X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

আমিনুল ইসলামের কবিতার ভাষা

আবু আফজাল সালেহ
২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:১৭আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:১৭

প্রথাগত তালিকার বাইরে এসে যে-কজন কবি কবিতানির্মাণ করছেন, অন্যতম হচ্ছেন কবি আমিনুল হক (জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৬৩)। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দাপাড়ে শৈশব ব্যয় করা এ কবির কবিতায় ব্যাপক বিষয়-বৈচিত্র্য দেখা যায়। কবিতাশৈলিতে নিয়ে এসেছেন আমূল-পরিবর্তন। শব্দ ও চিত্রকল্প বাছাই/প্রয়োগে দাপ্তরিক ভাষা এবং পারিভাষিক/ইংরেজি ভাষার জুতসই ব্যবহার কবিতার শিল্পমান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতা আপনা-আপনিই বেড়ে উঠেছে। অবলীলায় কবিতায় ঢুকে পড়েছে আশপাশের শব্দাবলি-ইংরেজিই হোক বা দেশি শব্দই হোক। এত পরিমাণের এবং এতটা জুতসইভাবে ইংরেজি শব্দের ব্যহবার আমিনুলের পূর্বে কোনও কবি ব্যবহার করেননি । তিনি বাংলা কবিতায় সাধারণত ব্যহৃত হয় না, এমন প্রচুর দাপ্তরিক পরিভাষাও অত্যন্ত সফলভাবে তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া তার ব্যবহৃত উপমা এবং চিত্রকল্প দুইই অভিনবত্বের অনন্যতায় সমৃদ্ধ। অন্যদিকে তিনি তার কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য তার সময়ের যেকোনো কবির চেয়ে বেশি। প্রাতিস্বিক সৃষ্টিশৈলি কাজে লাগিয়ে সৃষ্ট প্রাণময়তা ও অনিঃশেষ আবেদন তার কবিতার মূল শক্তি। তিনি শৈল্পিক সম্মোহন অটুট রেখে পাঁচশতাধিক পঙক্তিবিশিষ্ট দীর্ঘ কবিতা (অন্ধরাতের এক্স-রে রিপোর্ট) লিখতে পারেন; আবার একদুই চরণেও রচতে পারেন গভীর ব্যঞ্জনার কবিতা। তিনি বলতে পারেন, ‘মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে।’ (জঙ্গলায়ন)। ‘জঙ্গলায়ন’ শব্দটি তার নিজের সৃষ্টি। তিনি লিখতে পারেন একচরণের গভীর কবিতা : ‘আকবরের তখ্তে বসে শান দেয় বিভেদের দাঁত।’ (বিশ্বরোগ) বিশ্বব্যাপী হানাহানি, দাঙ্গাহাঙ্গামা, যুদ্ধ, রেষারেষি , ক্রোন্দল, লুণ্ঠন, উপনিবেশবাদ ইত্যাদি পেছনের বিষয়টি তিনি ‘বিশ্বরোগ’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তার কারণ নির্ণয় করত উপস্থাপন করেছেন একটি মাত্র চরণের কবিতায় যা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়। যেকোনো অর্থে এবং সকল অর্থেই আমিনুল ইসলাম মননে ও মেজাজে একজন স্বতন্ত্রধারার শক্তিমান কবি।

