ভাইরাল হওয়া মজার মজার নাচ ও ঠোঁট মেলানো হাস্যকৌতুকের ভিডিও তৈরি ও শেয়ার হয় টিকটক অ্যাপে। কিন্তু বাংলাদেশে এর মাধ্যমে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টিকটকের পরিচয় ব্যবহার করে অর্থ উপার্যনে প্রলুব্ধ করতে ছোট ছোট দল তৈরি এবং একদলের সঙ্গে আরেক দলের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে হামেশা। লক্ষ ফলোয়ার যাদের তাদের সঙ্গে টিকটকে অংশ নেওয়ার লোভে অনেকসময় জড়িয়ে পড়ছেন নানা অনৈতিক কাজে।
সম্প্রতি বেশকিছু অপরাধে অভিযুক্ত নানা শ্রেণির টিকটকাররা বলছেন, ফান করতে বা নিজের নানা প্রতিভা প্রদর্শনে কাজে লাগাতে তৈরি অ্যাপটি অর্থ উপার্যনের সহজ হাতিয়ার হয়ে ওঠায় নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। ভালো-মন্দ বুঝে ওঠার আগেই যত লাইক যত ফলোয়ার ততই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ক্ষমতাবান’ হওয়ার ফলে একশ্রেণি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে।
অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদর কাছে এই অ্যাপ খুবই জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর চাহিদা মতো যেকোনও কিছুর সঙ্গে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে তা শেয়ার করা যায়। নেই ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার দায়, নেই মনিটরিং।
প্রথমে দল বানানো তারপর যৌন হয়রানি
দীর্ঘদিন ধরে টিকটক করছেন এমন একজন সাম্প্রতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করে বলছেন, টিকটকে কনটেন্ট বানানো ও শেয়ার করা অন্য যেকোনও প্ল্যাটফর্মের চেয়ে সহজ। কিন্তু ‘অশিক্ষিত’ কিছু তরুণ এটাকে অপরাধ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাজে কনটেন্ট, বাজে কমেন্ট আর বাজে কালচার তৈরি করেছে। বাজে কালচার বলতে, সুন্দর চেহারা দেখে যোগাযোগ করা, কমন গ্রুপ খুলে সপ্তাহে মাসে একসঙ্গে আড্ডার ব্যবস্থা করা, যেখানে কিনা প্ল্যান করে ফাসানো হয়, টার্গেট করে যৌন হয়রানি করা হয়।
সেখানে অনেক সময় পরিবারকে লুকিয়ে টিন এজাররা যায় বলে তাদের সঙ্গে যা-ই ঘটুক না কেন, অভিযোগ করতে পারে না। ফলে বেশি লাইক, জনপ্রিয়তা থেকে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে থাকা টিকটকাররা আরও লাগামহীন অপরাধে যুক্ত হয়।
টাকার নেশা
কেবল টিকটক করে মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক টিকটকার। যত ফলোয়ার, যত ভিউ, যত লাইক তত টাকা। ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করছে নিম্নবিত্তের কিশোররা। সে টাকা পরিবারে ব্যবহার না করে বন্ধু আড্ডায় বেহিসাবি খরচ করে আরও ফলোয়ার বাড়ানোর পরিকল্পনা চলে। একজন ব্যবহারকারীর যখন এক হাজারের বেশি ফলোয়ার হয় তখন তিনি তার ভক্তদের জন্য লাইভে আসতে পারেন। শুধু তাই নয়, এখানে তিনি ডিজিটাল উপহারও গ্রহণ করতে পারেন; যা অর্থের সঙ্গে বিনিময় করা যায়।
জাস্ট ফান হয়ে যাচ্ছে নেশা
বেসরকারি টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক সম্প্রতি টিকটক করছেন। কৌতুহল ও জাস্ট ফান হিসেবেই শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কেবল টিকটক না, সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই ভালো চিন্তা থেকে আধুনিক মানুষের জন্য বানানো হয়েছে। কিছু মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করে। এটার প্রবণতা আমাদের দেশেই বেশি।’ তিনি বলেন, ‘এটা করতে করতে টিকটক করাটা নেশায় পরিণত হচ্ছে। যেকোনও পরিস্থিতিতেই একটা টিকটক না করলে যেন চলে না। নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তানেরা এই পরিচিতি পেয়ে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করলে বিপত্তি ঘটে।’
তিন জিনিস নিষিদ্ধ হতে হবে
চার বছর টিকটক করছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যখন অনেক ফলোয়ার থাকে তখন ব্যক্তি এক ধরনের ফেক ক্ষমতা এবং সেটা প্রয়োগ করে যেকোনও বিষয় নিজের পক্ষে রাখা যায় বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। ফলে কিশোররা এতে ঝুঁকছে বেশি। এরা দল বেঁধে পুলপার্টি, ডিজেপার্টি করে। যেখানে জনপ্রিয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসা নারী টিকটকারদের টার্গেট করে ফাঁসানো হয়। যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটে।’ তিনি বলেন, ‘এই দুটো বন্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি রাজধানীর সীসা বার নিষিদ্ধ করতে হবে। এই জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে মাদক সেবন, যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো গড়ে উঠছে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলেন, ‘কিশোর বয়সে আত্মপরিচয় তৈরির যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, শস্তা ক্ষতিকর কনটেন্ট করে আপনি সেই পরিচয় হয়তো তৈরি করতে পারছেন, কিন্তু সেটি ধারণ করার মতো বয়স, মানসিক ম্যচুরিটি হয়তো আসেনি। ফলে সেই ফেক ক্ষমতা নিয়ে আপনার মনে হয় চাইলেই আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। আপনাকে লোকজন দেখছে, ফলো করছে, অপজিট জেন্ডার আকৃষ্ট হচ্ছে; তখন একটা নেতিবাচক প্রয়োগে আপনি প্ররোচিত হন। কোনও ধরনের মনিটরিং নেই বলেই অস্থির একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা অবাস্তব জগতটাকে বাস্তব ভেবে নিয়ে সহজেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে।’