X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণী ডায়েরি

শবনম ফেরদৌসী
১৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:৫৫আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:১১
image

এ যেন অমরাবতী, নাকি উজ্জয়িনী! ছবিতে দেখা স্বর্গ যেন মেঘে মেঘে আঁকা। আমাদের পাশেই ভেসে আছে। স্বর্গ তো আকাশেই থাকে নাকি! মেঘ ঠেলেই তাতে যাবার নিয়ম। কিন্তু তা পাশ কাটিয়ে প্লেন অন্য এক জগতে হাজির করে। একদিকে মেঘে মেঘে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ চমক, তার অনতিদূরে ডুবন্ত সূর্যের হাজারও প্যাস্টেল স্ট্রোক। তার খানিকবাদেই তীক্ষ্ণ বাঁকা চাঁদ। একটা মাত্র প্যান শট। এ যেন অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন! অপার্থিব! দক্ষিণ ভারতীয় সান্ধ্য গগন আমাকে এভাবেই স্বাগত জানালো। আমি মুগ্ধ, বিহ্বল, দ্রবীভূত।

চেন্নাই শহর, ছবি: ইন্টারনেট থেকে

সূর্য ওঠার আগেই এখানে আলো গনগন করে। সেই রোদ্দুর মাথায় নিয়ে অ্যাপোলো চেন্নাই-এর ফটকে দেখি কড়া নিরাপত্তা। একপাশে প্রেসের সারি সারি ক্যামেরা। আরেকপাশে মৌনব্রত নারী-পুরুষের দল। মাঝখানে খাকি পুলিশ দণ্ডায়মান। কোনও কোলাহল নেই, নেই ঠেলাঠেলি। ভাবলাম এরা বোধহয় কোনও অনশন প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হয়তো কোন রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। জানা গেল এ প্রতিবাদ নয়, প্রার্থনা। ওদিকে প্রেসও তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নীরবে। প্রেসের যা এথিকস আর কী! নো হল্লাহাটি, নো জবরদস্তি!

কার তরে এই প্রার্থনা? তামিলনাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা আজ প্রায় ১৫ দিন এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাতে করে অবশ্য কোন বিড়ম্বনা হচ্ছে না। রোগী যার যার সেবা তার তার মতো করে নিয়ে চলেছে। ভক্তদের যাবতীয় ভীড় গেটের এক কোণে। নো জ্যাম, নো গ্যাঞ্জাম। শান্তিপ্রিয় কালোকুলো মানুষগুলো মায়াভরা চোখ নিয়ে এই প্রখর রোদে বেদনাক্রান্ত হয়ে বসে আছে। জয়ললিতা তাদের দেবীতুল্য। মাঝে মাঝেই বিশেষ সব দামী গাড়ি আসছে। নামছেন ধর্মীয় গুরু, নেতা, আমলা। রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চলছে এরই মধ্যে। জয়ললিতা যে দক্ষিণে কতবড় বিষয় তা আরও টের পাওয়া গেল যখন অটোতে, ট্যাক্সিতে, খাবার দোকানে, শপিং মলে লোকে আমাদের জানাতে থাকে জয়ললিতার অসুখের কথা। এবং তা জানায় ভক্তিতে, শ্রদ্ধায়।

ভক্তি-দক্ষিণের মূলমন্ত্র। তা হোক ঈশ্বর, হোক রাষ্ট্রনায়ক, হোক পরধর্ম কিংবা পরদেশী। প্রতিটি বিষয় ভক্তিতে ভরপুর। ফুটপাতে বসা ফুলের মালা গাঁথছে যে কুঁজো হয়ে থাকা মালয়ালামবাসিনী, তার হাতে ঝরে ঝরে পড়ছে ভক্তি প্রতিটি ফুল সুঁচে গাঁথার আগ মুহূর্তে। যে পুলিশ আপনাকে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার করে দিচ্ছে তার বাহুর ইশারায় ভক্তি। যে বেয়ারা আপনাকে ‘থালি’ এগিয়ে দিচ্ছে তার দেহ বক্রতায় ভক্তি। তবে কি সেই ভক্তির ছায়াই কি এদের আয়ত চোখে? কি অদ্ভুত সুন্দর চোখ এদের! এত এত গভীর মায়াময় চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি। আঁখি পল্লবে ঘন হয়ে দোলে এ কিসের ছায়া! আমি জানতে চাই দক্ষিণী এক মানুষের কাছে, ‘তোমাদের চোখ এত সুন্দর ক্যানো গো? কে দিয়েছে?’ সে বলে, ‘ভালোবাসা দিয়েছে। ভালোবাসতে জানলে সব চোখই সুন্দর।’

শান্ত শহর চেন্নাই, ছবি: ইন্টারনেট থেকে

চেন্নাইয়ের সাথে কোন শহরের মিল? খুঁজি ফিরি মনে মনে। ঢাকা কি? নাহ, চিটাগাং আর দিল্লী, দুইয়ে মিলে এক মিষ্টি শহর। এত লোক ছুটছে শান্ত, নম্র হয়ে। যেন এমনটাই ছোটার কথা। যে যার কাজ করছে চটপট, তাড়াহীন। কী এক শান্ত ভাব সবটা জুড়ে! দালানকোঠা, মৌন গলি সব যেন ছেলেবেলার ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। এক কালে তো আমাদেরও এমন একখানা শহর ছিল। ওরা তো পারলো আধুনিকতার মিশেলে তা ধরে রাখতে। আমরা কেন নয়! এরাও তো আমাদের মতই আবেগী আর অভিমানী। কিন্তু বিধ্বংসী নয় যেন। এদের মতই সবুজ আর জলের সমারোহ আমাদের দেশে। আমাদের পলল এর চেয়েও নরম। আমাদের আকাশ এর চেয়েও আর্দ্র। তবু কেন আমাদের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ? এদের দেখি আর আমার মন বেদনায় আফসোস করে। এককালে এমন ছিল তো আমাদের মন। ভেজা, ভেজা মায়াময়। একাধারে শিক্ষিত, স্মার্ট এবং সৎ। ট্র্যাডিশান কি? ট্র্যাডিশান এদের স্টাইল, এদের জীবনাচরণ। আমরা কি তবে ট্র্যাডিশান ভাঙতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেললাম! এরা তো এখনো পাঁচতারা হোটেলে কলাপাতায় খায়। ওই শাড়ি পরে, চুলে ফুল গুঁজে ভেসপা চেপে বড় বড় আপিস-আদালত চালায়। কপালে তিলক এঁকে বাণিজ্য শানায়। কই তাতে করে তো কোনও কিছুতে ছেদ পড়েনি! রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লোকে জ্যামে বসে থাকেনি। হিন্দুর ওপর মুসলিম, মুসলিমের ওপর খ্রিষ্টান, খ্রিষ্টানের ওপর হিন্দু চেপে বসেনি। সব ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা বিশাল শহরকে টেনে চলেছে। সবাই ভীষণ ধার্মিক। কিন্তু কারো ধর্মকে অপবিত্র করে নয়। ভিন্নমতকে হেয় করে নয়। কারণ বোধহয় সেই ভালোবাসা। নিজের মাটিকে ভালোবাসা। এ আমার ভূমি, আমার-আমাদের। একে দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব আমাদের। সে তুমি হও গোঁড়া বামুন, কট্টর মুসলিম কিংবা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। এমন একটা শক্তির ব্যাপার তো আমাদেরও ছিল। অসাম্প্রদায়িক এক জাতীয়তাবাদী সমাজ ব্যবস্থা। তবে কি দেশের মঙ্গলের জন্যে কিছুটা জাতীয়তাবাদী হতে হয়? আমরা কি হুট করেই আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠলাম? দেশকে ভালোবাসার আগেই ভিনদেশি হাওয়ায় উড়ে গেলাম কি! দেশপ্রেম হয়ে উঠলো ঘৃণার কুণ্ডলী!  

দক্ষিণীদের সেবা করে সেভেন সিস্টারস জনপদ। আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড। আর এদিকে উড়িষ্যার দরিদ্র মানুষ দক্ষিণের সেবকশ্রেণী। কালোদের রাজত্বে সাদা সাদা গোলাপি বালকেরা শ্রমিক। এক অদেখা সোশ্যাল কন্ট্রাস্ট। আর আছে কাশ্মীর কা লেড়কা। এই ঘাম-গর্মীর দেশে কীভাবে যে এত কাশ্মীরের লোক কাপড় আর গয়নার ব্যবসা ফেঁদে বসেছে তা কে জানে! টি-নগর থেকে শুরু করে খোদ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত কাশ্মীরী পাতি ব্যবসায়ী।

আর এদিকে তাবত বাঙ্গালী হচ্ছে এ শহরের খদ্দের। মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, কলকাতায় চলে এলাম নাকি! শহর জুড়ে গিজগিজ করছে ভেতো বাঙালি। চিকিৎসা থেকে শুরু করে বেড়াতে আসা সকল সেবা গ্রহণ করে চলেছে দু’বাংলার বাঙালি। তাই বুঝি ভীষণ খাতির তাদের। ভাতের দোকান থেকে ভাষা পর্যন্ত। ডাক্তার থেকে দোকানি থোরা থোরা বাংলা জানে। যদিবা বলতে নাও পারে, বোঝে তো পুরোই। কিন্তু ওদের কথা ধরবার উপায় নেই এই অধম বাঙালের। মুড়ি-মুড়কির মত ঠোঁট ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছে সে ধ্বনি।

চেন্নাই শহরে লেখক

চিকিৎসার জন্যে অ্যাপোলোর চারপাশে অসংখ্য রেস্ট হাউজ। আপনি দীর্ঘদিন থাকবেন, রান্না-বান্না করে খাবেন। সেইসব ব্যবস্থা নিয়ে যারা রেস্ট হাউজ খুলে বসেছে তাদের বেশিরভাগ স্থানীয় মুসলিম। আমার সফরসঙ্গী হাবিবা সবসময় টিপ পরে। আমাদের নাম আর চেহারা দেখে প্রশ্ন করে, টিপ ক্যানো? বলি, আমাদের ওখানে চলে। ওরা অবাক হয়। বাংলাদেশের বাঙালি সম্পর্কে দেশের বাইরের ধারণাটি একইরকম দেখেছি। ১২ বছর আগে দিল্লীতে এক দিল্লীওয়ালী লেড়কি আমাকে বলেছিল, তোমরা তো দেশে বোরকা পর। এখানে এসে পরছো না কেন? ক্লিশে! দুনিয়া জুড়ে এই ক্লিশে ইমেজের রাজনীতি। আপনি যা নন তা জোর করে বানিয়ে রাখা, বানিয়ে ফেলা। আইকনিক একটা রোলে ঘুরপাক খাওয়া। জাতি হিসেবে যে আমরা কতটা বৈচিত্র্যময় তা জগত জানে না।

সে বৈচিত্র্য এখানেও আছে। নানা দেশের, নানা ভাষার লোকে লোকারণ্য এই শহর। আমি শুধু ভাবি একই পাত্রে তেল ও জল কিভাবে ধারণ করে এরা! ধার্মিক, কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। ঐতিহ্যবাহী, কিন্তু পিছিয়ে পড়া নয়। পর, কিন্তু অস্বস্তিতে ভোগা নয়। একটা উদার শহুরে হাওয়া সর্বত্র। কারোর প্রতি নেই করোর ভ্রুকুটি। এ যেন চেনা এক নগর। দক্ষিণপন্থী, কিন্তু সেইসাথে দক্ষিণা খোলা হাওয়া।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

/এনএ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা