X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

জেমস জয়েসের ডাবলিন, একটি খুদে পৃথিবী

সারা ব্যেক্টার
২২ মার্চ ২০১৯, ০৬:০০আপডেট : ২২ মার্চ ২০১৯, ১১:৪০

জেমস জয়েসের ডাবলিন, একটি খুদে পৃথিবী উষ্ণ মদের দোকানটি বিয়ারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। মদের গ্লাসে চুমুকের পর চুমুক। বিয়ারের ফেনা গ্লাসের গায়ে অন্যএক নকশা তৈরি করেছে—মনে হচ্ছে, আঠালো আর চটচটে। রেড ওয়াইনের মতো লাল ঠোঁট, সুখের নিঃশ্বাস, কামানের শব্দের মতো অট্টহাসি, চারিদিকে কাঠের পাটাতন দিয়ে ঘেরা, আয়নার দেওয়াল আর হুইস্কির সারি। কিছুই না আবার অনেক কিছুই। এখানে ধর্মতত্ত্ব থেকে যৌনতা, সাহিত্য এবং মৃত্যু, সাবান ও সসেজ সবই আলোচিত হয় বা অলীক স্বপ্নের একটি খাসা চীজ-স্যান্ডউইচের মতো যেন চোখের সামনে ঘুরপাক খায়। একটি সাধারণ পুরাতন দিন, তবুও জীবনের প্রতিটি উপাদান যা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও অপরিহার্য; সব সময় সেসব নিয়ে মেতে থাকা যায় এখানে।

এরকমই জেমস জয়েসের ইউলিসিস—যা বিবেচিত হয় অন্যরকম গুরুত্বের সাথে। পাঠককে জাগিয়ে তোলার মতো একটি অতুলনীয় ইংরেজি বই, যা একই সঙ্গে অপঠিতও; সাধারণ বিষয়গুলো যেখানে অসাধারণরূপে প্রতিভাত হয়েছে। হোমারের অডিসির যেন এক আধুনিক পুনঃনির্মাণ। কিন্তু এর প্রাচীন গ্রিক কবিতা, ওডিসিয়াসের বহুবর্ণিল ঘটনা আর ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার বর্ণনাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয় জেমস জয়েসের মহাকাব্য যেন তুলনাহীনভাবে একটিই।

ইউলিসিস-এর নায়ক লিওপোল্ড ব্লুম। যাকে দেখানো হয় ইহুদিদের দ্য ফ্রিমান জার্নালের বিজ্ঞাপনের ক্যানভাসার হিসেবে, ১৯০৪ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখ থেকে যিনি ডাবলিনে চরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রীর কাছে না শোয়ার জন্য সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যায়, বারে গিয়ে মদ খায়, জাদুঘরে হাঁসের মতো ঘুরে বেড়ায়, স্যান্ডিমাউন্টের তীরভূমে আনন্দে থাকার জন্য পরিশ্রম করে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।

উপন্যাসটি যেন বিশৃঙ্খল চেতনার এক নান্দনিক প্রবাহ, শৈলীর দিক থেকে চমকপ্রদ, ব্লমকে উপস্থাপন করে মানুষের অফুরন্ত ক্ষমতাকে তুলে ধরে। তবে এ সমস্ত কিছুই ঘটেছে ডাবলিনের রাস্তায়, ডাবলিনের মাটিতেই—প্যারিসে জয়েসের স্ব-নির্বাসনে থেকে লেখা, হাজারো শ্রমের মাধ্যমে শহরটিকে অন্বেষণ করার মতো। যদিও পরবর্তীকালে প্যারিসের দিকে তিনি কদাচিৎ মুখ ফিরিয়েছেন এবং তার সিদ্ধান্তে অটল হয়েছেন এইভাবে—‘যখন আমি মারা যাবো, এই ডাবলিন আমার হৃদয়ে লেখা থাকবে’।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ডাবলিনের অনেক পরিবর্তন হয়। নতুন নতুন আন্দোলনের ফলে শহরের কেন্দ্র অন্যদিকে সরে আসে। ডাবলিনে অনেক আগে থেকেই ইউরোপের বেশ কিছু কদাকার বস্তি ছিলো, যেখানে প্রায় চার জনের মধ্যে একজন শিশু জন্মের আগেই মারা যেত। কেল্টিক রেনেসাঁর মাধ্যমে এই বস্তি থেকে উঠে আসা মানুষেরা যেমন জীবনকে নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছে তেমনি আইরিশ ভাষা এবং সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী দারুণ প্রচার পেয়েছে, যদিও তখন আইরিশ সংসদীয় পার্টি স্বাধীনতার থেকেও দেশের সংবিধান এবং নিয়মনীতিকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল। তবে পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আয়ারল্যান্ড প্রতিষ্ঠার ভিত্তিগত আন্দোলন ভালোভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। পূর্ণতা পায় ১৯১৬ সালে এস্টার রাইজিং সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ইউলিসিস ১৯২২ সালে প্রকাশিত হলেও আয়ারল্যান্ডের এইসব সংকট শুধু নয়, ধারণ করেছে বহু বছরের পুরাতন ক্ষত। জয়েস নিজেও উদ্বিগ্ন ছিলেন, জাতির সংগ্রামের পথ ধরে নয় বরং প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানুষের চেহারায় আসন গেড়ে বসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধের ছাপ নিয়ে—যেন ডাবলিন হয়ে উঠেছে পুরো পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।

 আয়ারল্যান্ডের ভূগোল সম্পর্কে জয়েসের ধারণা এতটাই স্পষ্ট যে ব্লুম’এর প্রতিটি পদচিহ্ন প্রবলভাবে বাস্তব করে তুলতে পেরেছে। এসব কিছু শুরু হয় সাত নম্বর একলেস স্ট্রিটে ব্লুমের বাসা থেকে, যেখানে প্রতিনিয়ত সে তার হৃদয়কে মচমচে করে ভেজে ফেলে আর নারীদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হয়রান হয়। বর্তমান নর্থ জর্জ স্ট্রিটের এই বাসাটা ১৯৬০ সালে ভেঙে পড়ে। পরে সেটাকে পুনঃনির্মাণ করা হয়। এখন এই বাড়িটির নামফলকের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে, ‘জেমস জয়েস সেন্টার’।

ও'কোনেল রাস্তাটি শহরের এক কোনায় অবস্থিত যেটি জর্জিয়ার ঐতিহ্য বহন করে। যদিও ১৯০০ সালের পর থেকে এটি আরো মলিন হয়ে পড়ে এবং এস্টার রাইজিং বিদ্রোহের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে এই রাস্তায় আর ঘোড়া আঁকা ক্যাব এবং ট্রাম আগের দিনের মতো চলাচল করতে দেখা যায় না। তবু আজকের দিনে আমরা তাকে মনে করছি তার নান্দনিক স্থ্যাপত্যশৈলীর কারণে। ব্লুমের পদচারণা সেখানেও ছিলো। তবে ব্লুম জয়েসকে অতিক্রম করতে পারেনি—তাই বলে কিন্তু সে দানবীয় লিপিতে লেখা লিফি নদী জুড়ে বিস্তৃত আইরিশ নেতা ও'কোনেলের স্মৃতিস্তম্ভের বাণীটি নোট করতে ভোলেনি।

ব্লুম ব্যানবেরি কেকগুলি খাওয়ার সময় হুইস্কির গ্লাসও কিনে নিতো এবং হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছ যেতো ও'কোনেল ব্রিজের কাছে। সে ব্রিজটির ঠিক মাঝখানে দাঁড়াত, যে স্থানটিকে সবাই উত্তর ডাবলিন এবং সমৃদ্ধ দক্ষিণের মধ্যে বিভাজক হিসেবে আক্ষা দিয়ে থাকে। এভাবে ঘটনার প্রবাহে ব্লুমের সাথে আপনিও ঘুরে বেড়াতে থাকবেন ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড (বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবন), ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ ত্রিনিটি কলেজ (যেখানে ক্যাথোলিক হওয়ার কারণে জয়েস কখনো যাননি) কিংবা জাতীয় লাইব্রেরির আঙিনা ধরে। আপনি ভ্রমণ করতে থাকবেন সংকীর্ণ দোকানগুলোর সামনের রাস্তা ধরে, রেখাযুক্ত গ্রাফটন স্ট্রিটের পাশ দিয়ে। যেখানে স্থানীয় এবং বাইরের লোকেরা পুরো ডাবলিনকে সারাংশরূপে খুঁজে পেতে আসে।

এরপর কখনো কখনো ডুক স্ট্রিটে গিয়ে ক্ষুধার্ত ব্লুমকে পাবেন। খাদ্য হিসেবে তার প্রথম পছন্দ, এই স্ট্রিটে অবস্থিত ‘দ্য বুর্টন’-এর ঝাঁঝালো মাংস এবং সবুজ-শাকসব্জি। এখানে সে পেয়ে যায় ডেভি বায়ার্স নামের মদের দোকানটি, যেটি নেশাখোরদের কাছে বিপুল ঐতিহ্য বহন করে। এই দোকানটি খোলে ১৮৮৯ সালে। যেখানে এখনো গর্জেঞ্জোলা স্যান্ডউইচ এবং বার্গান্ডির গ্লাস জেমস জয়েসের এই অদ্ভুত চমৎকার উপন্যাসটির বাস্তব স্বাদ বহন করে চলেছে।

বাঙলায়ন: ইরা সামন্ত

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীসা কারখানায় অভিযান, তিন চীনা নাগরিকসহ ৬ জনকে কারাদণ্ড
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা