X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি ও স্বস্তি

আল-রাব্বী
১২ অক্টোবর ২০১৫, ১৩:১৭আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫, ২১:০৯

শান্তি ও স্বস্তি‘‘কয়েকদিন পর রাইয়ান জানালো ওর বাবা দু’টি পাখি কিনেছেন। ওরাও একটা ফুড লিস্ট বানিয়েছে। ওরা পাখি দুটির নাম দিয়েছে আবির ও সিরাজ। ওয়াহি কিনলো কিছুদিন পর। ও নাম দিলো মিনু আর বিনা।
এরপর স্কুলে দেখা হলেই তিন বন্ধু টিয়া পাখি নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতাম।’’

 

এক.
শান্তি ও স্বস্তিকে বাবা যেদিন প্রথম বাসায় নিয়ে আসেন সেই দিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে আজও। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। বাবা প্রমিজ করেছিলেন– দারুণ কিছু গিফট দেবেন।
পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন। দিনটি ছিল রবিবার। সকাল থেকে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। আকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে একটা ঝর্ণা ছেড়ে দেয়া হয়েছে যেন।
স্কুলে যেতে কষ্ট হয়েছিল সেদিন। বৃষ্টিতে রিকশা পাওয়া সহজ নয়। পেলেও রিকশাচালকরা যেতে চায় না। বাবার ছাতার নিচে হেঁটে যাচ্ছিলাম দু’জনে। যদিও কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু মজাও ছিল অনেক। এটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা কিছু।
স্কুলের গেইটে এসেই বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বাবা, মনে থাকবে তো?’
বাবা হেসে বললেন, ‘মনে আছে, তুই ঠিক মতো পড়ালেখা কর। পুরস্কার নিয়ে এত ভাবার দরকার নেই। তুই তো জানিস আমি কথা দিলে রাখি। মন দিয়ে ঠিকমত লেখা পড়া কর।’
‘আমি কি ঠিকমত পড়ছি না?’ বাবাকে মন খারাপ করে জিজ্ঞাসা করি।
ছাতাটা আরেকটু আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বাবা বললেন, ‘আমি জানি তুই খুব সিরিয়াস ছাত্র। গত পরীক্ষায় ভালো করেছিস। কিন্তু জীবন তো এখানেই শেষ নয়। এই যে তোকে এসব বলছি সেটা শুধু তোর ভালোর জন্য। যাতে আরও ভালো করিস।’
এই বলে বাবা চলে গেলেন। এক অনর্বিচনীয় মনের ভাব নিয়ে তাড়াতাড়ি ক্লাসরুমে ঢুকলাম। কে যেন ডাকলো, হাই রাব্বী, ভিজে গেছিস নাকি!
মন দিয়ে সব ক্লাস করলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। কখন যে সূর্য তার লুকিয়ে রাখা মুখটি বের করে পৃথিবীর বুকের উপর আলো ছড়ালো টের পাইনি। পরিষ্কার নীল আকাশ। সূর্য যেন হাসছে।
বাসায় যেয়ে দেখি বাবা তখনও ফেরেননি অফিস থেকে। মনে মনে ভাবছিলাম বাবা বোধহয় গিফট কিনতে গেছেন কোথাও। তাই দেরি হচ্ছে ফিরতে। বাবা সাধারণত অফিস থেকে বাসায় ফিরতে দেরি করেন না। বিকেলেই চলে আসেন। আমাকে সাড়ে আটটায় স্কুলে দিয়ে অফিসে যান। আমি দু’টায় ফিরি ভ্যানে করে। উনি কিছুক্ষণ পরে আসেন।
স্কুলে থেকে এসে গোসল করে ভাত খেতে বসলাম। মা হরেক রকম তরকারি রান্না করেছিলেন সেদিন। লাল শাক, পুঁইশাক, শিঙ মাছ, মুরগির মাংস, আরও কত কী। তৃপ্তি করে খাওয়া শেষ করে দিলাম টানা ঘুম!
মা বিকেলে ঘুম থেকে তুললেন। পাঁচটা বেজে গেছে। বললেন, ‘হানিফ, বাবা তোমার অনেকদিনের চাওয়া গিফটটা এনেছে।’ আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠি।
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি। বাবার রুমে গিয়ে দেখ।’
তড়িঘড়ি গেলাম বাবার রুমে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাবা আমার পুরস্কার কোথায়?’
বাবা বললেন, ‘বারান্দায় গিয়ে দেখ।’
বারান্দা বাবার রুমের সঙ্গে লাগানো। এজন্য এ রুমে প্রচুর বাতাস। আলো। আমি বারান্দায় যেয়ে এক বিস্ময়কর জিনিস দেখলাম। একটি খাঁচা। সেই খাঁচার ভেতর দুটি টিয়া পাখি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কী দেখছি। কী চমৎকার একটা পুরস্কার। রঙিন বাঁকা বাঁকা ঠোট ওদের। আমার বাবাটা আসলেই অন্যরকম।
বন্ধুদের দেখেছি ভালো রেজাল্ট করলে বাবারা অনেক দামি দামি জিনিস দেয়। শাবাবকে ওর বাবা একটা ল্যাপটপ দিয়েছে। লুবাবাকে দিয়েছে মোবাইল ফোন। আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি। কিন্তু আমার বাবা আমাকে এমন কিছু দিলেন যা সেসবের চেয়েও চমৎকার। দারুণ লাগছিল। পশু-পাখি পালা বিরাট অভিজ্ঞতার ব্যাপার। দায়িত্ব নেয়া শেখায়।
আমার কোনো ভাইবোন নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। একা একা থাকি। ভালো লাগে না অনেক সময়ই। টিয়া দুটোকে পেয়ে ভালো লাগছিল। বারান্দা থেকে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।
‘থ্যাংকু বাবা।’
বাবাও খুশি হলেন মনে হলো। সঙ্গে অবশ্য বললেন, ‘পড়াশোনাটা কিন্তু ঠিকমতো করতে হবে।’
কিছু না বলে হাত-মুখ ধুতে গেলাম। মনটা আনন্দে ভরে গেল। বাবার প্রতি কিছুটা উষ্মা ছিল। সেটা এতদিন পর চলে গেল। আহ্, খুব মজা।

দুই.
টিয়া পাখি দুটোকে আনার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাদের সংসারে একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। আমার তো জীবনটাই বদলে গেল। সেদিন রোববার রাতেই বাবা আর আমি ওদের খাবারের একটা লিস্ট করলাম। রাতে ডিনারের পর বাবা তাঁর রুমে ডাকলেন।
‘হানিফ, আজ থেকে তোমার দায়িত্ব বেড়ে গেল। আরও খেয়াল রাখতে হবে চারিদিকে। পড়ালেখার পাশাপাশি টিয়া দুটিরও যত্ন নিতে হবে কিন্তু। মনে রেখো, ওদের ভালো-মন্দ তোমাকেই দেখতে হবে এবং গাফলতি চলবে না। ওদের কষ্ট দেয়া যাবে না। এই যে এটা নে।’ এই বলেই আমাকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলেন।
একটা খাবারের তালিকা–
কলা : সকাল ও দুপুর
ভেজা ছোলা : সকাল
ভাত : দুপুর
সরিষা : বিকেল
সঙ্গে পানি দিতে হবে সবসময়।
তালিকার উপরে দেখলাম আন্ডারলাইন করে লেখা, “শান্তি ও স্বস্তির খাবারের তালিকা”।
আমি তো হেসে উঠলাম।
‘বাবা, একি লিখেছো তুমি? শান্তি-স্বস্তি তো মানুষের মনের অনুভূতি। এর আবার খাবারের তালিকা হয় নাকি?’
‘ধুর, বোকা ছেলে, শান্তি ও স্বস্তি তো টিয়া পাখি দুটোর নাম রাখলাম। ওদের জন্যই এই খাবার লিস্ট।’
আমি আবার দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। ওদের সারা গায়ে গাঢ় সবুজ পালক। ঠোট দুটো টকটকে লাল। ঘেষাঘেষি করে বসে আছে। মনে হলো দুটোতে খুব ভাব আছে। এক ধরনের কোমলতা ওদের মুখে। বৃষ্টি হওয়ায় আজ আবহাওয়াও ঠান্ডা।
খাবারের লিস্টটা দরজায় টেপ দিয়ে লাগানো হলো।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো। আমরা যখন এসব করছি বারান্দায় একটা বিড়ালও দাঁড়িয়ে ছিল। ও মাঝে মাঝে রাতে আসতো। বাবার বিড়াল এটা।  আমার মতোই বিড়ালটিও খাঁচার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখ গাঢ় সোনালি। আমি ভয় পাই। হঠাৎ দেখি বিড়ালটা শান্তি ও স্বস্তির খাঁচার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
চিৎকার দিয়ে উঠলাম, ‘বাবা, বিড়াল।’
বাবা বিছানায় পেপার পড়ছিলেন। আমি টেবিলের পাশে রাখা পুরানো লাঠিটা নিয়ে দৌড়ে ওকে তাড়াতে গেলাম। মনে হলো বিড়ালটা শান্তি ও স্বস্তিকে পছন্দ করছে না। ওদের খামছি দিতে চেয়েছিল।
দোতালার বারান্দা থেকে দৌড়ে অন্ধকারের মধ্যে পালালো বিড়ালটা।
বাবা কেমন যেন রেগে উঠলেন।
‘বিড়ালটাকে তাড়ালি কেন? ওকে তোরা এমন করিস কেন? তোদের কোন দয়া-মায়া নাই? আগেও দেখেছি তুই, মা, দিবাদাই সবাই বিড়ালটাকে দেখলেই তাড়া করিস। সেজন্য ও আজকাল আর আসেই না।’
এটা ঠিক বিড়াল দেখলেই সবাই আমরা দৌড়াই ওকে। দাদি বেশি করে। দাদিকে আমি ছোটবেলা থেকে দিবাদাই বলি। খুব ছোট যখন, দিদা-ভাই বলতে পারতাম না, উচ্চারণ করতাম ‘দিবাদাই।’ এখন বড় হয়েও তাই বলি। বিড়ালটা তাঁর বেশি অপছন্দ। অথচ ওকেও বাবাই এনেছিলেন একসময়।
আমি বিড়ালকে সাপের মতো ভয় পাই। মা তাই টেবিলের কাছে লাঠি রেখে দিয়েছে। ও আসলেই যেন তাড়া করি। যতই বড় হয়েছি সে ভয় যায়নি। আল্লাহ জানে কেন এই ভয়। কিন্তু আজকের ভয়টার কারণ আছে। বিড়ালটা টিয়াগুলোর দিকে যাচ্ছিলো। আমি শিউর, শান্তি ও স্বস্তিকে মারার জন্য আসছিল ও। বাবা বিশ্বাস করবে না অবশ্য।
বললাম, ‘বাবা, আমি চিৎকার করেছি, কারণ বিড়ালটা শান্তি ও স্বস্তিকে মারার জন্য আসছিলো।’
‘বলেছে তোকে’, এই বলে বাবা উঠে বসলেন। তাঁর মুখে কি যেন চিন্তার ছাপ। এরপর বললেন, আজ ঘুমাতে যা। এসব নিয়ে তোর বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নাই।
টিভি দেখতে বসলাম। কিন্তু আজ আর মন বসছে না। অস্থির লাগছে। মনে বিষণ্নতা ও পুলক দুটোই। টিয়া দুটোকে পেয়ে ভালো লাগছিল খুব। কিন্তু বিড়ালটার কথা ভেবে ভয় পেলাম। পাখিদের দিকে ও এভাবে কটমট করে তাকাচ্ছিলো কেন? বাবা তো কিছুই বুঝল না।

তিন.
এক বছর পার হলো এভাবে।
কত কিছু ঘটেছে আমাদের বাসায় এর মধ্যে। কত সুখ-দুঃখের মিশ্রন। মনের বন্ধ জানালাগুলো খুলতে কষ্ট লাগে। কত স্মৃতির বাতাস আসে সেখানে। আমার মনে আজও শান্তি ও স্বস্তি অমর। ওরা চিরন্তন হয়ে গেল আমার কাছে। মনে হয় যেন আজো ওরা টুকটুকে লাল ঠোঁট নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পাশের বাগানে। কি যে পবিত্র ওদের মুখ দু’টি। আমি যে দূর থেকে দেখি ওদের। মনে হয় যেন আমি আজও খাবার দিচ্ছি শান্তি ও স্বস্তিকে। উড়ে উড়ে বসছে বারান্দায়। মনে কত পুলক আমার।
বাবার দেয়া ফুডলিস্ট ফলো করে খাবার দিতাম আমি ওদের প্রতিদিন। ওদের কথা বলা শিখাতে লেগেছিলাম। প্রথমে শিখালাম ‘হানিফ’ বলা। এটা তো ওরা সহজেই বলতো। তেমন কষ্ট হয়নি।  জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এইভাবেই গেল। কত যে খেয়াল রাখতে হতো আমাকে। নিয়ম করে কথা শেখানো। খাওয়ানো। ওদের বড় করেছি আমি। যেন আমিও অনেক বড় হয়ে যাচ্ছি। যেন অনেক শক্ত সামর্থ একজন আমি।
আজও যখন একলা থাকি এসব ভাবি। ঝড়ো বায়ুর মতো হু হু করে ওদের কথা ঢুকে পড়ে মনের ভেতর। মনে আজো আনন্দ বয়ে যায় ওদের জন্য। আমি নিজেও যেন শান্তি ও স্বস্তি পাই।
বাবা যখন দেখতেন আমি শান্তি ও স্বস্তিকে নিয়মিত খাওয়াই, কথা বলা শেখাই তিনি খুশি হতেন। আমিও তখন আনন্দ পেতাম। এ আনন্দ তো খুলে বলা যায় না। বাবা যেন এতদিনে বুঝলেন আমিও কিছু পারি।
সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথের অমর চরিত্র বলাই যেমন গাছপালাকে মনপ্রাণ ঢেলে ভালোবাসতো তেমনি পাখিদের প্রতিও আমার মনে জন্মেছিল গভীরতর ভালোবাসা। বলাই শুনতে পেত গাছের কান্না-হাসি। ঘাস আর পাতাদের আর্তনাদ। আমিও বুঝতে পারতাম পাখিদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। ওরা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে বসে থাকতো। মাঝে মাঝে কি যেন আনন্দ দেখতাম ওদের চোখে।
একদিন পানি ঢেলে ঢেলে গোসল করাচ্ছিলাম। বাবা ঘরে এসে দেখলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাহ বাহ্, তুই তো দেখছি অনেক রেসপনসিবল হয়ে গেছিস।’
আমিও হাসলাম। খুব ভালো লাগলো বাবার কথা শুনে।
বাবার প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে আমার। এত কম প্রশংসা করেন। তবে অন্যদের কাছে বোধহয় প্রশংসা করেন। মা বলেন, তোমার প্রশংসা তো আমাকে বলেন। অন্যদের বলেন। সামনে প্রশংসা করতে হয় না।
তবে আমার বাবা সবসময় কথা দিলে রাখেন। হয়তো সাথে সাথে নয়। কিন্তু একদিন না একদিন তিনি কথা রাখবেনই। আমি জানি। এটা আমার বড় সুখ।
শান্তি ও স্বস্তিকে যে কথা বলতে শিখিয়েছি সেজন্য বাবা একটা সিডি কিনে দিলেন। সিনেমার সিডি। ‘হ্যারিপটার এন্ড দ্য সাবলেট অব ফায়ার।’ এটা আরেকটা গিফট, আমি বুঝেছি। মাঝে মাঝে বাবা বেশি টাকা খরচ করে ফেলেন।
‘কি দরকার ছিল এটার, টিভিতে তো ধারাবাহিকভাবে দেখাচ্ছেই’, বললাম বাবাকে।
তুই যে শান্তি স্বস্তিকে কেয়ার নিচ্ছিস সেজন্য কিনে দিলাম। তোর জন্যও তো কিছু করতে হবে আমাকে– নাকি?
আমি মাথা নাড়ালাম শুধু।
বাবা আসলে জানতেন আমি ছবিটা খুব পছন্দ করি। টিভিতে এমন সময় দেখায় দেখতে পারি না। বাবা যে কীভাবে সব বুঝে ফেলেন। মন পড়ে ফেলতে পারেন তিনি।
এই গিফটা পেয়েও খুব পুলক হলো। যদিও বেশি কিছু প্রকাশ করিনি। তবে পাখি দু’টির প্রতি আরও ভালোবাসা বেড়ে গেল।

চার.
স্কুলে আমার অনেক বন্ধু। তবে এদের মধ্যে দুইজন বিশেষ বন্ধু আছে। সবার বোধহয় এমন থাকে। ওইরকম বন্ধুরা ভাই-বোনের মতো হয়ে যায়। আমার সেই দুই বন্ধু হলো রাইয়ান এবং ওয়াহি।
ভালো বন্ধু পাওয়া সহজ নয়। নামেই বন্ধু অনেকে– কাজে নয়। সবাই কেবল নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। ভালো দিনগুলোতে সবাই বন্ধু হয়ে যায়। মন খারাপের সময় কাউকে পাওয়া যায় না। ধারে কাছেও দেখি না তাদের। একদিন ক্লাসে মিস বুঝিয়েছেন এরকম বন্ধুরা হলো ‘সুখের পায়রা’।
আমাদের ক্লাশেও কয়েকজন সুখের পায়রা আছে। রাইয়ান এবং ওয়াহি অবশ্য সুখের পায়রা নয়। ওদের মধ্যে সেরকম স্বভাব দেখিনি। আমার সাত বছরের বন্ধু ওরা। আশা করি বাকি জীবনও বন্ধু থাকবে। একদিন ওদের দাওয়াত দিলাম আমাদের বাসায়। ওদের বাবা-মাও এসেছিলেন। মা সেদিন ছুটি নিয়ে অনেক কিছু রান্না করেছেন। ওনারা লিভিং রুমেই বসেছিলেন। আমরা তিন বন্ধু মিলে অনেক গল্প করলাম। খেলাম। আমার আসল লক্ষ্য ছিল শান্তি ও স্বস্তিকে দেখানো। ওদের সারপ্রাইজ দিলাম। আমি পাখিকে কথা বলা শিখিয়েছি। কিছু না বলেই ওদের বারান্দায় নিয়ে বললাম, এই হলো আমাদের শান্তি ও স্বস্তি। তোমরা ‘হানিফ’ বলো, শান্তি-স্বস্তিও ‘হানিফ’ বলবে। রাইয়ান ও ওয়াহি জানে আমার ডাক নাম হানিফ।
রাইয়ান বেশি বিস্মিত হলো। বললো, কোথায় পেলি ওদের?
বাবার কথা বললাম।
ওয়াহি জানতে চাইলো কোনটার নাম শান্তি আর কোনটার নাম স্বস্তি। ওদের কাছে দুটোকেই এক রকম মনে হচ্ছিলো। আমি বোঝালাম, যে পাখিটা একটু বড়ো আর গায়ের রঙ বেশি সবুজ সেটাই হলো শান্তি আর যেটা ঠোট একটু ছোট এবং একটু কম লাল সেটা স্বস্তি। নামও যে বাবার দেয়া সেটাও বললাম। গত পরীক্ষায় দ্বিতীয় হওয়ায় যে এই পুরস্কার পেলাম তাও জানালাম।
রাইয়ান তো নাম শুনে অবাক। হাসতে হাসতে বললো, ‘অদ্ভুত তো।’ ওয়াহি আবার খিল খিল করে হাসছে।
আমি একটু রেগে গেলাম। তোদের সুন্দর লাগেনি?
তারপর বাবার মতো গম্ভীর হয়ে বললাম, দোস্ত, এই সময় সমাজে তো শান্তি ও স্বস্তিই বেশি দরকার। দেখো না, পেপারে আর টিভিতে প্রতিদিন কী দেখায়। দেশের মানুষ ভালো নাই। শুধু মারামারি। দেখ পাখি দু’টা কিন্তু মারামারি করে না। ওই যে বাগানের গাছগুলোও মারামারি করে না। আমাদের উচিত ওদের মতো হওয়া। পৃথিবী কত সুন্দর হতো তাহলে। রাইয়ান ও ওয়াহি আমার কথা শুনলো তন্ময় হয়ে। চোখ বড় বড় করে। এ জন্যই ওদের দু’জনকে আমার ভালো লাগে।
আসলে এসব দার্শনিক কথা বাবার কাছ থেকে শোনা। বাবা মাঝে মাঝে এসব বলে ওঠেন। অনেকবার শুনেছি। এমন করে বোঝান যে, মনে ঢুকে যায়। আমিও এখন বন্ধুদের এসব শুনাই। বাবার কথাগুলো অন্যদের শোনাতে ভালো লাগে। আমি বাবার মতো করেই ওদের বলি। বাবার অনেক কিছু আমি জানি। মা বলেছে। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতেন। আমি শুনেছি। তবে বাবাকে মনে হতো সক্রেটিসের মতো।
রাইয়ান ও ওয়াহি দরজায় শান্তি ও স্বস্তির ফুডলিস্ট দেখে বিশেষ অবাক হলো।
ওয়াহি তো বলেই ফেললো, ‘পাখিকে এত যত্ন করিস? ফুড লিস্টও বানিয়েছিস?’
বললাম, খুব কষ্ট হয় আমার। নিয়ম করে খাওয়াতে হয়। না হলে ওরা দাপাদাপি শুরু করে দেয়। শুধু কিচকিচ করবে তখন। আমি এখন বেড়াতেও যাই না। তা হলে ঘরের অন্যরা যদি ভুলে যায় খাবার দিতে। মাকে বললে বলবে, তোমার বাবাকে বলো, বিড়াল, পাখি এসব কি যে শুরু হয়েছে। এসব সামলাতে পারবো না আমি।
রাইয়ান বললো, আঙ্কেল তোকে অনেক দায়িত্ববান বানিয়ে ফেলেছে।
‘হ্যাঁ, বাবা বলে, একদিন আমাকে নাকি পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। তাছাড়া শান্তি ও স্বস্তি আমাদের পরিবারেরই দুজন এখন’, বললাম ওদের।
ওদের দেখাতে হলো কীভাবে কথা বলা শিখিয়েছি। আমি সুর করে ডাকতেই ওরা রোবটের মতো সুর করে ‘হানিফ’ বলে উঠলো। রাইয়ান আর ওয়াহি বিশ্বাসই করতে পারছিল না ব্যাপারটা। এতদিন পর ওদের ভারি সারপ্রাইজ দিলাম। ভালো লাগছিল।
রাইয়ান তো আজই ওর বাবাকে পাখি কিনে দিতে বলবে বলে জানালো। সাথে সাথে ওয়াহিও বললো,‘আমিও কিনবো।’ ওরা আঙ্কেলদেরও ডেকে আনলো বারান্দায়। খুব মজা হলো সেদিন।
কয়েকদিন পর রাইয়ান জানালো ওর বাবা দু’টি পাখি কিনেছেন। ওরাও একটা ফুড লিস্ট বানিয়েছে। ওরা পাখি দুটির নাম দিয়েছে আবির ও সিরাজ। ওয়াহি কিনলো কিছুদিন পর। ও নাম দিলো মিনু আর বিনা।
এরপর স্কুলে দেখা হলেই তিন বন্ধু টিয়া পাখি নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতাম। যার যার অভিজ্ঞতা শুনতাম আমরা। আমি ওদের পরামর্শ দিতাম। কারণ আমার যে বেশি অভিজ্ঞতা। তবে তিনজনেরই আনন্দের আর সীমা নেই। পাখি পালতে পালতে আমরা যেন অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। আমাদের আলাদা একটা জগত তৈরি হলো। আমাদের মনে হতো একদিন আনন্দের এই আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেবো আমরা। আমি বিশেষ পুলকিত হতাম এই ভেবে যে, আমি এক্ষেত্রে ওদের নেতা।

পাঁচ.
জীবন স্রোতের মতো বয়ে যায়। সেই স্রোতে মিশে থাকে সুখ ও দুঃখ দু-ই। মাঝে মাঝে জীবনে কেবল সুখের প্রবাহ থাকে। এরকম সময়ে যদি দুঃখ আসে তখন জলোচ্ছ্বাসের মতো মনে হয় তাকে। যার আঘাতে সুখ যেন হারিয়ে যায় বহু দূরে।
আমার জীবনেও তেমনি জলোচ্ছ্বাস এলো হঠাৎ। ২০০৯-এর সেই সময়টায় দেশে চলছিলো তুমুল হরতাল-অবরোধ। প্রায় গৃহযুদ্ধ। স্কুলে যেতে পারতাম না। বন্ধুদের সঙ্গেও তাই দেখা হতো না। পেপারে দেখতাম শুধু মানুষ মারা যাচ্ছে। কত ভয়ানক সংবাদ যে থাকতো পেপারে। অনেক পোড়া, গুলি খাওয়া, রক্তাক্ত মানুষে ছবি দেখেছি তখন পেপারে। আমার চোখে অনেক সময় পানি চলে আসতো এরকম ছবি দেখে। শিশুদেরও দেখতাম এসব ছবিতে। শিশুদের কান্নার ছবি দেখেছি অনেকদিন।
আমার স্কুল ছিল ইকবাল রোডে। আমাদের বাসা থেকে তা কাছেই ছিল। কিন্তু ঝুঁকির পরিমাণ ছিল তখন অনেক বেশি। আমরা স্কুলে না গেলেও চলতো কিন্তু বাবা মাকে চাকুরিতে যেতেই হতো। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই বাবা আর মা অফিসে যেতেন। প্রতিদিন রাতে দেখতাম তারা পরের দিনে আসা-যাওয়া নিয়ে টেনশন করতেন। ভয়াবহ অবস্থা তখন। খুব সতর্ক থাকতে হতো। অনেকে জখম হচ্ছিলেন।
বাবা শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি তিনি বিকেল-সন্ধ্যায় কোথায় যেন কাজ করতেন। ফলে প্রতিদিনই বের হতেন।
এভাবে জুন এলো। জুন মাসের এগারো তারিখ। মঙ্গলবার। বাবা সেদিনও বের হলেন নয়টার দিকে। হরতাল ছিল সেদিন। আমি স্কুলে যাইনি। শান্তি-স্বস্তির যত্ন নিচ্ছিলাম। এই কয়েক বছরে ওরা বেশ বড় হয়েছে। খাবারও লাগে অনেক বেশি। পরিবারেও ওরা অতি আপন সদস্য। তবে এইসময় ওদের প্রতি অবহেলাও হতো খুব। বাসায় কারো মনে শান্তি ছিল না। টেনশন থাকতো। কেউ বের হলেই না ফেরা পর্যন্ত টেনশন চলতো। ১১ জুনও টেনশন করছিলাম, বাবা কখন ফিরবে ভালোভাবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাই মন চলে যাচ্ছিলো আকাশের সাদা সাদা মেঘগুলোর দিকে। মেঘগুলো কোথায় যায়? ওদের বাবা মায়ের কাছে? কিংবা বন্ধুদের কাছে? ওদের দেশে কি কোন দুশ্চিন্তা আছে? না বোধহয়। আকাশের জগত তো শান্তির জগত। মাঝে মাঝে এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় এসেই ঘুমিয়ে পড়তাম।
অসময়ের এসব ঘুম থেকে মা অনেক সময় ডেকে তুলতেন। সেদিনও তাই হলো।
‘যাও গোসল করো। দুপুর হয়েছে।’ বললেন মা।
আমি বললাম, ‘মা, বাবা আজ কখন আসবে?’
মা বললেন, ‘চলে আসবে কিছুক্ষণ পরে। তুমি যাও।’
সময় যত যাচ্ছিলো, আমি ততই দুশ্চিন্তা করছিলাম সেদিন। সন্ধ্যা হলো একসময়। মা বললেন, ‘হানিফ, তোমার বাবা আসছেন না কেন আজ। ফোনও দেখছি বন্ধ। টেনশন করতে করতে জীবনটা কয়লা হলো।’
মা এভাবেই বলেন সবসময়। আর এসময় আমার রাগ হয়। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ। ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত টেনশনই এই সমস্যার কারণ। মায়ের এ সমস্যাটি মায়ের প্রায়ই হতো। ডাক্তার টেনশন করতে নিষেধ করেছেন। আমি করেছি। বাবা করেছেন।
তাও মা টেনশন থামাবেন না। আমি গলা চড়িয়ে বললাম, ‘তুমি না খালি খালি টেনশন কর। আর প্রেসার বাড়াও।’
‘তোর বাবা অফিস থেকে এত দেরি করে আসবে, আর আমি টেনশন করবো না? হাসি হাসি করে বসে থাকবো?’
মনে হলো মা অনেক রেগে গেছেন। আমি আর তর্ক করলাম না। খাবার খেয়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। আসলে বাবার জন্য যে আমিও ভাবছিলাম। পড়ার সময়ই নানান আকাশ কুসুম ভাবছিলাম। বাবা তখনও বাসায় ফেরেনি। বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো আমারও। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও টেনশন করতে শুরু করলাম। আলতো একটু ঝিমুনিও চলে এলো।

শান্তি ও স্বস্তি

ছয়.
ঘুমে বেশ ডুবে গিয়েছিলাম বোধ হয়। ফোনটা বেজে উঠলো। মা এই ফোনটা কিনে দিয়েছেন। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দরকারি কথা বলার জন্য। স্কুলে ক্লাস শেষ হলেই ভ্যানে উঠতে হয়। বন্ধুদের সঙ্গে কোন কথাই বলা যায় না। আবার বাবা-মাও টেনশন করেন আমার সঙ্গে কথা না বলতে পারলে। এই ফোনেই অফিস থেকে মা-বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেন। টেবিলেই থাকে ফোনটি।
কিন্তু এখন কে ফোন করছে– নিশ্চয়ই বাবা, কিন্তু অপরিচিত নাম্বার যে!...তাও হাত বাড়িয়ে দিলাম।
‘হ্যালো খোকা’
‘হ্যালো, বাবা?’
বাবার কথাগুলো স্বাভাবিক শোনাচ্ছিলো না। কেমন যেন কাঁদো কাঁদো গলা। কণ্ঠটা কেমন দুর্বল শোনালো। আমি ভয় পেয়ে যাই। বুকটা ধড়পড় করে উঠে। এতক্ষণ যে ভয় কাজ করছিলো সেটাই এবার শব্দ করে বেরিয়ে এলো:
‘কী হয়েছে, বাবা? তুমি আসছো না কেন?’
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনালো। ‘হানিফফফফ, আমি গুরুতর আহত হয়েছি।’ বাবার কণ্ঠে কান্না আর কষ্ট।
হঠাৎ যেন চোখ দুটো অশ্রুর পুকুর হয়ে যায়। কেউ যেন ছুরি বসালো কোথাও আমার শরীরে। ভয়ঙ্কর কোন আঘাত পেলাম যেন।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলাম, ‘কী বললে বাবা?...কীভাবে...?’
‘হানিফ, আমি ঢাকা মেডিক্যালে আছি, মাকে বলো। আমার অবস্থা খারাপ। আমাকে দেখতে আসো তোমরা...মনে হচ্ছে মরে যাবো।’
‘বাবা, কী বলছো...মরে যাওয়ার কথা বলছো কেন....এক্ষুণি আসছি আমরা।’
ফোনটা রেখে অজান্তেই একটা চিৎকার দিলাম...‘মাআআ’। বিষাদে ছেয়ে গেল মনটা। ছোটাছুটি করতে শুরু করলাম। মা ঘুম ভেঙ্গে দৌড়ে এলেন। চোখে মুখে বিরক্তি, উদ্বেগ। ভেবেছেন আমি বোধ হয় বিড়ালকে দেখে চিৎকার করেছি। কিন্তু আমাকে ঢুকরে কাঁদতে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে, হানিফ?’
‘মা, বাবা আহত হয়েছেন খুব। বলছেন বাঁচবে না। মেডিক্যাল কলেজে আছেন। যেতে বলেছেন এখনি।’ এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে আবার কাঁদতে শুরু করলাম।
‘কি ভাবে জানলি তুই, কি বলছিস এসব?’ মা আমার শরীরে ঝাঁকুনি দিলেন।
‘সত্যি মা। বাবা কোথা থেকে যেন ফোন করেছিলেন। তুমি ফোন করো।’ মায়ের চোখে মুখে অচেনা এক আতঙ্কের ছাপ। পাগলের মতো ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু বাবার ফোন বন্ধ। বাসার সবাই জড়ো হয়ে গেল মায়ের চারপাশে। দাদা দাদি, কাজের মেয়ে স্বপ্না– সকলের ঘুম ভেঙ্গে গেছে ততক্ষণে। সবাই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সবচেয়ে বেশি কাঁদতে শুরু করলেন দাদি। ওনাকে কাঁদতে দেখলে আমার খুব কষ্ট লাগে। আমিও জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করলাম। মা দৌড়ে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে গেলেন। সবাই আমরা হাসপাতালে যাবো। আমি বারান্দায় শান্তি ও স্বস্তি’র কাছে গেলাম। ইচ্ছা করছিল ওদের বাবার খরবটা দিই। ওরা কি কিছু বুঝলো? কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি আরও কেঁদে ফেললাম। ওদের এত শান্ত দেখে আমি বুঝে ফেললাম সত্যি বাবার খারাপ কিছু হয়েছে।
নীলক্ষেত্রের কাছে দিয়ে শহীদ মিনারের পাশেই মেডিক্যাল কলেজ। অনেক আগে বাবা শহীদ মিনার দেখাতে এনেছিলেন। তখন মেডিক্যাল কলেজ দেখিয়ে বলেছিলেন কখনও কেউ আহত হলে এখানে আসতে হয়। আজ আমরা এলাম সেই একই কারণে। হরতাল থাকায় অনেকক্ষণ কোন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিলো না। অনেক কষ্টে দুটো স্কুটার রাজি হলো। মা আর আমি একটা সিএনজিতে; দাদা-দাদি আরেকটা সিএনজিতে। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলছে। দাদি যদি অজ্ঞান হয়ে যান– এই ভয়ে তাঁকেও নিয়ে আসা হয়েছে।
জরুরি বিভাগে ঢুকেই মা কোথায় কোথায় যেন খোঁজ করতে শুরু করলেন। দাদাও অনেক তথ্যকেন্দ্র খুজতে গেলেন। আমি দাদিকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এখানে কেমন যেন অন্যরকম গন্ধ। মানুষ আর মানুষ। সবাই ব্যস্ত।
একজন চশমা পরা লোক বসে আছে একটা রুমে গ্রিলের জানালার ভেতর। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। মা আকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আজ আহমেদ ইসলাম নামে কোন লোক কি ভর্তি হয়েছে এখানে, আপনি কি একটু সাহায্য করতে পারবেন ভাই?’
বেটে খাটো লোকটা, পান চিবাতে চিবাতে একটা বড় খাতা খুললেন, ‘...একসিডেন্টের কেইস?...তিন তলায় যান অর্থপেডিক বিভাগে, আপনারা কী ওনার ফ্যামিলি?’
‘কত নাম্বার বেডে?’ মা জানতে চাইলেন।
‘ওয়ার্ডে যেয়ে দেখেন।’ বলে লোকটা অন্য কাজে মন দিলেন।
মা আর দাদা প্রায় দৌড়ে লিফটের দিকে যাচ্ছেন। আমি আর দাদিও জোরে জোরে হাটতে শুরু করলাম। বিশাল বিল্ডিং। ফ্লোরেও অনেক মানুষ শুয়ে আছে। ট্রলিতে শুয়ে আছে অনেক। তাদের টেনে টেনে নেয়া হচ্ছে কোথাও যেন। বাতাসে কেমন যেন গন্ধ। সাদা সাদা ড্রেস পরে ঘুরছে অনেকে।
দাদা ডাকলেন, ‘হানিফ তাড়াতাড়ি আসো।’
আমি দাদিকে প্রায় টানতে টানতে এগোতে শুরু করলাম।
আগে লিফটে উঠলে কেমন যেন মজা লাগতো। মনের মধ্যে কিসের যেন স্পন্দন হতো। আজ কোন কিছু নেই। কেবল আতঙ্ক আর উদ্বেগ। দাদা-দাদি-মা কেউ কথা বলছেন না। আমিও চুপ করে থাকলাম।
লিফট খুলতেই মা প্রায় দৌড়ে করিডর পার হলেন। আমি আর দাদি আস্তে আস্তে আগাচ্ছি।
একসময় দূর থেকে দেখছি মা পেয়ে গেছেন বাবার খোঁজ। দরজার বাইরে একটা স্যাঁত স্যাঁতে বিছানায় বাবা শুয়ে আছে। শরীরের অনেক জায়গায় ব্যান্ডেজ। শার্টটা দেখলাম কেমন ময়লা। রক্তের দাগ এখানে সেখানে। আমি পা দু’টো ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুঝতে পারছি না কী করবো। বাবার শরীরটা নড়ছে না। খুব ঠান্ডা মনে হলো।
দাদা কী সব ডাক্তারি কাগজপত্র পড়ছেন। দাদিরে সামলানো যাচ্ছে না। মা সাদা এপ্রন পরা একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। আমি অবাক হয়ে দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা, উনি কী ডাক্তার?’
‘না, উনি নার্স’, বললেন দাদা। ওনার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে। মনে হলো আমাদের পরিবারের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল আজ থেকে।
ইতিমধ্যে একটু একটু করে অনেক খবর জমা হলো। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে বাবার এই অবস্থা হয়েছে। বাসে বাবার একজন বন্ধুও ছিল– সাফায়েত জাব্বার। তিনি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। হরতাল ছিল বলে বাসে কারা যেন ইট ছুঁড়ে মেরেছে। ইট এসে লেগেছে বাবার মাথায়। সাথে সাথে মাথা ফেটে যায়। সবাই হুড়াহুড়ি করে নেমেছে বাস থেকে। বাবা অনেকক্ষণ বাসেই পড়েছিলেন। পরে সাফায়াত সাহেব বাবাকে খোঁজ করতে করতে বাসের ভেতর পান এবং টেনে কোলে তুলে রিক্সায় ওঠান।
দাদা খোঁজা খুঁজি করলেন, কিন্তু সাফায়াত আঙ্কেলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। হয়তো চলে গেছেন। দাদা আবার জরুরি বিভাগে গেলেন কোন ফোন নাম্বার পাওয়া যায় কি না সেই আশায়। বাবার ফোনটাও কোথাও পাওয়া গেল না। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। স্যালাইনের একটা সুঁই বাবার হাতে ঢোকানো হয়েছে। মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে অর্ধেক। ব্যান্ডেজ বাঁধা সেখানে।
একজন লোক আসলেন এপ্রন পরা। মা আর দাদা ঘিরে ধরলেন তাঁকে।
‘আপনারা কী ওনার আত্মীয়?’ জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ, ডক্টর’, মা জবাব দিলেন। আমি বুঝলাম উনিই বাবার চিকিৎসা করবেন। তাঁর কথা শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখলাম।
ওনার কাছে বাবার অবস্থা শোনা গেল। বাবাকে এখনি আরও উন্নত চিকিৎসা দেয়া দরকার। সাফায়াত আঙ্কেল কোথায় কোথায় যোগাযোগ করেছেন। বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হবে। রক্ত লাগবে। আমাদের সরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে বললেন ডক্টর। দু’জন নার্স বাবার শরীর নাড়া-চাড়া করতে শুরু করলো।
দাদি আর আমি পাশের একটা বেঞ্চিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সাত.
হাসপাতালে যখন দ্বিতীয় দিন এলাম তখন বাবা সুন্দর একটা রুমে। এবার জুতা খুলে ডুকতে হলো। অনেক রোগী এই রুমে। সবাই শুয়ে আছে। রুম জুড়ে কত যে যন্ত্রপাতি। প্রথমে আমি আর দাদা বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখনও ঘুম ভাঙ্গেনি তাঁর। ব্যান্ডেজের আয়তন এবার আরও বেড়েছে। চুল সব ফেলে দেয়া হয়েছে।
বাবার মাথায় আঘাত করা পাথরের টুকরাটার কথা ভাবতে লাগলাম চুপচাপ। যেন আমাকেই কেউ সেটা ছুঁড়ে মেরেছে।  মনটা বিষাদসিন্ধু হয়ে গেল। কত যে তোলপাড় হচ্ছে সেখানে। বাবার এই মুখ তো কোনদিন দেখেনি। দেখার কথা ভাবিওনি। গোঁফ  দাঁড়িওয়ালা বাবার সেই নির্মল মুখ কী আর দেখবো কোনদিন! কেমন যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছি। দাদা, মা কারও মুখের দিকে আর তাকানো যায় না।
আমি আর দাদা বের হওয়ার পর মা ঢুকলেন রুমটিতে। তাঁর চোখে মুখে বিষাদের ছাপ। নার্স এসে বললেন, ডাক্তার সাহেব দাদা আর মা’র সঙ্গে কথা বলতে চান। আমিও ওনাদের সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। ডাক্তার কী বলেন শোনার খুব ইচ্ছা আমার। ডাক্তারের ডাকের কথা শুনে মা যেন আরও মন খারাপ করলেন।
নার্সের কথা মতো চার তলার আট নম্বর রুমে ঢুকলাম মা ও আমরা। দরজাটা বন্ধই ছিল। নার্স প্রথমে ঢুকলেন, তারপর আমাদের ঢাকলেন। এই ডক্টরকে আগে দেখিনি। চুলগুলো সাদা, বাবার মতো মুখে দাঁড়ি গোঁফ। অনেক বয়স্ক। বিশাল এক টেবিলের অপরদিকে বসে আছেন। সালাম দিয়ে মা আর দাদা বসলেন। আমিও পাশে বসতে নিয়েছিলাম। দূরের চেয়ার দেখিয়ে, মা বললেন হানিফ তুমি ওইখানে বসো।
মা কেন আমাকে পাশে বসতে দিলেন না বুঝতে পারলাম না। বাবার কথা আমি জানবো না?
আপনারা আহমেদ সাহেবের কে কী হন? জানতে চাইলেন ডক্টর।
মা আর দাদা ওনাদের পরিচয় দিলেন। আমার কথা বললেন। ডাক্তার সাহেব ভাবলেশহীন চোখে একবার আমার দিকে তাকলেনও। তারপর কথা বলতে শুরু করলেন। আমি দূর থেকেও কিছুটা শুনতে পেলাম। দাদা আর মায়ের মুখে রাজ্যের কৌতূহল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে আছে তাদের। ডাক্তারের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন।
“আমি ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী। জানি আপনাদের মন খারাপ। কিন্তু কী করবেন। দেশটাতে তো অরাজকতা চলছে। রাজনৈতিক কারণে সকলে আমরা কোন না কোনভাবে সাফার করছি।” তারপর থামলেন উনি খানিকটা।
‘ডাক্তার সাহেব আমার স্বামীর কী অবস্থা?’, মা বিস্তারিত জানতে উদগ্রীব।
“দেখুন, আমি এখনি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছি না। স্ক্যান রিপোর্টটা আসুক। ইট তো সরাসরি কোন মাথায় এসে লেগেছে। আর এ জায়গাটা শরীরের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।’ বলেই ডাক্তার হাত দিয়ে মাথার পেছনটা দেখালেন।
বুঝলাম বাবা এ জায়গাটাতে আঘাত পেয়েছেন।
ডাক্তার বলেই যাচ্ছেন।
‘ইসলাম সাহেবের আঘাত বেশ গভীর। এখন শরীরে এর প্রতিক্রিয়া কী হয় তা এখনি বোঝা যাবে না। স্মৃতিশক্তিতে কোন সমস্যা হয় কিনা তাও বুঝতে সময় লাগবে। মনে হয় কিছু হবে। আপনারা মানসিক প্রস্তুতি রাখুন। ওনার জ্ঞান ফিরে এলে কোন কিছু চিনতে সমস্যা হলে জোরাজুরি করবেন না আপনারা। অনেক সময় উনি হয়তো সামান্য আগের ঘটনাটিও ভুলে যেতে পারেন।...’
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনতে শুনতেই মা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন: ‘ডক্টর, এসব কোনভাবেই কি চিকিৎসাযোগ্য নয়? আমাদের চিনতে পারবে না ও?’
ডাক্তার বললেন, ‘আপনি শান্ত থাকুন। এত অস্থির হবেন না। এরকম তো সবসময় হবে না। মাঝে মাঝে এসব সিমটম দেখা যেতে পারে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ইমপ্রুভও করতে পারেন। ওনার কিছু সার্জারির দরকার। আপনারা একজন এই কাগজগুলোতে স্বাক্ষর করে দিন।’
‘বাবা, আপনি করেন’ বলে মা কাগজগুলো দাদার দিকে ঠেলে দিলেন।
আমার কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল। বাবা যে কবে সুস্থ্য হবে!
ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও তখন উঠে দাঁড়ালাম।
‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই, সব ইমপ্রুভ করবে আর সবকিছু সহজভাবে নিতে হবে।’ এই বলে আমাদের বিদায় দিলেন ডাক্তার। আমরা তিনজন কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছি না। অন্ধকারে ডেকে গেল যেন সবার মন। নিয়তি কেন আমাদের এমন কষ্ট দিচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমি আর মা বাসায় এলাম। দাদা হাসপাতালেই থেকে গেলেন। রাতে ফিরবেন।

আট.
আমার হাসপাতালে যাওয়া অনেক কমে গেল। মা আর দাদাই আসা যাওয়া করেন এখন। দাদি শুয়ে শুয়ে কেবল কাঁদেন। বাসায় প্রায়ই একা একা লাগে। অনেকদিন শান্তি আর স্বস্তির ভালো করে যত্ন নেওয়া হয় না। বাবা নাই বলে ওদের এখন আর কলা এনে দেয়া হয় না। কেবল ভাত খাচ্ছে ওরা। ওরাও সারাদিন ঝিম মেরে বসে থাকে। আগের মতো আর কিচকিচ করে না। ঝাপটা ঝাপটিও করে না। আমিও আর ওদের বলি না...‘হানিফ’ বলে ডাকো তো!’
প্রায় তিন সপ্তাহ পর বাবা সুস্থ্য হয়ে বাসায় এলেন। সবাই ব্যস্ত। তবে সবাই আমরা খেয়াল করলাম বাবা আর আগের মতো নেই। অনেক পাল্টে গেছেন তিনি। আমরা সবাই শুধু তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। কী চেহারাটা কী হয়ে গেল। ডাক্তার যা বলেছিলেন তাই হলো পুরোপুরি। বাবার স্মৃতিশক্তি আর আগের মতো কাজ করছে না। ওনার যে কী হয়েছিল সেটাও বলতে পারছেন না। মনে নাই।
হাসপাতাল ছাড়ার দিন ডাক্তার এও বলে দিলেন মাকে, দুর্ঘটনার ব্যাপার নিয়ে বাবার সঙ্গে যেন উচ্চবাচ্য করা না হয়। আমাকেও এ ব্যাপারে মা নিষেধ করে দিলেন।
আমার আর কোন নিষেধেরই দরকার ছিল না। আমি বাবার কাছাকাছিই আর যাচ্ছিলাম না। কাছাকাছি গেলেই মন খারাপ হতে লাগলো। বাবা পাঁচ মিনিট আগে কি করেছেন সে কথাও মনে করতে পারছিলেন না। তাঁকে সেটা মনে করিয়ে দিতে হতো। এই যেমন, রাতের খাবার খাওয়া শেষ করলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই মাকে আবার বলবেন, ‘রাশেদা, আমাকে ভাত দাও; একটা ডিম ভেজে দিও।’
ডিম ভাজি বাবার ফেভারিট। আমি দাদার কাছে শুনেছি, ছোটবেলা থেকে নাকি এটা বাবার প্রিয় খাবার।
কিন্তু এখন তো আর ডিম ভাজি দেয়া যাবে না। বরং আমি আর মা বাবাকে অনেকক্ষন বুঝিয়ে বলি যে, কিছুক্ষণ আগেই তিনি রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছেন। শোনার পর বাবা অনেক পরে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ তাঁর মনে পড়েছে তিনি ডিনার করে ফেলেছেন।
এ ধরনের স্লো স্মৃতিশক্তি নিয়ে কাজে কর্মেও বাবার সমস্যা হতো। দিন রাত বাবাকে নিয়ে এসব জটিলতায় সবাই ক্লান্ত হয়ে যেতে লাগলাম আমরা। শান্তি ও স্বস্তি দুটোই ধীরে ধীরে হারাতে লাগলো পরিবার থেকে।

নয়.
এই ফাঁকে আবার আসল শান্তি ও স্বস্তির খবর দেয়া যাক। ইতোমধ্যে ওদের যত্ন-আত্তি অনেক কমে গিয়েছিল। আমার মনোযোগ পুরোটাই রাখতে হতো বাবার দিকে। বাবার আচরণে অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখে যেত অনেক। তাই যতক্ষণ জেগে থাকতেন– আমরা খুব নজর রাখতাম ওনার দিকে। বাবা ঘুমালে আমি শান্তি ও স্বস্তির কাছে যেতাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ওদের খাবার-দাবার অনেক কমে গিয়েছিল। সেই সকালের সরিষা ও কলা দেখতাম বিকালেও পড়ে আছে। খাচার এক পাশে যেয়ে চুপচাপ বসে থাকতো ওরা। আগের মতো আমাকে দেখে ধাপাধাপি দেখতাম না। খায় কম। নড়েও না-চড়েও না। কিছুই করে না।
ইতিমধ্যে শীত শেষ হয়েছে। বসন্ত আসবে। কিন্তু আমাদের পরিবারে সবারই দুশ্চিন্তা। বাবার পাশাপাশি আমার শান্তি ও স্বস্তির জন্যও দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো। ওরা না খেলে তো বাঁচবে না। বিশেষ করে ভয় হতো শান্তির জন্য। ও একদম খেতো না।
একটু একটু সুস্থ্য হয়ে বাবাও বারান্দায় এসে দেখতেন ওরা খাচ্ছে না। তিনি পাখিদের বিষয়ে বেশি জানেন। কয়েকদিন এভাবে দেখে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখতাম। আমি জানতাম শান্তির এ অবস্থা নিয়ে বাবার মনে কোন ভয় লেগেছে।
অক্টোবর এলো। আগের মতো আর হরতাল হচ্ছে না এখন। আমার স্কুল আবার শুরু হয়ে গেল। সেই ভোরে উঠে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে ফেরা, বিকালে পড়তে বসা। ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি। স্কুলে যাওয়ার আগে স্বপ্নাকে বলে যেতাম শান্তি ও স্বস্তিকে গোসল করাতে, খাবার দিতে। মাকেও বলতাম। কিন্তু স্কুলে যেয়ে দুশ্চিন্তা হতো, শান্তি ও স্বস্তিকে খাবার দেয়া হয়েছে কি না কে জানে?
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের একটা দিন। সেদিন তিনটা ক্লাস টেস্ট ছিল। সবই ভালোভাবে হলো। বাসায় ফিরলাম। বাবা কোথায় যেন কোথায় গিয়েছেন। সবার দেখি মন খারাপ। মা বিষন্ন মুখে বলে আছেন। মাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে মা? তিনি কিছু বলছেন না। রান্নাঘরের সামনে স্বপ্না দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেশহীন। তাকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানতে পারলাম না। কেবল ইশরায় বারান্দার দিকে দেখালো। বুকটা ধক করে উঠলো। শান্তি-স্বস্তির কিছু হলো নাকি! দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। মনটা শূন্য হয়ে গেল। আমার সব আনন্দ যেন কেউ নিয়ে গেল। এরকম খারাপ কোন দৃশ্যের কথা কোন দিন ভাবিনি।
চোখটা পানিতে ভরে গেল। মনে হলো আমার চারপাশে আর কিছু নেই। খাচার ভেতর শুয়ে আছে শান্তি। চোখ দুটো বন্ধ। বুঝতে আমার সময় লাগলো না, ও মারা গেছে। চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল পাখিটা আমার। কখনো আর ও ডানা ঝাপটাবে না। কিচকিচ করবে না। হানিফ বলে ডাকবে না। শান্তির গায়ে রক্তের দাগও ছিল। কিসের যেন খামছির দাগ। মা আর স্বপ্না কখন যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওনারা বললেন সকালে বারান্দার দরজা খুলেই ওকে এভাবে পাওয়া গেছে। মনে হয় বিড়াল রাতে আঁচড় দিয়েছে। দুর্বল ছিল বলে বিড়ালের থাবা থেকে সরে পড়তে পারেনি।
মনে পড়লো সেদিনটির কথা। যেদিন আমরা ওদের ফুড লিস্ট করছিলাম সেদিনই বিড়ালটা কেমন রেগেমেগে তাকাচ্ছিলো শান্তি-স্বস্তির দিকে। তার মানে শেষ পর্যন্ত ও প্রতিশোধ নিয়েছে?
খাঁচার এক পাশে একেবারে শিকের পাশে লেগে বসে আছে স্বস্তি। স্বপ্না বললো সকাল থেকে কিছুই খাচ্ছে না। তাকাতেই মনে হলো ও যেন কাঁদছে। বন্ধুহীন একা হয়ে গেল স্বস্তি। সোজা যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার আজ কিছু ভালো লাগছে না। ভাতও খেলাম না।
মা ডাকলেন। ধমকালেন। কাকুতি মিনতি করলেন। কিন্তু তাও উঠলাম না। পাখিটিকে হারিয়ে ভালো লাগছে না। প্রবল দুঃখ আর আতঙ্ক লাগছিল। আমাদের পরিবারে এমন হচ্ছে কেন। বাবার এ অবস্থা। শান্তি মরে গেল। নিয়তি কেন আমাদের সবকিছু এভাবে দুঃখে ভরে দিচ্ছে। কী অন্যায় করছি আমরা। চোখে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। শুধু কান্না আসছিল।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। বিকেলে উঠে দেখি বাবা আর স্বপ্না বাসার পাশের বাগানটির কোনায় ছোট একটা গর্ত খুড়েছে। বাবার মুখটা শুকিয়ে আছে। ছোট একটা কবর বানানো হচ্ছে মাটি খুড়ে। আমি ওঠার পর সেখানে শান্তিকে রাখা হলো। বাবা ওর গায়ের উপর মাটি ভরে দিলেন। অনন্ত বিশ্রামের জগতে চলে গেল শান্তি। আমাদের সঙ্গে ওর আর দেখা হবে না কোনদিন। স্বস্তিও ওকে আর পাবে না সঙ্গে। একা একা আমাদের ছেড়ে কীভাবে থাকবে শান্তি– বুঝতে পারছি না। স্বস্তিকে ছাড়া ওর কষ্ট হবে অনেক। আমাকেও নিশ্চয়ই অনেক মিস করবে শান্তি। কত যে বেশি বেশি খাওয়াতাম ওকে। আবার চোখ বেড়ে পানি নামতে লাগলো।

দশ.
সময় যত গড়িয়েছে আমি বুঝেছি, শান্তিকে ছাড়া স্বস্তির ভালো লাগছিল না একট্ওু। থাকতে ইচ্ছা করছিল না। এখন আবার ও খাঁচায় ছোটাছুটি করে। তবে এটা যে আগের মতো আনন্দে নয় বুঝতে পারি। ও, এখন মুক্তি চাইছে। ওকে সেখানে রাখা হয় সেখান থেকে বাগানে শান্তির কবর দেখা যায়। খাঁচার কোনায় বসে প্রায়ই এক মনে ওদিকে তাকিয়ে থাকে স্বস্তি। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। কতকিছু দিচ্ছি কিন্তু কিছুই খেতে চায় না। আবার ভয় পাই আমি। বাঁচবে তো স্বস্তি। ও-ও যদি মরে যায়? বিড়ালটা আর আসছে না এদিকে। কিন্তু এখন স্বস্তির যে কষ্ট হচ্ছে এতেই তো ও মরে যাবে ও! আমার কথা ও আর ভাবছে না। শান্তিকে হারিয়ে আমার শোক, বাবার ব্যথা বোধহয় স্বস্তির মনে আসে না। আমাদের কথা ছাপিয়ে শান্তির কথাই ওর মনে পড়ছে। ও বোধহয় শান্তিকে খুব বেশি মিস করে। মনে হয় ভাবছে শান্তির সঙ্গে গেলেই ভালো হতো। কী ভেবে যেন স্বস্তির যত্ন বেড়ে গিয়েছিল পরিবারে। কিন্তু ও আর গ্রাহ্যই করছে না।
বছর শেষে আমার পরীক্ষার মাস চলে এল। পড়ালেখার চাপটা ছিল বেশি মাত্রায়। বৃহস্পতিবার  আড়াই ঘণ্টার ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শনিবারে আবার গণিত পরীক্ষা। সব চ্যাপ্টার রিভিশন দিতে হবে। বাবা আবার ম্যাথস্ এর রেজাল্টাই খেয়াল করবেন বেশি। তবুও স্বস্তির কাছে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর পড়তে বসলাম। কিন্তু দিনগুলো খুব ক্লান্তিকর লাগছিল। রাত দশটাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। অথচ এগারোটার আগে তো কোনদিন ঘুমাই না।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেও দেরি হয়ে গেল। বাবা বিছানায় নেই। বারান্দায় যেয়ে রীতিমতো শিউরে উঠি। এ কোন আতঙ্কের প্রহর। পাখির খাঁচাটা খালি। বাবা উঠানে শান্তির কবরের কাছে একটু একটু করে মাটি খুঁড়ছেন। একটা বড় সাদা কাগজের উপর স্বস্তি শুয়ে আছে। শেষদিন শান্তি যেভাবে শুয়ে ছিল। পাখাগুলো আর টানটান নেই। পা দুটো সোজা হয়ে আছে।
স্বস্তিকে দাফন করা হলো শান্তির পাশেই। আমার খুব বেশি খারাপ লাগছিল না। ওরা একসঙ্গে থাকতে পারবে এখন থেকে। অনন্তকাল তারা এভাবেই থাকবে। কেউ পারবে না তাদের এই একান্ত ঘুম ভাঙ্গাতে।
বাসায় এসে বাবা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। আশ্চর্য হলাম। এরকম তো কোনদিন দেখেনি।
একা একা নিজেই বলে উঠলেন, ‘না, এবার বিড়ালটা মারেনি। একা থাকতে থাকতেই স্বস্তি মরে গেল। কত যে যত্ন করলাম ওদের এত বছর।...’
বাবার কথা আটকে গেল। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। চোখ-মুখ ফুলে আছে তার। তাকানো যাচ্ছে না।
আমি বারান্দায় খালি খাঁচাটার কাছে যেয়ে বসে থাকলাম। কেউ নেই সেখানে। কেউ নেই আজ কোথাও। বেডরুমে যেয়ে এবার আমিই একা একা কেঁদে ফেললাম। জানতাম, আর কোনদিন শান্তি আর স্বস্তির সঙ্গে দেখা হবে না। ওদের হারিয়ে আমার ভেতরের শান্তি ও স্বস্তির জগতটা একেবারে হারিয়ে গেল যেন। কিন্তু ওরা তো নিশ্চুপ আরামের অন্তত এক শান্তির জগতে থাকতে পারবে। এর তো তুলনা নেই। ভালো থাকুক ওরা। প্রিয় শান্তি ও স্বস্তির জন্য আমি না হয় কষ্ট নিয়েই থাকবো।

এগার.
বহুদিন পার হলো। ডায়েরিতে সবসময় আর লেখা হয় না প্রিয় কথাগুলো। বড় হয়ে গেছি। কত ব্যস্ততা। কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে চাকুরি পেলাম। বাবা-মা অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। স্বপ্না আর আমাদের বাড়িতে কাজ করে না এখন। প্রায় সাত বছর হলো সে চলে গেছে। এখন যে কাজ করে তার নাম রেহানা।
সেই পুরানো বাড়িতে বাবা-মাকে নিয়েই আছি আজও। ওনারা চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পরিবারে আমিই এখন বাইরে কাজ করি। আর্থিক দিক আমিই সামলাই। সবমিলে ভালো আছি আমরা। তবে আজও শান্তি আর স্বস্তির কথা মনে পড়ে। ওদের ভুলে যাইনি। আমি তো জানি ওরা মরে যায়নি। আমি কখনো ওদের কবরের দিক তাকাই না। তাকাতেও চাই না। আমার মনের জগতে ওরা আছে। ওদের ওড়াওড়ি দেখি আজও। ওরা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। আমিও আছি ওদের পাশে। ওরা মুক্ত হলেও আমাকে ছেড়ে যায় না কোথাও। এটা যে কত ভালো লাগে। যখন একা থাকি, অবসর সময়, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখে অনেকসময় পানি চলে আসে। চোখের পানিতে দূরের আকাশকে অস্পষ্ট লাগে। সাদা সাদা মেঘগুলোকে পাখির ভাস্কর্য মনে হয়। মনে হয় মেঘগুলো পাখি হয়ে গেছে। মনে হয় ওই সাদা পাখি দুটোই শান্তি ও স্বস্তি। ওরা যেন কথা বলে।
‘কাঁদছো কেন, হানিফ?’
আমি বলে উঠি, ‘একা লাগছে যে।’
‘কী বলছো তুমি এসব। আমরা তো তোমার কাছেই আছি। সাথে আছি। চিরকাল থাকবো। চল, বাগানে খেলি।’
এই বলে ওরা উড়তে শুরু করে। আর কী আশ্চর্য, দেখি আমিও খেলছি ওদের সঙ্গে। আমরা তিনজন..আমি...স্বস্তি...শান্তি। সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি যেন আবার। আমরা মজা করতে থাকি সেই জগতে। যে জগতে দুঃখ বলে কিছু নেই। চিরকাল সেই জগতে মজা করতে থাকবো আমরা। আমরা তিনজন।
-----------------------------------
আল-রাব্বী : লন্ডন গ্রেস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা-এর অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। গল্পটি ২০১৪ সালের জুন মাসে লিখিত।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা