X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

শূন্য প্রান্তরে একা

সেবন্তী ঘোষ
২২ এপ্রিল ২০২১, ২১:৪০আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১৮:৫৫

নিরপেক্ষভাবে কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে লেখা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কবিতার জগতের বাইরে ওঁর কাছে আরো কিছু মানুষের মতো আমারও একটি আশ্রয় ছিল। এই আশ্রয় ইহজীবনে কোথাও পাব বলে মনে হয় না।

একটা সময় আসে যখন আয়ু ফুরিয়ে আসা বটগাছের তলা থেকে শূন্য প্রান্তরে একা নেমে যেতে হয়। আমি এখন সেই খাঁখাঁ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি।

অনেকেই ওঁকে জাতির বিবেক বলেন, কথাটা সর্বাংশে সত্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইকে আমার দেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শঙ্খ ঘোষকে দেখেছি বলে সে খেদ আমার নেই।

নিজের শর্তে বাঁচা, একবগ্গা, এমন আপোষহীন মানুষ কোটিতে জন্মায় একজন।

নির্লোভ তাঁকে বলব না। তাঁর লোভ ছিল বন্ধু, কবি-লেখক, ছাত্র-ছাত্রী, সমমনস্ক মানুষের সঙ্গ লাভের। করোনাকালের আগেই বেশ কিছুদিন ধরে বারবার অসুস্থ হচ্ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল। স্বভাবতই তাঁর কাছের মানুষরা বাড়িতে যাওয়া-আসা নিয়ন্ত্রিত করেছিল। রবিবারে তাঁর বাড়িতে যে আড্ডা হতো, সেখানে প্রবাদপ্রতিম মানুষেরা আসতেন। ওই আড্ডার সময় প্রায়শই কারুর ঘড়ির কথা মনে থাকত না। পরিবার, পরিজন একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছিল। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হতেন তাতে। এমনকি এই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, প্রায় এক বছর বাদে যখন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, স্বাভাবিক কারণেই ফাঁকা বাড়ি। ইতস্তত করে বললাম, রবিবারে এরকম ফাঁকা তো এই প্রথম দেখলাম! কথা প্রায় বলতেই পারছিলেন না। পারকিনসনের কারণে হাঁটার অসুবিধে। এক সহায়কের সাহায্যে কথাগুলি বুঝতে হচ্ছিল। বললেন, এখন কেউ আসে না। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে সম্পূর্ণ সতর্কতা মেনে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। যদিও দ্বিধা ছিল বিস্তর। এমন অবস্থাতেও স্যারের গলায় ছিল বন্ধুদের দেখা করতে না পারার অভিমান বোধ। ওঁর উপকারের জন্যই যে তারা আসছেন না এটা যেন বুঝতে চাইতেন না। সোজা কথায় লোকে এসে তাঁকে বিরক্ত করুক এটাই বোধহয় চাইতেন! রসিকতাবোধও শেষদিন পর্যন্ত ছিল তেমনই প্রখর। সেদিন স্যারের পাশে স্ত্রী প্রতিমাদি এসে বসেছেন। প্রতিমাদির কানে শুনতে সমস্যা হয়। স্যারের কথা বলার সমস্যা। [বেশ জোরে কথা বলছি। স্যার খানিকক্ষণ চেষ্টার পর বললেন, ‘ও বলতো, ওঁর সঙ্গে বেশি কথা বলি না। এখন আমি কথা বললেও ও শুনতে পায় না!’

নিজের প্রবল শারীরিক সমস্যা নিয়ে এভাবে সহজভাবে স্যার ছাড়া কেই-বা বলতে পারেন?

অন্যান্য সময় ছাড়াও ওঁর বাড়িতে মাসে অন্তত তিনদিন রবিবারের আড্ডায় চুরানব্বই সাল থেকে দুহাজার তিন অবধি টানা থেকেছি। ছেলের জন্মের পর স্বভাবত আমার নিয়মিত যাওয়া কমলো। দুহাজার সাতে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ফিরে আসার পর যখনই কলকাতা যেতাম পারলে রবিবার দিনটা সকালে ওঁর বাড়িতে আড্ডা দিয়ে সরাসরি দমদমে গিয়ে শিলিগুড়ির ফ্লাইট ধরতাম।

রবিবারের আড্ডাতেই সনজিদা খাতুনের গান এল, পি রেকর্ডের বাইরে প্রথম শোনা। ছায়ানটের অনেক গল্পই ওঁর মুখে শোনা। খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন ওদের সঙ্গে।

বাংলাদেশ বিষয়ে মুগ্ধতা ও আশা ছিল প্রবল। পঁচানব্বই সালে প্রথমবার ঢাকায় এসে হতাশ হয়েছিলাম। ভিড়, অব্যবস্থা, কুখ্যাত জ্যাম, আতিথেয়তার আতিশয্যে ব্যক্তিগত পরিসরের দফারফা—সদ্য শান্তিনিকেতন থেকে বেরোনো এলিট চেতনার উন্নাসিকতায় ধাক্কা দিয়েছিল।

স্যার আমার প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম।

ভ্রু কুঁচকে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, সে কি, এমন আতিথেয়তা তোমার খারাপ লাগল? তারপর একটু থেমে বললেন, পরের বার ঘুরে এসে বোলো, কেমন লাগল।

অন্তর্যামীর মতো বুঝেছিলেন, ভবিষ্যতে রক্ত সম্পর্কে আত্মীয় না থাকা বাংলাদেশে আমি কিভাবে বন্ধুত্বের মায়াজালে চিরকালের মতো জড়িয়ে পড়ব।

সাহিত্য পত্রিকা লোকের আঙিনায় কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে আড্ডা বাংলাদেশ বিষয়ে ওঁর দুর্বলতা শৈশবের বরিশাল বা পাকশীর স্মৃতির কারণে মাত্র নয়, বাংলাভাষী নবগঠিত রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ কর্মযজ্ঞে আশা ভরসা আস্থা ও কৌতূহল ছিল ওঁর। বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য পছন্দ করতেন না। মনে পড়ছে দুবারের দুটি ঘটনা। আমি সেসময় ঢাকায়। স্যার সপরিবারে এসেছেন পারিবারিক স্থপতি বন্ধু নাহাজ দা, রূপাদির বাড়িতে।

বন্ধু শামীম রেজা ও শামীমুল হক শামীম বলল, ওঁকে যদি একবার আজিজ সুপার মার্কেটে 'লোক' পত্রিকা দপ্তরে আনা যায়। ওদের নিয়ে চললাম নাহাজদার বাড়িতে। কবি বন্ধু জাহানারা পারভীনও সঙ্গে ছিল। স্যার সহজে কোথাও কবিতা পড়তেন না। অনুষ্ঠানে যেতেন কিন্তু শ্রোতা হিসেবে। স্যারের বাড়িতে বিখ্যাত সাংবাদিক বিক্রমন নায়ার ওঁকে একবার জার্মানি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন।

বললাম, বেশ তো, জান না!

স্যার দ্রুত উত্তর দিলেন, তোমরাই তো বলবে, এখানে কোথাও কবিতা পড়তে যেতে চাই না, সেই আমি জার্মানিতে কবিতা পড়তে চলে গেলাম! আসলে স্যারকে কোথাও নিয়ে যেতে গেলে দুর্দান্ত পরিষেবা দেবার কথা বললে উনি বেঁকে বসতেন। অল্পবয়সীরা কষ্ট করে সামান্য আয়োজন করে ওঁকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, এ কথা শুনলে দুর্বল হয়ে পড়তেন। স্যারকে কোনো কিছুতে রাজি করাবার এটি ছিল বিশেষ কায়দা। আমি ফিরে এসেছিলাম শিলিগুড়িতে। স্যার আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়েছিলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা গরমে ঘামতে ঘামতে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা আলাপ-আলোচনার সেই স্মৃতি এখন গল্প।

পরের ঘটনাটি আরেকবারের। বরিশালে বিরাট দলবল নিয়ে আমরা স্যারের বাড়ি দেখতে গিয়েছি। ওখান থেকে স্যারকে ফোন করছি, আর উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিকনির্দেশ করছেন। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, বরিশালের মানুষ দেখলে স্যারের বাড়িতে একটা মিষ্টি বেশি পাওয়া যায়!

স্যারের বাড়িতে আমি কবি তারিক সুজাতকে নিয়ে গিয়েছি ওঁর ঢাকার উপরে করা অসামান্য সব বই দেখাতে। শ্রদ্ধেয় মুনতাসীর মামুনের সম্পাদনায় সেসব বই দেখে স্যার চমৎকৃত হয়েছিলেন। তারিক উজাড় করে ওঁকে বই উপহার দিয়েছিল। তরুণ লেখক অভিষেক সরকারের উপন্যাস ‘দাস্তান গোই’ পড়ে স্যারকে প্রায় জোর করে পড়িয়েছি। অভিষেককে ডেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। স্যারের বাড়ি থেকে আমরা অনেকেই নানা বই পড়ার জন্য নিয়ে চলে যেতাম। আমরা ছাড়া অনেকেই সেটা করত। কোনো একটা কারণে বই পাওয়া না গেলে আমাদের বাড়িতেই ফোনটা যেত, যখনই উত্তর দিতাম বইটি আমাদের বাড়িতে নেই, সন্তুষ্ট হতেন না, আবারও বলতেন, ভালো করে খুঁজে দেখো তো, পেতে পারো!

এমন ফোন আরো কাউকে কাউকে হয়তো করতেন, সেটা আমার জানা নেই!

স্যার আমাদের বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে সই করতে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন। আমার ছেলের জন্মের সময়ে প্রায় দেড় মাস শিলিগুড়িতে ছিলাম। স্ত্রী প্রতিমাদিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে জুরাকে দেখতে এসেছিলেন। জুরা ছবছর বয়স অব্দি বাংলা পড়তে শেখেনি। জুরার বাবা তাঁর প্রিয় স্যারকে নালিশ করেছিল যথারীতি। উদ্বিগ্ন হয়ে একদিন ফোন করে বললেন জয়দেব বলছে, জুরা এখনো পড়তে শেখেনি, তুমি কি ঠিকভাবে শেখাচ্ছ না?

আমিও রাগ রাগ গলায় উত্তর দিয়েছিলাম, জুরার বাবা আড়াই বছরে পড়তে শিখেছে বলে জুরাও পারবে, এমনটা হয় নাকি?

স্যার এবার হাসলেন।

জয়দেব বসু ও সেবন্তী ঘোষকে উৎসর্গ করা বই

এই শেষ ফেব্রুয়ারি মাসে যখন দেখা করতে গিয়েছি অন্যের মাধ্যমে কথা বলছেন তখনও জানতে চাইছেন জুরা কি কি পড়ছে, কি বলছে ইত্যাদি। ক্লাস টেনে পড়া জুরার কোনো টিউশন টিচার নেই শুনে বললেন, চমৎকার!

একটা সময় বলেছিলাম, আমাদের প্রত্যেকের এত ব্যক্তিগত কথা আপনাকে বলে আপনার সময় নষ্ট করি। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, না না, আমাকে তো শুনতেই হবে। তোমাদের জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হয় বিভিন্ন জায়গায়।

ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এই সেদিন যখন কথা শেষ করে উঠতে যাচ্ছি, কিছুতেই উঠতে দেবেন না, বারবার বসতে বলছেন। হাঁটতে অসুবিধা হয় তবুও স্বভাবমতো দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নামছি। একবার পিছন ফিরে তাকালাম। চির স্নেহময় সেই মুখ। মন বলছে এই দেখাই শেষ দেখা। যে আমার আজকাল কোনো কিছুতেই চোখে জল আসে না, আমি কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে নামছি। কে কোথায় দেখছে কি বা যায় আসছে! বুঝতে পারছি যা হারাচ্ছি তা আর ইহজগতে মিলবে না।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গুলশানে চোর সন্দেহে পেটানোর পর যুবকের মৃত্যু, একজন গ্রেফতার
গুলশানে চোর সন্দেহে পেটানোর পর যুবকের মৃত্যু, একজন গ্রেফতার
সোমবার যুদ্ধবিরতির আলোচনায় মিসর যাচ্ছেন হামাস প্রতিনিধি
সোমবার যুদ্ধবিরতির আলোচনায় মিসর যাচ্ছেন হামাস প্রতিনিধি
যাত্রাবাড়ীতে গরমে মাংস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যাত্রাবাড়ীতে গরমে মাংস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
পাঁচ জেলায় চলছে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট
পাঁচ জেলায় চলছে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে