X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনানন্দ দাশ একটি পথ দুর্ঘটনা বা পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি

গৌতম গুহ রায়
২২ অক্টোবর ২০২১, ০০:১১আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২১, ০০:১১

চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা করে লয়ে যাবে,—সেদিন দু’দণ্ড এই বাংলার তির—
এই নীল বাঙলার তীরে শুয়ে একা একা কী ভাবিব, হায়,—

শরীর খুব অসুস্থ, কদিন ধরেই তেতে ছিলো অভব্য প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ার কারণে। প্রতিদিনের মতই ১৪ অক্টোবর বিকালে তিনি হাঁটতে বের হলেন। একা জীবনানন্দ। যখন বেরুচ্ছিলেন স্ত্রী লাবণ্য তাঁকে বেরুতে নিষেধ করলেন, শরীর অসুস্থ ছিল কয়েকদিন ধরেই। লাবণ্যর নিষেধ না শুনেই জল দিয়ে মাথা ধুয়ে একাই বেড়িয়ে যান। ফেরার সময় বাড়ির কাছের লেক মার্কেট থেকে দুটো ডাব কিনে নেন। 

হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছেন, তিনি আসছিলেন রাসবিহারী এভিনুয়ের দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ ধরে, সংযোগস্থলে এসে ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা অতিক্রম করার জন্য পথে নামলেন। রাস্তার এই অংশটা বেশ চওড়া, ট্রাম যাতায়াতে জন্য রাস্তার মাঝখানে দুটো ট্রামলাইন পাতা। ট্রামলাইনের জমিটা ঘাসে সবুজ। তিনি ফুটপাথ থেকে নেমে মোটর, বাস, ট্যাক্সি প্রভৃতির জন্য পিচরাস্তার অংশ অতিক্রম করে ট্রামলাইনের কাছে এলেন, মনটা কিছুটা চঞ্চল ছিলোই, ভাবলেন ট্রাম আসার আগেই লাইন পার হয়ে যেতে পারবেন, এর আগে তো একটা স্টপেজ আছেই, এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়েই ট্রামলাইন পার হতে লাগলেন।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অন্ধকার অল্প অল্প করে জমছে। ট্রামটা আসছিল, আগের স্টপেজে লোক ওঠা-নামার না থাকায় না থেমে জোড়ের সাথেই চলে এলো, ছুটন্ত ট্রামটি জোড়ের সাথেই এসে ধাক্কা দিলো কবিকে, জীবনানন্দ আর ট্রামলাইন পার হতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে আহত ও অচৈতন্য হয়ে ট্রামলাইনের মাঝের সেই সবুজের ওপর ছিটকে পড়লেন, ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে দেহটা ঢুকে গেল। রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের দক্ষিণে একটা জলখাবারের দোকান ছিল, নাম ছিল ‘জলখাবার’। মালিক চুনীলাল দে পরে সেখানে ‘সেলি কাফে’ নামে রেস্টুরেন্ট খোলেন। জীবনানন্দের দুর্ঘটনার সময় এই চুনীবাবুই শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছুটে গিয়ে অনেক সাহায্যও করেছিলেন। সেই চুনীবাবুর কথায়, ‘একটু পরেই হঠাৎ ট্রামের একটা শব্দ, বালিগঞ্জমুখো একটা ট্রাম কাকে যেন চাপা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই পথচারীদের অনেকেই এসে গেলেন। গিয়ে দেখি একজন লোক অচৈতন্য হয়ে ট্রামের ক্যচারের মধ্যে পড়ে আছেন। ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। ট্রামের ড্রাইভার দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড়ের মাঝে গাঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে। যাইহোক, আমি তখনি ট্রামের তলায় ঢুকে আস্তে আস্তে তাকে বের করলাম। সমবেত জনতার দু-একজনের কথা কানে আসছিল, ট্রামলাইনের ঘাসের ওপর দিয়ে এই ভদ্রলোক আনমনে আসছিলেন। ট্রাম ড্রাইভার হর্ন দিয়েছিল, দু-একজন চিৎকার করলেও ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে কিছুই তাঁর কানে যায়নি। যখন তাঁকে বের করা হলো, তখন তিনি অজ্ঞান। দু-তিনজনে মিলে জ্ঞানহীন জীবনানন্দকে ট্যক্সিতে তুলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চুনীবাবু তাঁকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রেখে এলেন, সাধারণ রোগীর মতোই পড়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ। পড়ে আত্মীয়স্বজনের অন্যবিভাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর শরীরের অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি আর। ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দের বুকের কয়েকটা পাঁজর, কাঁধের হাড় এবং পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ডা. বিধান রায় তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়ে দেন যে তাঁর আর বাঁচার আশা নেই, যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে রাখবেন। শম্ভুনাথ হাসপাতেলেই যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কবি। ১৪ অক্টোবর রাত ৮টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। গোটা জীবন অশান্তি ও আতৃপ্তির যন্ত্রণার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটল। সবুজ ঘাস তার প্রিয় ছিল, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই।

আশা স্বপ্নের ছাই ভষ্ম

১৯৫১ সালের ২৮শে মে ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে উত্তরবাংলার জলপাইগুড়ি শহরের তরুণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক সুরজিৎ দাশগুপ্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে, ‘একবার ঘুরে আসতে ইচ্ছে করে, সভাসমিতি ইত্যাদি সবকিছুর হাত সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে তোমাদের মতো দু-একজনের সাহায্যে হিমালয়, চা-বাগান ইত্যাদি দেখে আসার লোভ জেগেছে মনে।’ পঞ্চাশোর্ধ কবির আরো অনেক ইচ্ছার মতই এই ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি। উল্লিখিত চিঠির সূত্রেই সুরজিত বাবু তাঁর শহরের কিছু নিসর্গ দৃশ্যের ফোটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেন। ‘নগ্ন নির্জন’ শহরের ছবি। উত্তরে জীবনানন্দ লেখেন ‘এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদী, ঝিল, পাহাড়। বন, আকাশ। কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকট সম্পর্কে আসতে ভালো লাগে আমার। বসে থাকতে পারা যায় যদি এদের মধ্যে, কিংবা হেঁটে বেড়াতে পারা যায় সারা দিন, তা হলেই আমাদের সময় একটা বিশেষ দিক দিয়ে (আমার মনে হয়) সবচেয়ে ভালো কাটে।’ 

নির্জনতা ও বিষণ্নতা আক্রান্ত জীবনানন্দের, প্রকৃতি ও মানবতার ছায়া-আচ্ছন্ন জীবনানন্দের ভালো লাগার ছোট ছোট টুকরোগুলো এমনই ছিল। ঝিলের পাসে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া কবির ভালোবাসার ইচ্ছেগুলোও ছিল ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো; শুভ্র ও খণ্ডখণ্ড, নিঃস্বার্থ ও উচ্চাশামুক্ত। এইসব ভালো লাগার ইচ্ছের অধিকাংশই ইচ্ছেপূরণের আনন্দে উত্তীর্ণ হয়নি, এই অতৃপ্তির যন্ত্রণার দহনেই দগ্ধ হয়েছেন তিনি নীরবে। নির্জন ও স্বতন্ত্র এই কবির গোটা জীবন ধরে রক্তপথ যাত্রা তাঁকে আরো স্বতন্ত্র করে দিয়েছিলো। 

জীবনানন্দের ৫৫ বছরের জীবনে ১৯১৯-এ ‘ব্রহ্মবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত (বৈশাখ ১৩২৬) ‘বর্ষা আবাহন’ কবিতা থেকে শুরু ধরলে কবিজীবন মাত্র ৩৪ বছরের, প্রকৃত বিচারে যদিও কবি জীবনানন্দের আয়ুষ্কাল আরো কম। এই ক্ষণকালের মধ্যেই তাঁর অন্তরের অনেকটা জুড়েই ছিল নতুনের, তারুণ্যের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এই কারণেই যখন প্রান্তবাংলা জলপাইগুড়ির তরুণেরা লিখলেন, ‘আধুনিক সাহিত্য, বিশেষত, আধুনিক বাংলা কবিতার সঙ্গে উত্তরবংগের মানুষদের সম্পর্কে স্থাপনের জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই। আপনার একটা কবিতা চাই।’ জীবনানন্দের পর্যায়ের কবি এর উত্তরে কত অনায়াসে ‘শিরিষের ডালপালা লেগে আছে বিকালের মেঘে’ মফস্বলের নাম না জানা, না দেখা, সাক্ষাৎপরিচয়হীন সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত ছাত্রদের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন। জীবনানন্দকে জলপাইগুড়ি আসার আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো ‘জলার্ক’-এর তরুণদের পক্ষ থেকে। ১৯৫২র ২০ জানুয়ারি জীবনানন্দ সুরজিত দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘জলপাইগুড়ির ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জংগল বেশ দেখবার মতো, ঘুরবার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার খুব ইচ্ছা করে, জল্পাইগুড়ির দিকে একবার যাব ভাবছি।’ কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়। ১৯৫২তে লেখেন ‘আমার এখন জলপাইগুড়ি যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেতে পারলে অবশ্য আনন্দিত হতাম।’ 

অসুস্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত কবি যেন সেসময় তাঁর ভালো লাগার জগৎ থেকে ক্রমশ ছিটকে যাচ্ছেন। এমনকি, কবিতাও লিখতে পারছেন না এই সময়। কবি কায়সুল হককে লেখা এইসময়ের একটি চিঠিতে তিনি একথা লিখেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুন তিনি জানালেন, ‘নানা কারণে মন এত চিন্তিত আছে, শরীরও এত অসুস্থ যে অনেকদিন থেকেই কিছু লিখতে পারছি না।’ আলোচ্য এই চিঠিগুলো জীবনানন্দ লিখেছিলেন ১৯৫১-৫২, যখন তাঁর অন্তরাত্মা চাইছিলো জলপাইগুড়ির মতো কোনো সবুজ নির্জনতা। যখন চারপাশ তাঁর কাছে রূঢ় হয়ে উঠছিল। প্রতিটি ইচ্ছা ও কামনার মৃত্যু পরখ করছেন প্রতিদিন। ১৯৫০-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি খড়্গপুর কলেজ অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজে নামমাত্র মাইনে পেতেন। স্ত্রী লাবণ্য ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে বি. টি. পড়তে শুরু করেছেন এসময়। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ‘এলকাইনা’ রোগে অসুস্থ হয়ে পরেন। ১৯৫১-র জানুয়ারি, স্ত্রীর অসুস্থতার খবরে কলকাতা আসেন কবি। লাবণ্যদেবী সুস্থ হচ্ছেন না দেখে ছুটির সময় বৃদ্ধির আবেদন করেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বরখাস্থ করে দেয়। এসময় সহকর্মী পুলিনবিহারিকে কবি লেখেন, ‘বড়ই বিপদের ভেতর আছি। খড়্গপুর কলেজে থেকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তিনশত টাকা পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করেছিলাম, সে পাওনা আজ পর্যন্ত পাইনি। অন্তত পূর্বের মাইনে না পেলে এই দুর্দিনে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবো না।’

এ সময় চরম বেকারত্বের। তাঁর কাধেই সংসারের ভার। বাড়ি নিয়ে, পরিবার নিয়ে তাঁর শত দুশ্চিন্তা। খড়গপুরের কলেজের সাড়ে পাঁচ মাসের মেয়াদি চাকরি চলে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ বেকারত্ব তাঁকে অসহায় অবস্থা্র মধ্যে ঠেলে দেয়। শুরু হয় আবার চাকরির খোঁজ। ১৯৫৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের জন্য দরখাস্ত করেন কবি। প্রার্থী হন চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার জন্য। এসব ছেড়ে একসময় ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিতিবিরক্ত, হতাশ জীবনানন্দ। এ সময় তাঁর আত্মবিশ্বাসেও ফাটল ধরেছিলো। অধ্যাপনার বা পড়ানোর কাজ খুব একটা পছন্দের ছিলো না, তবুও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। ভাইবৌ নলীনী চক্রবর্তীকে তিনি অধ্যাপনার সম্পর্কে লিখেছিলেন। ‘অধ্যাপনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেসবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন ঠিকই। তবে অধ্যাপনা জিনিসটা কোনো দিনই আমার ভালো লাগেনি। যেসব জিনিস যাঁদের কাছে যেমন ভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে—তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবুও সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশী জাগে তা স্বীকার করি।’ শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেও, সন্তুষ্ট ছিলেন না, সম্ভবত নিশ্চিন্ত কোনো শিক্ষকতাও কোনো দিন পাননি। একটা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন, চিঠি লিখেছিলেন শিক্ষকতা/অধ্যাপনা চাকরির খোঁজের জন্য হরপ্রসাদ মিত্র, নরেশ গুহ কিংবা অনিল বিশ্বাসকে। হরপ্রসাদ মিত্রকে লিখেছিলেন : অমৃতবাজার পত্রিকায় দেখা গেছে, কলকাতার কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে ইংরাজি শিক্ষক নেওয়া হবে। কিন্তু কলেজের নামের পরিবর্তে পোস্ট বক্স নম্বর ব্যবহৃত বলে বুঝতে পারছি না স্কটিশচার্চ অথবা সিটি কলেজের প্রয়োজনে এই বিজ্ঞাপন।’

আর্থিক প্রয়োজনে জীবনানন্দ একসময় সিনেমার গান লেখবার কথাও ভেবেছিলেন। বন্ধু কবি অরবিন্দ গুহের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন—‘সিনেমার গান লিখলে নাকি টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জানো এবিষয়ে?’ অরবিন্দ বাবু তখন এবিষয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে বিষয়টি তুলতে পারেননি কবি। এর পর অরবিন্দ বাবু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেন। সিনেমার ডিরেক্টার শৈলজানন্দ বাবু জীবনানন্দের কাছের মানুষ ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও পূর্বের মতই কবি আর বিষয়টি তুলতে পারেননি। কারণটি বেশ মজা করে অরবিন্দবাবুকে তিনি বলেছিলেন : এরপর সকৌতুক ভঙ্গিতে তিনি বলেন, যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেও আমি কেমন করে লিখব, ‘রাঁধে -এ -এ -এ, ঝাঁপ দিলি তুঁই মরণ যমুনায়।’

এই কথোপকথনের কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহাদুর্ঘটনা, ১৪ অক্টোবর। 

এমনই একদিন আড্ডার ছলে জীবনানন্দ অরবিন্দ গুহকে বলেছিলেন : ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমি মানুষের নীতিবোধে বিশ্বাস করি।’ এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যে, কবিতায় ও কথায়। গোটা জীবন যে আর্থিক অনিশ্চয়তা তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে তাই তার প্রধান বিপন্নতা ছিল।

মুর্শিদাবাদের সরকারি আমলা অনিল বিশ্বাসকে লেখা তাঁর চিঠির মধ্যেও কবির বিপন্নতা ধরা পরে : বর্তমানে অত্যন্ত অসুবিধায় আছি, কাজ খুঁজছি। কলকাতায় একটা সাধারণ কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। জংগীপুর কলেজে একজন ইংরেজি শিক্ষক নেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমার বর্তমান অবস্থা এমন যেকোনো রকম কাজ করতে আমি কোনোরকম দ্বিধা করবো না।’ অথচ, আমরা জানি তিনি কলকাতাকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন : কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাস রোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যাবহারিক জীবনে প্রান্তরের মতো মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতা এই স্বচ্ছন্দ পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।’ এখানে উল্লেখ করতে হয় নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর উক্তি : ‘বরাবরই আমার আত্মোহতি ও জীবিকা নিয়ে কলকাতায় থাকার ইচ্ছে।’

১৯৫১-তে যে দুর্বিষহ আর্থিক চাপ তাঁর উপর নেমে আসে তাতে একসময় বিপন্ন জীবনানন্দ জনৈক পরিচিতের সঙ্গে ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। খাঁ খাঁ বেকার সংসারের চাপে জীবনানন্দ প্রত্যহ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের কলম থেকে বিভিন্ন কাজের খোঁজ নিয়ে আবেদন করতে থাকেন। তাঁর এরকম অসহায় জীবনের, অর্থাৎ কর্মহীনপর্বে একবার পরিচিতদের পরামর্শে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাইটার্সে রেভিনিউ বোর্ডের সদ্য আই সি এস সত্যেন ব্যানার্জীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাইটার্স বিল্ডিংয়েই অবনীমোহন কুশারীর ঘরে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। 

পরের বছর চাকরি পেলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য। এ সময়ই চার মাসের জন্য চাকরি পান জীবনানন্দ, ১৯৫২-র নভেম্বর থেকে ১৯৫৩-র ফেব্রুয়ারি, বড়িশা কলেজে শিক্ষকতার। কিন্তু এখানেও থাকা হয়নি। এই সময়কালে তিনি এতটাই বিপন্ন ছিলেন যে কবিতাও লিখে উঠতে পারছিলেন না। এ সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুরজিত দাশগুপ্ত একবার জলার্কের জন্য বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্য পৃথক দর উল্লেখ করেছিলেন। সুরজিৎ দাশগুপ্ত এ কথা জীবনানন্দকে জানিয়ে তাঁর কোন দর আছে কিনা জানতে চাইলে জীবনানন্দ লেখেন, ‘একটি কবিতার জন্য সম্মানমূল্য আমি সাধারণতঃ ২৫/৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পাই, তোমরা ২০ টাকা দাও। আমি সময় করে ভালোভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই।’ লেখার জন্য সময় ও সাধনা দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতার বেশি। ২রা নভেম্বর ১৯৫১তে তিনি এই চিঠিটি লেখেন।

ইতোপূর্বে কিছু চিঠির উল্লেখ করেছি, এমনি ১৯৫৭র জ্যৈষ্ঠ মাসে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে কবি লেখেন ‘বেশ ঠেকে পড়েছি, সেজন্য বিরক্ত করতে হলো আপনাকে। এখুনি পাঁচশ টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন। এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি। পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখা নেই) পাঠাবো। আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়—ছদ্মনামে) পূর্বাশায়, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই—আমাদের মতো দু-চারজন বিপদগ্রস্ত সাহিত্যিকের এরকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেকদিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন—সেজন্য গভীর ধন্যবাদ। লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব, না হয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ-সাত মাস তার বেশি নয়, দেরি হতে পারে।’ এক সময় তিনি, এই অবস্থায় পড়বার অনেক আগে অচিন্তকুমার সেনগুপ্তকে লিখেছিলেন ‘চারদিকে বে-দরদীর ভিড়। আমার যে একটি সমানধর্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলনসূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সা-কড়ি নেই বলে জীবনে “creative comforts” জিনিসটা হয়তো চিরদিন আমাদের এড়িয়ে যাবে।’ বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, বছরের পর বছর অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছে তাঁকে। খবরের কাগজের দপ্তরে কাজও করেছেন। স্বরাজ-এ প্রায় বেতনহীন অবস্থায় কয়েকমাস কাজ করেছেন, রবিবারের সাময়িকী দেখতেন। এই কাগজের চাকরি ছাড়ার পরেই তীব্র আর্থিক দুরাবস্থায় পড়ে বাধ্য হন উপন্যাস লিখতেন, রোজগারের জন্য, স্বাভাবিকভাবেই অনেকাংশে তা তাই হয়ে উঠে আত্মজৈবনিক। নিজস্ব যন্ত্রণা-জটিল জীবনের আলো-আঁধার অনুসৃত সৃজনের পেছনে থেকেছে তার আত্মগত উচ্চারণ। 

এক সময় যে কবি বুঝেছিলেন ‘এ যুগ অনেক লেখকের, একজনের নয়—কয়েকজন কবির যুগ; বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বের স্বপ্ন দেখা জগৎ স্বপ্ন দেখানো জগত, ক্রমশ শতাব্দীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছিলো। প্রকৃতির রূপ রস-এ নিমজ্জিত কবিও এই যন্ত্রণার বিবর্তন টের পেয়েছেন। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, কালোবাজারী, বেকারত্ব, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছিলো, পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এই সময়ের সর্বোচ্চ আলোড়ন। শতাব্দীর এই রাক্ষসী বেলায় আর বাস্তবের রক্ততটে জীবনানন্দের আগমন। যার কাছে বাংলার লক্ষ গ্রাম ‘নিরাশায় আলোকহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেজ’। জীবনানন্দ যে যন্ত্রণায় তাড়িত হয়েছিলেন তা কি শুধু বাইরের জগতের, নাকি তাঁর অভ্যন্তরের, খবর কে রাখে? তাঁর যন্ত্রণার চিহ্ন নিয়ে রয়ে গেছে তাঁর কবিতা :

‘কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি,
হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনদিন;

...

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?’

তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’ পর্বের কবিতায় জীবনানন্দের যে আস্তিক্যবোধের স্পর্শ পাই, সংশয়ের চিহ্ন দেখি তা পরবর্তীতে ‘মহাজিজ্ঞাসা’য় দৃঢ় হয়ে ওঠে। জীবন যাঁর কাছে ছিল ‘অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকা’, আবার তিনিই লেখেন, ‘তবু চারিদিকে রণক্লান্ত কাজের আহ্বান। / সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ-পথেই পৃথীবীর ক্রমমুক্তি হবে’। জীবনের প্রতি প্রত্যাশামুক্ত কবিকে ক্রমশ মৃত্যু বোধ আচ্ছন্ন করছিল। যিনি একসময় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর ভরাট বাজার লোকসান / লোভ পচা উদ্ভিদ কুষ্ঠ মৃত গলিত আমিষ গন্ধ ঠেলে / সময়ের সমুদ্রকে বারবার মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যেতে ব’লে।’ (পৃথিবীতে এই) তিনিই লেখেন ‘কোথাও মৃত্যু নেই—বিরহ নেই / প্রেম সেতুর থেকে সেতুলোক—/ চলছে—জ্বলছে দ্যাখ। (আমি) স্বেচ্ছা ধ্বংসের যে ধূসর ছায়ায় তিনি বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন, সেই শান্তি তাকে দিয়েছিলো মৃত্যু, স্বেছা আহূত কি সেই মৃত্যু? যেখানে কবি ‘কোনোদিন জাগিবে না আর / জানিবার গাঢ় বেদনার / অবিরাম—অবিরাম ভার/ সহিব না আর’।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি