X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একজন কেকের কারিগর

নওরিন আক্তার
০৮ মার্চ ২০১৬, ১৫:৩৪আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৬, ১৭:০৩
image

সুমি’স হট কেকের কেক চেখে দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিনই বটে! সুমি’স হট কেকের প্রতিষ্ঠাতা ফারজানা শেখ সুমি জীবনের প্রথম কেকটি তৈরি করেছিলেন নিজ বাসায়। তারপর ধীরে ধীরে নিজ প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন আজকের বিরাট এ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সুমি’স হট কেকের মোট ২৬টি শাখা রয়েছে। শুরু থেকে আজকের অবস্থানে আসার পেছনের গল্প সুমি শোনালেন বাংলা ট্রিবিউনকে।     

ফারজানা শেখ সুমি

এক সময় অনুষ্ঠানে কেক কাটাকে বিলাসিতা বলে মনে করা হতো। তবুও উচ্চবিত্তরা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেক নিয়ে আসতেন। তখন পর্যন্ত অবশ্য জন্মদিন ছাড়া কেক কাটাও হতো না তেমন। ফারজানা শেখ সুমি সে সময় যশোর থাকতেন স্বামীর সঙ্গে। সিদ্দিকা কবিরের রেসিপি বই দেখে বেক করার চেষ্টা করতেন প্রায়ই। ‘সেটা ১৯৮০ সালের কথা। আমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে স্বামীকে বললাম একটা কেক নিয়ে আসতে। তখন পূর্বানীর কেক ছিলো বিখ্যাত। আবদার করেছিলাম সেখান থেকে একটা কেক নিয়ে আসার জন্য। কেক কাটার আগে কৌতূহলী হয়ে কেকের দাম জিজ্ঞেস করলাম। দাম শুনে তো আমি অবাক! কারণ দামটা ছিলো আমার স্বামীর বেতনের প্রায় অর্ধেক। এতো দাম একটি কেকের! খুব খারাপ লাগলো আমার। বললাম, একটা কাজ করো। আমাকে একটা ওভেন কিনে দাও। আর কখনো কেক কিনতে বলবো না। নিজেই বানিয়ে নিবো কেক’- বলেন সুমি। কিন্তু সেই ওভেন কেনাটাও খুব সহজ ছিল না। তখন একটা ওভেনের দাম ছিলো ৩৩০০ টাকার মতো। সেটা জোগাড় করার সামর্থ ছিল না সুমি দম্পতির। প্রায় ৩ বছর পর টাকা জমিয়ে ওভেন কিনতে সমর্থ হন সুমি। ততদিনে প্রথম ছেলে চলে এসেছে কোলে। ছেলের ২ বছরের জন্মদিনে নিজের হাতে কেক বানিয়ে সর্বপ্রথম সবার সামনে পরিবেশন করেন তিনি। এছাড়া স্বামীর কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন পার্টিতে টুকটাক কেক বানাতেন। সামর্থের অভাবে তখন কারোর জন্মদিনে বেড়াতে যাওয়ার সময় দামী উপহার না কিনে নিজ হাতে বানানো দুই পাউন্ডের কেক নিয়ে যেতেন। দেখা যেতো সবাই অন্যান্য জায়গা থেকেও কেক নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি সাজানো থাকতো সুমির কেক ও দোকান থেকে নিয়ে আসা কেক। কিন্তু বাসায় বানানো কেকটিই শেষ হয়ে যেত আগে! সবাই জিজ্ঞেস করতো কে বানিয়েছে এত মজার কেক! অনেকে আবদার করতো তাকেও এরকম কেক বানিয়ে দেওয়ার জন্য। এভাবে একটু একটু করে বাড়তে থাকলো সুমির পরিচিতি।

সুমি`স হট কেকের কেক। ছবি তুলেছেন খালেদ পারভেজ রানা

‘প্রথম প্রথম দু’একজনকে কেক বানিয়ে দিতে শুরু করলাম। যেটুকু খরচ হতো কেবল সেটুকুই নিতাম ওদের কাছ থেকে। কিন্তু দিন দিন কেক বানানোর অর্ডার বাড়তে থাকলো। দেখলাম এভাবে আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। বাসার মধ্যে সারাদিন বেকিংয়ের গন্ধ হয়ে থাকতো! আমার স্বামী বিরক্ত হতেন। তিনি তখন বললেন দোকান দিয়ে ভালো মতো কাজটি শুরু করতে। তখনই হঠাৎ করে পেপারে সোবহানবাগের একটি দোকানের খবর পেলাম। কিন্তু সেখানে শুরু করার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা লাগবে। তখন এটা জোগাড় করা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। অনেক কষ্টে ধার দেনা করে টাকা জোগাড় করে ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোবহানবাগে শুরু করলাম আমার প্রথম দোকান সুমি’স হট কেক। এরপর আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি’-বলেন সুমি। তবে শুরুটা খুব সহজ ছিল না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আজকের অবস্থানে আসার জন্য।’ ছোট্ট পরিসরে যখন শুরু হয় সুমি’স হট কেক, তখন কি তিনি ভেবেছিলেন একদিন এতো বড় একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হবে এটি? ‘একদম না! স্বপ্নেও ভাবিনি যে সুমি এতো মানুষের ভালোবাসা পাবে। তবে আমি কৃতজ্ঞ সবার প্রতি, যারা আমার নিষ্ঠার দাম দিয়েছেন’ বলেন সুমি।

চলছে কেক তৈরি

সে সময় সোবহানবাগে পাঁচটি বেকারি ছিল। সবাই বলল এখানে শুরু করাটা বোকামি হচ্ছে। একজন মহিলা মানুষ কি পারবে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে? আমি বললাম, আমি তো জানি না কি হবে। তবে আমি ভালো কিছু করবো আশা করি। তখনও সবাই কটাক্ষ করে বলেছে বাসায় বানানো আর দোকান দেওয়া কি সমান? কিন্তু আমার আত্নবিশ্বাস ছিল যে আমি পারবো’- জানান তিনি। সুমি মনে করেন সোবহানবাগের দোকানটা তার জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। এটাকে সবসময় এখানেই রাখতে চান তিনি।সুমির এই জনপ্রিয়তার কারণ কী? কোন বিশেষত্বের জন্য সুমি’স হট কেক সবার চেয়ে ব্যতিক্রম? সুমি মনে করেন তার কেকের স্বাদে এক ধরণের ঘরোয়া ব্যাপার আছে। একেবারে শুরুতে যেটা ছিল। যা মানুষ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। এছাড়া কেকে কোনও ধরনের কেমিক্যাল দেন না তিনি। ‘যদিও কেমিক্যাল দিলে অনেক বেশি মজার হয় কেক। কিন্তু কেমিক্যাল ব্যবহার করে স্বাদ বাড়ানোর চেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে কেক বানানোতেই আমি মানসিক শান্তি পাই’- বলেন তিনি। আরও একটা ব্যাপার সুমিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেটা হচ্ছে কেকের আকার। সাধারণ কেকের চাইতে সুমির কেক সবসময়ই খানিকটা বড় হয়। ‘প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে কেনা কেকটি দেখে আমার মনে হয়েছিলো এত ছোট কেকের এত দাম! তখন থেকে এই ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল। আমি সবসময় ভেবেছি আমার দোকানের কেক অন্যান্য কেকের থেকে বড় হবে। আমার কথা হলো যে টাকা দিয়ে কেক কিনবে সে যেন সন্তুষ্ট হয়। আমার মতো যেন মনে না করে যে এতগুলো টাকার কেক এত ছোট! মানুষ কেক খেয়ে খুশি হলেই আমি খুশি! কারণ কেবল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই আমরা কেক বানাই না, মানুষকে পরিতৃপ্ত করতে বানাই কেক’ জানান সুমি।

নিজের তৈরি কেক নিয়ে সুমি  উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন নারীরা। এক্ষেত্রে সুমির পরামর্শ কী? সুমি মনে করেন সমস্যা সবখানেই থাকে। এখনকার মেয়েরা তো সবাই কিছু না কিছু করছে। যে যা ভালো পারে, তার সেটাই করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। যেমন কেউ যদি সেলাই ভালো পারে, সে সেলাই করুক। কেউ ভালো পিঠা বানালে সে সেটাকেই পেশা হিসেবে নিক। ‘একজন মেয়ের বাড়তি দক্ষতা যে সে সবকিছুতেই দক্ষ! কারণ একজন মেয়ে একই সঙ্গে মা এবং স্ত্রী। সে কিন্তু একটা বাদ দিয়ে অন্যটা নিয়ে চলতে পারবে না। সবাই সহযোগিতা করলে একজন মেয়ে পারে না এমন কাজ নেই। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আত্নবিশ্বাস। সবাই পারলে আমিও পারবো- এই মনোভাবটা থাকতে হবে’- বলেন সুমি। এদিক থেকে সুমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ কাজের ক্ষেত্রে পরিবারের পূর্ণ সহায়তা পেয়েছেন তিনি। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই সাহায্য করেছেন। ‘ছেলেরা যখন ছোট ছিলো ওদের নাস্তা করিয়ে স্কুলে নামিয়ে চলে যেতাম ফ্যাক্টরিতে। কাজ গুছিয়ে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসার চেষ্টা করতাম। যেন সবাই একসঙ্গে দুপুরে খেতে পারি। এখন আমার দুই ছেলেই দেখছে সুমি’স হট কেক’- বলেন সুমি।

১৯৮৩ সালে ছেলের জন্মদিনে নিজের তৈরি প্রথম কেক

অনেকে মনে করে কাজ শুরু করার জন্য পুঁজি অনেক বড় বিষয়। সুমি তাদের একদম ছোট থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন। একবারে কেউ বড় হতে পারে না। আস্তে আস্তে সে উপরে ওঠে। অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে আসলেই যে সে সফল হবে, এমন কোন কথা নেই। বরং প্রথমে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করতে হবে। ধীরে ধীরে দোকানে সাপ্লাই দেওয়া শুরু করা যেতে পারে। এভাবে একদিন সে নিজেই একটা দোকান দিয়ে দিতে পারে। এখন অনেকে বাসায় বসে কেক বানাচ্ছেন। অনলাইনে যোগাযোগ করছেন, সেগুলো সরবরাহ করছেন দোকানে। এগুলো খুবই আশার কথা। এ ধরণের প্রচেষ্টা বেকারির মানকে আরও উন্নত করছে সন্দেহ নেই। ‘আমাদের সময়ে তেমন কোন বেকারি ছিলো না। এখন নতুন প্রজন্ম অনেক নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। অনেক ভালো করছে ওরা। এখন দেখা যায় মানুষ কারোর বাসায় যাওয়ার সময় মিষ্টির বদলে কেক নিয়ে যেতে পছন্দ করছে। ফলে কাজের সুযোগ অনেক বেশি এখন’- বলেন সুমি। 

সুমি জানান, আরেকটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যেকোন কাজের ক্ষেত্রে। মানুষ ভালো কিছু গ্রহণ করবেই। তাই নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে সবসময়।

/এনএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী