিক হয় হিন্দুসহসব সম্প্রদায়ের মানুষ। শরীরে শেকল পেঁচিয়ে খোলা তরবারি হাতে মাতে শোকের মাতমে। ‘হায় হাসান, হায় হাসান’ আহাজারিতে তখন ভারী হয়ে ওঠে অষ্টগ্রামের আকাশ।

সাধক আলাই মিয়া অনুষ্ঠানটির সূচনা করেন। সিলেট জয়ের পর তরফ জয়ে শাহজালাল যাকে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সেই নাসির উদ্দিন সিপাহসালারের বংশধর বলে বিবেচিত। হাবেলি বাড়ির জামাই হয়ে আসেন তিনি। হাওলি বাড়িরই একপাশে আলাই মিয়ার মাজার। এর সামনে লেখা, ‘ত্যাগের ভেতর খোদা মেলে, ভোগের ভেতর নয়।’

হাবেলি বাড়ি ও আলাই মিয়ার মাজার (ছবি: অনিক খান) আলাই মিয়ার সময় থেকেই এখানে মহররমের অনুষ্ঠানে শত শত নৌকায় করে বিভিন্ন জনপদের মানুষের শামিল হওয়ার রীতি চালু হয়। ধর্মীয় শ্রদ্ধায় ডাকবাংলোর পাশে কারবালা নামের মাঠ ভরে ওঠে কানায় কানায়। এখনও সন্ধ্যার পর মানুষ যায় না সেখানে। রাতের আঁধারে ওখানে অশরীরীরা ঘুরে বেড়ায় বলে বিশ্বাস করে স্থানীয়রা! ডাকবাংলোগামী রাস্তার ঠিক পাশেই বলে ময়দানটিকে কাঁটাতারের বেড়া তুলে পৃথক করে রাখা হয়েছে। ঘনঘাসে ছাওয়া ময়দানে অবারিত সবুজের সমারোহ।

বাজিতপুর থেকে দীঘির পাড় ঘাটে ঘোড়াউত্রা পেরিয়ে মোটরসাইকেলে করে আসা যায় অষ্টগ্রামে। কুলিয়ার চর থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে চেপে মেঘনার উজান বেয়ে বাঙ্গালপাড়া ঘাটে নামতে হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরের চাতলপাড় ঘাট থেকেও ট্রলার আসে বাঙ্গালপাড়ায়। এখান থেকে রিকশায় কুতুব মসজিদ মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
‘কবরস্থানের উন্নয়নে’ কেটে ফেলা হলো অর্ধশতাধিক গাছ
‘কবরস্থানের উন্নয়নে’ কেটে ফেলা হলো অর্ধশতাধিক গাছ
টপ অর্ডার ব্যাটারদের ব্যর্থতায় চিন্তিত টিম ম্যানেজমেন্ট
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলটপ অর্ডার ব্যাটারদের ব্যর্থতায় চিন্তিত টিম ম্যানেজমেন্ট
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?