রবার্ট ফ্রস্টের মতে, কবিতা আনন্দ দিয়ে শুরু হয়; শেষ হয় প্রজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে। Meditation before writing a poem- আমিনুলের কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা পড়লে পাঠক আনন্দ পাবেন এবং একইসঙ্গে প্রজ্ঞাবান হতে পারবেন। কবিতার আধুনিক নামকরণ, দাপ্তরিক/ ডিজিটাল কাব্যস্বর নির্মাণ, বিষয়ের বৈচিত্র্যময়তা ও চিরন্তনতা, সমসাময়িক ভাবনা এবং বিশ্বসাহিত্যের কবিদের সঙ্গে চিন্তার সেতুবন্ধন কবিকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ‘কুয়াশাপ্রিন্ট’, ‘বিকিনি রাত এবং ফুটো কনডম’, ‘বহুমূত্র বর্তমান ভেঙে পড়া ভবিষ্যৎ’, ‘আমার শরৎ দিন বিলি কাটে আকাশের চুলে’, ‘পাখির টক শো’, ‘ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র’, ‘দ্বন্দ্ব সমাস’ প্রভৃতি কবিতার শিরোনাম দেখেই অন্যরকম অনুভূতি চলে আসে। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক জীবন-ভাবনা ও চিন্তায় জারিত আমিনুল ইসলাম রোম্যান্টিক মনের এক চির আধুনিক কবি। ভালোবাসার নতুনত্ব, এমন কিছু কবিতার শিরোনাম : ‘ভালোবাসার ইন্টারনাল অডিট রিপোর্ট’, ‘ভালোবাসা ঘুমিয়েছে—জেগে আছি আমি’, ‘চুমু’, ‘ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে’, ‘বকুল আমার বান্ধবীর নাম’, ‘ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া’, ‘অনুর্বর সময়ের চুমু’, ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’, ‘তোমার ভালোবাসা অথবা ধান্ধাবাজির পিএইচডি’, ‘দিঘি-দিঘি মন নদী-নদী ভালোবাসা’, ‘তোমার হোমিওপ্যাথ কাব্যতত্ত’¡, ‘হে মেয়ে, ভালোবাসাও একটা কাজ’। আমিনুলের কবিতায় নদীও নারীর মতো কথা কয়। নদী তার কাছে মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো। ‘অতএব এসো, আমরা দুজনে মিলে/একটা পাহাড় এবং একটি নদী কিনে ফেলি;/তখন সমুদ্রটা ফ্রি পেয়ে যাব (আমরা দুজনকে ভালোবাসব, কেন?)’—এখানে পাশ্চাত্যধারার কবিতার মতো তেজস্বিতার সন্ধান পাই। কবি আমিনুলের এমন অনেক কবিতা রয়েছে যা ইউরোপীয় স্টাইল ও আভিজাত্য ধরা দিয়েছে। মহানন্দা নদীর তীরে কবির শৈশব কেটেছে। মহানন্দা ও নদীর প্রসঙ্গ এসেছে অনেক কবিতায়। শেলির ইটালিয়ান চিত্রকল্প যেন আমিনুলের নদী, প্রতিবেশ। শেলির ইতালিয়ান চিত্রকল্প আর আমিনুলের নদীবিষয়ক ও ভূগোলের চিত্রকল্প যে একই সূত্রে নির্মিত-মিলেমিশে যেন একাকার।

Re-creative power রয়েছে আমিনুলের কবিতায়। Adjective বা বিশেষণ হচ্ছে কবিতার সর্বোচ্চ বন্ধু। আমিনুলের কবিতায় বিশেষণ ব্যবহারে বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব দেখা যায়। পুরাতন চিত্রকল্প পাঠককে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করে তোলে। সেজন্যই নতুন নতুন চিত্রকল্প নির্মাণ ও অলংকারে নতুনত্ব আনা সত্যিকারের কবিত্ব। পাঠক খোঁজে নতুন নতুন ইমেজ। আর আমিনুলের কবিতায় নতুন নতুন ইমেজ, চিত্রকল্প লক্ষ করা যায় ব্যাপক মাত্রায়, যা তার কবিসত্তার অন্যতম গুণ। তিনি লেখার মাধ্যমে নিজস্ব একটি কাব্যস্বর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। দৈনন্দিন শব্দের পাশাপাশি দাপ্তরিক কিছু শব্দ যোগ হয়েছে তার কবিতায়। নদী ও প্রকৃতি নিয়ে নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগ করেছেন। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আমিনুলের কবিতায় বেশকিছু পারিভাষিক শব্দের সফল প্রয়োগ দেখা যায়। অনেক পরিভাষার আমরা কিন্তু উপযুক্ত বাঙলায়ন করতে পারেনি। বা বাংলায় আমরা সহজে বুঝতে পারি না। অথচ অনেক পরিভাষা বা ইংরেজি শব্দ পাঠকের নিকট চিত্রকল্পের কাজ করে, বক্তব্যকে ষ্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করে। মাল্টি-মিডিয়ার সাফল্যে, হৃদয়ের হার্ড ডিস্কে, ডায়াগনসিস, ব্রেকিং নিউজ, ডিলিট বাটন ফেইল, স্কিনটাইট ব্লাউজ, অলটারনেটিভ হাইপোথিসিস, হোমোসেক্সুয়াল দিন, ইন্টারনাল অডিট, গুড মর্নিং মাই ডিয়ার, ওয়ানটাইম হাওয়া, ডায়মন্ড পায়ের কাছে পড়ে থাকে, ব্যাকগ্রাউন্ড কালারে মিশে থাকে, ডিপ্লোমেটিক ইলনেস, অর্থমন্ত্রকের আপত্তি, এনসিটিবির শিশুক্লাসের সিলেবাস, যৌথ ফান্ড, যাত্রীদের টিকিটে টাইম নেই নেই অ্যারাইভালের, রানিং ট্র্যাক থেকে, থার্ড আম্পয়ারের চোখে ইত্যাদি দাপ্তরিক ও পারিভাষিক শব্দ অনায়াসে ব্যবহার করেছেন তিনি। এসব বহুল প্রচলিত ইংরেজি শব্দ কবিতায় অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। ভাষাশৈলি ও শব্দগতসমষ্টি, বাগবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নির্মাণ করতে যেয়ে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি (কিন্তু বহু প্রচলিত) শব্দের ব্যবহার করেছেন। অন্য বিদেশি-শব্দও ব্যবহার করেছেন। বলা যায়, কবিতাকে সাবলীল ও পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে প্রথা ভেঙে ইচ্ছেমতো শব্দ বসিয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে নতুন, পুরোনো, দাপ্তরিক ও প্রযুক্তিগত শব্দের ব্যবহারে এবং অভিনব চিত্রকল্প সহযোগে উৎকৃষ্ট মানের কবিতা রচনায় তার পারঙ্গমতার ব্যাপারটি :

ফ্যাক্সে হৃদয় ঢালতে গেলে ঘাঁটবে অপারেটর

যদিও নাঙ্গা যুগের উরুর মনটা কপটচারীর

ডাকপিওনের বেতন জোটে, আমার নিরুত্তর

তোমার হাতে কলমটা কি ফিন্যান্স সেক্রেটারির?

(হায় বসন্ত)

অথবা

আমার ভালোবাসা রেখে দাও জোয়ানা—রেখে দাও রিজার্ভ ফান্ডে তোমার

যেভাবে সোনাব্যাং লুকিয়ে রাখে কুড়িয়ে পাওয়া আধুলি তার

যেভাবে গোপন ফাইল লুকিয়ে রাখে পাসওয়ার্ডযুক্ত হার্ডডিস্ক

যেভাবে কবি রেখে দেয় প্রিয়তম অধরের পাশে একখানা একাদশীর চাঁদ!

(আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট)

উৎকৃষ্ট কবিতার গুণ হচ্ছে, পাঠকের মনে ধরা। আর শব্দের কারিকুরি কবির সঙ্গে কবিতাকে অনন্য করেছে। চোখ বা দেখার সৌন্দর্য মনের মধ্যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে এবং তার সফল উপস্থাপনে নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে যেয়ে কবি আমিনুল শব্দের কারিকুরিতায় দর্শন, শ্রবণ, স্বাদ, স্পর্শ প্রভৃতিকে বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। ‘মাই লর্ড, ইয়োর অনার,/... ব্যর্থতা কি শুধুই আমার!/ পায়ের কাছে বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত রিজার্ভ /কিন্তু আকাশ কি পারে/শ্রাবণের ঝারি দিয়ে—/মুক্ত করতে শীতলক্ষ্যাকে দূষণের গ্রাস থেকে? (ব্যর্থতার প্রেসনোট)’। The power of feelings আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রগাঢ় হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অলংকার, বাগশৈলি ইত্যাদিতে thought of poetry ধরা দিয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বীয়জ্ঞানের সমন্বয় দেখা যায় আমিনুল ইসলামের কবিতায়। কবিতায় বহুমুখী প্রবণতা পাঠককে আকর্ষিত করে রাখতে সক্ষম। পারস্পারিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, মোড়লিপনায় অসাধু উদ্দেশ্য, প্রায় উদ্দেশ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা স্বার্থপরতা ইত্যাদি বিষয়ের নান্দনিক ছবি দেখতে পাওয়া যায় তার কবিতায়। তার কবিতায় এ গুণের কারণেই পাঠকের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছেন তিনি। কারণ এসব দ্বৈততা তো আমাদেরই। সর্বত্রই এমন অবস্থা বিরাজমান। পাঠকের মনের পিপাসা ও আকর্ষণ ধরে রাখার ঐশ্বর্য রয়েছে তার কবিতায়; এ ক্ষমতা কবি হিসেবে তাকে টিকিয়ে রাখবে বলে মনে করি। একটি কবিতার অংশবিশেষ তুলে ধরা যাক—‘আমাকে গ্রহণ করো সানজিদা, আমাকে গ্রহণ করো/আমি মধ্যপ্রাচ্যে সিএনেন বা ফক্স নিউজের/রিপোর্টার ছিলাম না কোনোদিন.../ আমাকে বিশ্বাস করো (আমাকে গ্রহণ করো)’।

সাংকেতিক বা প্রতীকী কবিতার ক্ষেত্রেও কবি আমিনুল ইসলাম সমান দক্ষ ও সজাগ। নানা অনিয়ম ও অন্যায়ের প্রতিবাদে বিভিন্ন প্রতীকী অথচ ঝাঁঝালো কবিতা লিখেছেন। তার প্রতীকী প্রতিবাদেও কবিতার মূল অস্ত্র সূক্ষ্ম পরিহাস বা স্যাটায়ার। তার এমন কবিতার সংখ্যাও প্রচুর। প্রেম থেকে বিচ্ছেদ, দেশ থেকে বিদেশ, দপ্তর থেকে জাতিসংঘ এবং গ্রাম থেকে শহর ইত্যাদি কবির প্রতীকী, কখনও-বা সরাসরি কাব্যিক চাবুকের নিচে এনেছেন। জবাবদিহিতা চেয়েছেন কখনও কখনও। কয়েকটি উদাহরণ—‘প্রেয়সীঠোঁটের লালে মোড়লেরা জুড়ে দেয় শর্ত/কুটির প্রাঙ্গণে দীপ নিবু নিবু আক্রান্ত্র সঞ্চয়/মৌরসি সিন্দুক ঘিরে চোরাদ্বন্দ্ব সিঁদকাটা গর্ত/বর্গীর রেকর্ড মোছে বিশ্বব্যাংক ধূর্ত হাতে জলে ও ডাঙায় (অক্ষম উচ্চারণ)’, ‘দুর্বলের ঘাড়ে পা রেখে/দাঁড়িয়ে আছে তন্ত্র;/ তার দুটি হাত—অয়লি অ্যান্ড ইনভিজিবল/একটি হাত ছুঁয়ে আছে দেবতার/অন্যটি দৈত্যের (প্রদীপের নিচে : একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট)’, ‘পড়ে আছে খোসা—উড়ে গেছে দিন/একদিন খোসাগুলোরও দিন ছিল/বিক্রেতা-বালকের হাত ঘুরে/চলে গেছে অবসর-প্ররোচিত ভাগাড়ে (চীনাবাদামের খোসা)’,

‘ঘুমিয়েছে গণতন্ত্র আফ্রো-এশিয়ায়

হরিণশিশুর মতো কোমল শরীর

তাই দেখে লোভ জাগে জলে ও ডাঙায়

থাবা আর দাঁত নিয়ে সমান অধীর।’

(আঁধারের জানালায়)’।

তার বন্যা-বন্যা কণ্ঠ আমার স্যামসাং সেলফোনে, কবিতা লিখে লিখে সে হয়ে উঠেছে আধখানা সিলভিয়া প্লাথ, জেনিফার লোপেজের মিনিস্কার্ট, মৌরসি রক্তের মতো, ইত্যাদির মতো নান্দনিক শব্দ ও অলংকার আমিনুলের কবিতায় কোমলতা ও মাধুর্যতার পাশাপাশি পাঠককে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম। কথ্যভাষার প্রয়োগ দেখা যায় আমিনুলের কবিতায়। জন্মভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক কথা এসেছে বেশকিছু কবিতায়। ‘আশিয়া দাদির আর্তনাদ; ‘তোমরা হামার নেফুলকে আইন্যা দাও;/ হামাকে ফেইল্যা তুমি কুণ্ঠে গেইল্যা নেফুলের বাপ...’।’’ আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, শিল্পের শর্ত পূরণ করেও আমিনুল ইসলাম মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি গভীরভাবে দায়বদ্ধ এক কবি। কবিতা তার ভালোবাসার ভাষা, কবিতা তার প্রতিবাদের অস্ত্রও। ‘আমার হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই, জেনোসাইডে আক্রান্ত্র/মানুষের পক্ষে আমি এক কবি (নাফ নদীর তীরে)’—কবিতার মূলভাবনাটাই আমিনুল ইসলামের সত্তা।

আমিনুল ইসলামের লিরিকধর্মী ও ভূগোলধর্মী কবিতাগুলোও চমৎকার। যেমন : ‘আমাকে মনে রাখবে/গরিবের বউয়ের মতো এক ভূগোল’, ‘বাঁশি বাজে সর্বনাশের বাঁশি বাজে ভাঙার/বাঁশি বাজে আক্রমণের বাঁশি বাজে হানার (বাঁশি)’, ‘আয়না থেকে চোখ সরিয়ে আমার চোখে রাখো/ আমার চোখের দৃষ্টিটুকু তোমার চোখে মাখো (ড্রেসিং টেবিল)’ ইত্যাদি। আমিনুল ইসলাম ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃতিসন্ধানী কবি। তার এ সন্ধান শেকড়মুখিনতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও শেকড়মুখিনতা লক্ষ করা যায়। ঐতিহ্যের পাশাপাশি ইতিহাস ও প্রযুক্তিগত শব্দাবলির ব্যবহার গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়েছে। কবিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক শব্দাবলি/টার্ম অনায়াসে ঢুকে পড়েছে তার অনেক কবিতায়। আধুনিক ও প্রযুক্তিবিদ্যার তার এমন কবিতা পড়লে পাঠকরা আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অনেক অজানা খবর পেয়ে যাবেন। আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিশেষণের বৈচিত্র্যময়তা এবং জুতসই ব্যবহার কবিতাশৈলিকে নতুনমাত্রায় নিয়ে গেছে। একজন বড় কবির কাব্যকর্মের উৎকর্ষ নির্ভর করে বিষয়-বাছাই, নান্দনিক উপাদান (শব্দ, অলংকার ইত্যাদি) ইত্যাদির প্রয়োগ।

আমিনুল ইসলামের কাব্যসম্ভার বিশাল ও ব্যাপক। তার কবিতা নিয়ে ইতোমধ্যে ডজন প্রবন্ধ এবং একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তিনি সকল ছন্দেই অনায়াসে কবিতা লিখতে পারেন এবং লিখেছেন । ধ্যান ও বোধির, গাঢ় চিন্তার মিশেল দেখা যায় তার কবিতায়। দাপ্তরিক শব্দের ব্যবহারে নতুনত্ব এবং একইসঙ্গে কবিতায় গতি এসেছে। ভাষা ও বিষয়ের দক্ষ নির্বাচনে পাঠককে সম্মোহিত করতে পারাই এই কবির সবচেয়ে বড় শক্তি। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে চমৎকার অন্বয় করাতে পেরেছেন। তিনি গতানুগতিক বা প্রচলিত ধারার বাইরে এসে অভিনব ও অনন্যসুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। এসব কারণে আমিনুল ইসলামের কবিতাকে সহজেই আলাদা করা করা যায়। প্রেম, বেদনা, অস্থির বিশ্ব, অনির্বচনীয় অনুভব সবকিছু ছাপিয়ে তিনি শিল্পবোদ্ধা ও নিবিড়ভাবে সংবেদনশীল মানুষের কবি । তিনি কবিতায় কথা বলেন অভিনব অথচ উপভোগ্য নান্দনিক ভাষায় যা প্রকাশের পাশাপাশি ধরে রাখে আবিস্কৃতব্য সৌন্দর্যের আড়াল। একজন বড় কবির প্রায় সকল গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান। আমরা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, আমিনুল ইসলাম একজন মৌলিক কবি।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
হিজরি সনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক গভীর যে কারণে
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
চকরিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
১৩ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি: অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে মরিয়া সহকর্মীরা
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৪ জুলাই ২০২৪
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ মাকে পিটিয়ে হত্যা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি