X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
আসাদ মান্নানের কবিতা

প্রেম ও দ্রোহের নির্যাস

বনানী চক্রবর্তী
০৩ নভেম্বর ২০২১, ১৪:৪৪আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১৪:৪৪

অজস্র ফুলের গন্ধে ভরে গেছে অগ্নিদগ্ধ কৌমের বাগান;

ও আমার মাতৃভাষা! তুমিই তো বাঙালির একমাত্র দেবী

যে কিনা রক্তের স্নানে পুণ্য হয়ে আমাকে জাগিয়ে রাখে

অহংকারে।

দৃপ্ত অহংকারে মায়ের পায়ে যে কবি ফুলের অর্ঘ্য দিতে চেয়েছে আবার ফুলের মতো অনিত্য, পচনশীল কোনো অর্ঘ্যে সন্তুষ্ট না হয়ে প্রেমে রক্তে রঞ্জিত করতে চেয়েছেন যে কবি, তাঁর উদার প্রেম, দরাজ হৃদয় এবং টলটলে জলের আবেগে বাংলা সাহিত্যকে ভাসিয়ে আবির্ভূত হবেন, সে আর বলতে হয়! হ্যাঁ, আমি কবি আসাদ মান্নানের কথাই বলছি। সত্তরের দশকের এই কবি তাঁর কলমে একাধারে কুঠার ও বাঁশিকে যোগ করে নিয়েছিলেন জলকুমার এই পুরুষ হৃদয়ে টলটলে পদ্মপাতায় জল ভাসমান উন্মত্ততা এবং সর্বগ্রাসী অনুসন্ধিৎসা কলমে ধারণ করেছেন। বঙ্গোপাসাগরের পাড় ছুঁয়ে চট্টগ্রামের সন্দীপে জাত এই কবির দু’চোখে রোমান্টিক স্বপ্নের কাজল। বারবার নানাভাবে পুঙ্খতায় অনুপুঙ্খতায় ভালোমন্দ সুখ-দুঃখ অন্ধকার আলো ছুঁয়ে দেখছেন, ছুঁয়ে থাকছেন।

সত্তরের দশক, এই কবির উত্তাল কৈশোর যৌবনের ডাক দেশমাতার শিকল ভাঙার গানের সাক্ষী করেছে। সাধারণ একান্নবর্তী যত্রতত্র বেড়ে ওঠা কবি গভীর চোখে, অনুভবে পৃথিবীকে যেন ধারণ করেছেন হৃদয়ে, তা কখনো আগুন জ্বালছে, বঞ্চনা, শোষণ লাঞ্ছনা ঘেন্না তৈরি করছে, রাগ সৃষ্টি করছে। নিজের মায়ের লাঞ্ছনার সঙ্গে দেশমাতৃকার লাঞ্ছনা কোথাও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে আগুন ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিরোধের আগুন’ হয়ে উঠছে। উত্তাল পারিপার্শ্বিকতা পরাজয়ের গ্লানি, জয়ের আনন্দ নানাভাবে কবিকে দোলায়িত করছে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নাকি সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ‘আমার সোনার বাংলা’ উপহার দিচ্ছে, অনুভবি কবি তার কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। তবুও কোথাও একান্ত মধুরতম মোহমুগ্ধতায় মাতৃভাষার কথা মাতৃমূর্তির কথা হৃদয়েতে জাগরূক হয়—

সে এক আশ্চর্য নারী, অপরূপ অঙ্গ জুড়ে তার

রয়েছে তাঁতের শাড়ি-সবুজের-মাঝখানে লালের ছোবল

হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে অহংকারী আঁচলের ঢেউ—

পবিত্র সংসদ আর অই প্রিয় জাতীয় পতাকা

এ নারীর রূপে তিনি আবাল্য মুগ্ধ ক্রীতদাস। দেশসেবক, জন্মদাস কবি তাই প্রকৃতির পরতে পরতে কখনো নারীকে খোঁজেন, নিজ নারী, কখনোবা মা, দেশমাতৃকা হয়ে ওঠেন মাতৃরূপা নারী, আশ্রয়স্থল।

এমন আশ্রয়স্থল কবিদের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষাই যেন। সহজ সরল এক সত্যকথন, এক স্বীকারোক্তির আলো মায়ের পায়ের কাছে ঝলসিত হয়—

মাকে বলতে সংকোচ নেই, দিন ফুরোলে আমি

তোমার কাছে গিয়েছিলাম, তোমার পায়ে মুখ

রেখে অগাধ শান্তি পেয়েছিলাম।

ভ্রূকুটিহীন সন্ধ্যাতারা উঠল যখন,

নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে অর্পিত দেহের

দায়িত্ব যে নিয়েছিলাম, সে সব কথা মাকে

বলতে-বলতে পাগল হয়ে যাব।

এই পৃথিবীর দিকে বিমূঢ় বিস্মিত চোখে যখনই তাকান কবি আসাদ মান্নান মনে হয় সবুজ রমণী, দুখিনী বাংলা তাঁর হৃদয়ে লালন করে কুলপ্লাবী ভালোবাসা যেন। তার বুকে গান গায় অগণিত চাঁদ তারা পাখি। সেই মাঝখানে মমতাময়ী তাঁর মা দুখিনী বাংলা মা করুণ হাসিতে, সন্তানের যন্ত্রণার ভাগীদার হন। সে যেন চিরকালীন এক ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া কোনো সুরভিত ম্লান মুখ। অন্ধকার গুহাহিত হিংস্রতা তাঁর নজরে থাকে, নিতান্ত এক অপারগ নবাধ্যতায় সহ্য করে নেন সবকিছু। দুখিনী বাংলা মা উপায়ান্তর না পেয়ে ডৈকধারী পিরজাদাই হন যেন, নতুবা এক বকধার্মিক, যাই বলি না কেন—

তসবি হাতে ধ্যানে মগ্ন বুড়ো চিতাবাঘ

হৃদয়ে রয়েছে তার অগণিত রক্তখাকি স্মৃতি, হিংস্রতা হলাহল। অশুভ শক্তির কাছে প্রতিহত হয়ে বাধ্যত পিছু হটে গিয়ে, পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ভানকেই সম্বল করেছে।

রক্ত নদী এই কবি নিজ পায়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে এই কবি কাব্যভুবনে পা রেখেছেন। তাই, এক হাতে প্রেম ও প্রকৃতি অন্য হাতে প্রতিবাদের মশাল নিয়ে বহু পথ হেঁটে এসেছেন। বাস্তব জীবনে জলের সঙ্গে লড়াই, বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে, প্রকৃতি বিরুদ্ধতা না মেনে নিয়ে, হার না মানা এই কবি জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় কলম ছুঁয়েছেন। কৃষিজীবী, গৃহস্থ পরিবার, চারণকবি বাউণ্ডুলে বাবা, বহু ভাইবোন আত্মীয় পরিজনের সংসারে, আলো বাসস্থানের অসঙ্কুলানে বৈভববিহীন এক দুরন্ত সংগ্রাম, উত্তাল সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ঝড়ে ওড়া, ডুবে যাওয়া পাখির মতোই জীবনের প্রতিবন্ধকতাকে পদে পদে ছুঁয়ে থেকেছেন। অদম্য প্রতিভা ও জীবন দেখার ক্ষিদে কোনো কিছুতেই হার মানতে দেয়নি তাঁকে। শিক্ষা ও সৃষ্টি দুহাত ভরে দিয়েছে কানায় কানায়।

জিনবাহিত চারণকবির হার না মানা অদম্য জেদ তাঁকেও সদ্য কৈশোরে জারীগান রচনা করার প্রণোদনা দিয়েছে। উপন্যাস রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা ইত্যাদি নানা নজরে পড়ার মতো ক্রিয়াকাণ্ডে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ ও মগ্নতা দিয়েছে। দুই মা, ভাইবোনের ভরাভর্তি সংসার থেকে বৃহত্তর কর্মব্যাপদেশে এ কবির পাড়ি কবিতারও ব্যাপ্তি এনে দিয়েছে। এনেছে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান। পেয়েছেন বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৭, ’৭৮), কর্ণফুলী সাহিত্য পদক, জীবনানন্দ পদক ও পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পদক ও সম্মাননা, কবিকুঞ্জ পুরস্কার ও সম্মাননা, পুনশ্চ পদক, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সাহিত্য পুরস্কার, খড়িমাটি সম্মাননা ইত্যাদি। পুরস্কার আর কিছু নয়, কবিতাকে সার্থকভাবে ছুঁয়ে থাকা অভিজ্ঞান মাত্র। আজও তাঁর সচল কলম বহু কাব্যগ্রন্থে নানাবিধ জীবনের বোধগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে সামনে চলেছে। বহু কাব্যগ্রন্থের মাঝে ইতোমধ্যে অনেক আলোর বর্ণালি সার্থকভাবেই ছড়িয়েছেন কবি। কাব্যগ্রন্থের নামই কখনো কখনো এক একটি কবিতা হয়ে উঠেছে যেন। দু-একটি উচ্চারণ এইখানে  মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। যেমন— সুন্দর দক্ষিণে থাকে, সূর্যাস্তের উলটো দিকে, সৈয়দ বংশের ফুল, দ্বিতীয় জন্মের দিকে, ভালোবাসা আগুনের নদী, তোমার কীর্তন, যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী, হে অন্ধ জলের রাজা, মরুভূমি স্বপ্ন দ্যাখে জল, জলের সানাই, পাথর সে কী করে কাঁদে, কুয়াশা উপেক্ষা করে বসে আছে আশা, এলিজি মুজিব নামে, তিনি পিতা মৃত্যুহীন, অদৃশ্য জল্লাদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

কাব্যগ্রন্থের নামই কবিতায় প্রবেশ করার আগ্রহ জাগাবে সন্দেহ নেই।

যে কথার মাঝখানে আবার ফেরার কথা ছিল, এইবার সেইখানে ফিরি। কবি আসাদ মান্নান অবিরত সংগ্রাম ও স্বপ্নের কারিগর যেন। দৃপ্ত, পেলব জলজ গভীর কখনো অপার অনুভূতি আমাদের নানাভাবে পরিমিতি ও অপরিমিততায় আমাদের উপহার দিয়ে যান। সেই অনুভূতি নানাভাবে অনুভবি পাঠককে আক্রান্ত করে। কখনো মাতৃসত্তা, যোগ্য সন্তান হওয়ার আকুতির মাঝখানে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রকৃতি ও মা একাকার হয়ে যায়-

যেমন শৈশবকালে পুকুরের ঠিক মধ্যখানে

আমার চোয়ালে বসা অহংকারী তিলের স্বভাবে

একটি শাপলাফুল ভাসমান; জলের বাগানে

নক্ষত্রের স্থির চোখে, কখনোবা রঙিন খোয়াবে

আমাকে মাতাল করে আগুনের বানর নাচায়—

সমুদ্র গোলাপরূপে তুমিও তেমন;

এই অপরূপ লাবণ্যময়ী মা কিংবা দেশমাতা তাঁর লাবণ্যঘন ঘাঁটি হারিয়ে ফেলেন। আমরাও তাঁকে রক্ষা করতে পারি না। ‘এখানে প্রেমিক যারা তারা বড় বেশি ক্ষণিকের/স্মৃতির পাথরে গড়ে অস্তিত্বের চলন্ত বাসর’ বিরুদ্ধ জলের মুখে দেশজ লাবণ্য সমর্পিত আত্মার সংগীত শোনে, অর্ফিয়সী বাঁশির আসর মন্দিরে গির্জায় ঘোরে—

শকুন শিয়াল আর বন্য

হাওয়ার শরীরে নাচে নরলোভী মৃত্যুর শহর

জননীর স্তন জ্বলে জনকের নেশাখোর চোখে

স্বপ্নের সমুদ্রে ভাসে প্রিয় দ্বীপ সন্দীপের চর;

কবির বঙ্গভূমির এ কোন দুর্ভাগা রূপ! অথচ এই নারীর শরীর হৃদয় জুড়ে আহারে বাহারে রূপ! প্রেমের মতন কালো ঘাসফুলের বাহারি আলোকে নক্ষত্রে মিলিত হওয়ার ছিল তন্দ্রাহীন ফসলের ঘ্রাণ, গাভির প্রসব, সন্তানের লেজের আগায় হয়তো বিরাজ করত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গান। এই এ রমণী ‘সমুদ্র গোলাপ’। পাখির ডানার ভাঁজে রৌদ্রনীল জ্যোৎস্নার ছায়ায়, জীবনানন্দীয় এক প্রকৃতির আশঙ্কা রচিত হতো সবুজ আতর জলে ঈশ্বরের প্রিয় উপহার। কিন্তু হায়! বিধাতার কোন অভিশাপে আজন্ম শিশুর মতো সারল্যময়ীরে প্রজ্জ্বলিত সবুজ সংসার থেকে পৃথিবীর হিংস্রতম সভ্যতার পাপে ডুবিয়েছে—

তোমার চারদিকে ভাসে বেহুলার বিশ্বাসের ভেলা,

ইন্দ্রের সভায় নাচে পৃথিবীর কৃষ্ণ অবহেলা।

আত্মপ্রত্যয়ী কবি এই অবহেলা মেনে নেবেন কীভাবে! তাঁর কাছে স্বাধীনতা রক্ত থেকে জন্ম নেয়া এক সবুজ পাখির নাম; জন্ম থেকে তার গায়ে কত শহিদের ছোপ ছোপ রক্ত আর অশ্রুকণা লেগে আছে। আজন্ম দুখিনী এই লাল সবুজের দেশটাকে ‘কতিপয় মাতৃগামী লম্পট শুয়োর নির্বিবাদে বহুদিন করেছে ধর্ষণ’-আগুনে পুড়িয়ে খুন করেছে অগণিত শিশু নারী নিরীহ পথিক।

এ সভ্যতা কোনো অনুভবী মানুষের কাঙ্ক্ষিত নয়। কবিও পারে না। কোনোভাবে এই যন্ত্রণার হতাশ্বাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে এ পৃথিবীতে। তাই মনে হয় আসুক প্রলয়। ধ্বংস হয়ে যাক সবকিছু। হারাবার বিনিময়ে আবার নতুনভাবে কান্নার দাম দিয়ে নতুন পৃথিবী হোক। কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে কবি আসাদের কণ্ঠও একই কথা কলমেতে তুলে আনে যেন—

কালো মেঘ, তুমি এসো

এ সভ্যতা ধুয়ে মুছে দাও

 

আজ চারিদিকে শুধু

নীরস ভদ্রতা

এবার শুকনো হাসি

শেষ হোক- তুমি এসো

মানুষ নিজের ঘরে বসে

কাঁদুক আবার।

সত্তরের যন্ত্রণাকাতর কবি আসাদ মান্নান সময়ের মশাল হাতে এগিয়ে চলেছেন। কেউবা মশাল, কেউবা কুঠার হাতে ওই যে টলমল দিনে মায়ের বন্ধন আর মায়ের শেকল ভাঙার গান গেয়েছেন নানারূপে, নানাভাবে, হতাশ্বাসের কালো অন্ধকার দূরে সরিয়ে আবার নতুন এক আলোর দিশারী হওয়ার স্বপ্ন বুনেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের কলমে উঠে এসেছে প্রতিরোধের, আশাবাদের উচ্চারণ—

তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিনের দিগন্তে

আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।

সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটির দ্বীপ

শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে

নবীন সূর্যেরে তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।

সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।

কবি আসাদও আবার আশার বুক বাঁধেন। কণ্ঠ তুলে জানান দেন সেই বিভীষিকাময় দুঃসময়ের সাক্ষী যারা তারা আজও মরে যায়নি। তারা যতদিন বেঁচে থাকবে চারণকবির মতো আমৃত্যু জাতিকে সেই যন্ত্রণার দিনলিপি ফেরি করে যাবে। আলো ও অন্ধকারে অশুভ শক্তির থাবা ওতপেতে বসে আছে, স্বাধীনতা পাখিটাকে আবার কখন মেরে ফেলে পরাজিত করা যায় ভেবে। কবির সত্যকরণকারী মন শুভচিন্তক বিবেকের আহ্বান সোচ্চারে বারবার বলে—

সবাই আসুন আজ পাখিটাকে যত্ন করে রাখি,

আকাশ জড়িয়ে রাখা হৃদয়ের অসীম খাঁচায়

শুধু মাতৃভূমি নয়, মাতৃভাষা উচ্চারিত হলে কবিরও হৃদয়ে আলো জ্বলে ওঠে। অগাধ ভালোবাসায় হৃদয় প্রণত হয়—

নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে ফুল হাতে ওরা যায় প্রভাতফেরিতে—

অতটা নকল প্রেম বুকে নিয়ে আমি যাব শহিদ মিনারে!

না, আমি তোমাকে নিয়ে নগ্নতার শোভাহীন বেসাতি করি না;

আমার অস্তিত্ব তুমি; অহংকার অমরতা-তাও শুধু তুমি;

তোমাকে বাজারে তুলে কবিতার গন্ধহীন চরণে চরণে

কখনো চাই না পেতে;-পেতে চাই কালজয়ী গানের খাতায়।

কবিতার গন্ধহীন চরণ, কিংবা গানের কালজয়ী হবার বিতর্কে না গিয়ে বরং অনাবিল আবেগে আপ্লুত কবির মরমী হৃদয়ের অগাধ ভালোবাসাকেই দুই হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি।

বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে কবি সিদ্ধেশ্বর সেন স্মৃতির অভিজ্ঞান পৌঁছে দিয়ে যে প্রশ্ন করেছেন, কবি আসাদ মান্নানের সঙ্গে কোথায় যেন তার স্পর্শ লেগে আছে। সিদ্ধেশ্বর কবিতার উচ্চারণে প্রশ্ন করছেন—

জীবন ভঙ্গুর ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে

ধুলোয় কাঁকরে হাসিকান্না মুখ লুকায়

দিনরাত্রি একই বৃত্তে ফুঁপিয়ে কাঁদে

.......................................

আমার অস্তিত্ব তোমার অস্তিত্বে বাঁধা

আমার শিকড় তোমার মাটিকে খোঁজে

আমার দিন চায় তোমর রাত্রির সাড়া

বলো কোন ভাষায় কথা বলবে?

এই অনুভবি ছুঁয়ে থাকা কবি আসাদ মান্নানকেও কোথায় যেন এপার ওপার আপার করেছে। তাই, দেশভাগ আগস্ট বিপর্যয়, অগণিত মূল ও ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ, জন্মভূমি ত্যাগ, অকালে ফুরিয়ে যাওয়া, বহু নারী বহু শিশু শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া এই কবির হৃদয়েও ক্ষতস্থান সৃষ্টি করেছে। সেই সব আগুন অনুভূতি প্রকাশও করেন তাঁর কবিতায়—

পৃথিবীর দেশে দেশে আগস্ট কেবলই মাস;

কিন্তু চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল ব্যাপ্ত একটা ভূখণ্ডে

এ কেবল মাস নয় : আকাশে ছড়িয়ে থাকা

ছিন্ন ভিন্ন শোকাহত পঞ্জিকায় কলঙ্কের কাল সমাহার

হতভাগা এ জাতির ললাট লিখন

এ বাঙালি জাতির এ যন্ত্রণা কবির মতে হয়তো একদিন প্রশমিত হয়ে যাবে। স্বাধীনতার আনন্দে তারা হয়তো সুখ ও শান্তির গানে টালমাটাল মুগ্ধ হয়ে আনন্দ সভায় আবার মিলিত হবে, শিশুরা মায়ের হাতে তুলে দেবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বাধীনতা ফুল, প্রেমিকা হারিয়ে যাবে প্রেমিকের খোলা বুক ধরে, কৃষান কৃষানী মিলে ভরে দেবে ফসলের গোলা। প্রকৃতিও ভুলে যাবে এই ক্ষত। চাঁদও কলঙ্ক ধুয়ে হেসে হেসে বাতাসে ওড়াবে তার জ্যোৎস্নার রূপালি ফেনা। ভুলে যাবে সকলেই পিতৃপিতামহদের শোকগাথা। ‘আমাদের কান্নাগুলো জমা হবে অবিরাম বৃষ্টির ফোঁটায়’ আমাদের ‘প্রিয় পিতৃমুখ অন্ধকার ভেদ করে উঁকি দেবে মেঘের কফিনে। কবিও এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় হয়ে ওঠেন যেন একা এক ‘বিপন্ন এতিম’। তাঁর মনে হয়—

আগস্ট এলেই কেন নিজেকে আমার বড় বেশি অপরাধী মনে হয়

জনকের রক্ত ছাড়া আমি আর কিছুই দেখি না।

কবি তাই একাধারে হাহাকার, অন্য পক্ষে নতুন সূর্যের আহ্বান বুকে লালন করে চলেন—

আমি যে নির্বাক; তবুও তোমাকে ডাকছি শব্দহীন—

ধরা দাও, শুধু আর একবার ধরা দাও

পিতার রক্তের ঋণ শোধ করবার

কালি দাও শব্দ দাও শক্তি দাও

অধমের নির্বাক কলমে—

অভিশাপে অভিশাপে জর্জরিত আগস্ট মাসের

শোকাচ্ছন্ন প্রথম প্রহরে মনে হলো

কিছু কিছু মৃত্যু আছে জন্মের চেয়েও

আরও অধিক আলো আর ভালোবাসা ছড়াতে ছড়াতে

ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে বলতে থাকে

বাঁচতে হলে জাগতে হবে—

বাঁচতে হলে জেগে থাকো সন্তান আমার।

এই জেগে থাকার মন্ত্র আর পরশুরামের কুঠার কবি হাতে তুলে নিয়েছেন বলেই কি কবির প্রত্যয় এই উচ্চারণ করে—

মধ্য রাতে লোকালয় ছেড়ে

আমাকে ভোরের আগে যেতে হবে নদীর ওপারে;

আমাকে ভাঙতেই হবে ভ্রাম্যমান জলের সাধনা

মানুষ ছেড়েছে ঘর গোলাপের কবর বানাতে।

মানুষ ছেড়েছে ঘর। মানুষকে ঘর ছাড়া করেছে মানুষ। স্বার্থান্বেষী লোভী কিছু পিশাচ মানুষ। প্রতিফলে প্রকৃতি সাগর জল সকলেই বিপন্ন হয়েছে। স্বাভাবিক বাঁচার ইত্যাদি প্রকৃতি হারিয়ে গিয়েছে। ভয় সন্ত্রাস অত্যাচার মানুষকে সংকুচিত করেছে। স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে দূরে বহু দূরে নিয়ে চলে গিয়েছে। যে কবির ‘দৃপ্ত আমি’ প্রকৃতির, সমুদ্রের একান্ত দোসর, সমুদ্রও তাকে যেন সন্ত্রাসে কাছে ডাকার সাহস করছে না। কবিও স্থির নয় তাঁর সমকাল ও বারুদ গন্ধ নিয়ে—

এ প্রথম সে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেনি;

জিজ্ঞেস করেছে শুধু-কেন আমি অন্ধকারে হাঁটি—

আমার পায়ের নিচে কেন আজ সরে যাচ্ছে মাটি;

কবিতা পাড়ায় কেন আজকাল রমণ করি না।

‘রমণ’ তো নিশ্চিন্ত প্রাণের স্ফুর্তির আরেক নাম। সভ্যতার ওপর যদি কালো হাত নেমে আসে, লন্ডন আমেরিকা রোষ নেত্রে চায়, অসহায় ইরাকবাসীর যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে বাকস্ফুর্তি বন্ধ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক তাদের মতো সমুদ্রেরও যেন বাক্স্ফুর্তি নেই, কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে ভয়ে। কবি ও সাগর যুগপৎ কৌতূহলী প্রশ্নকাতর চোখে এই যে চার চোখে চাওয়া তাই যেন কলম ছুঁয়েছে। লিখিত হয়েছে চিরকালীন মানবতার বাণী—

আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে পুরনো কবর;

যারা যাবে তারা যাক জাহান্নামে; ‘স্বর্গে যাব আমি’—

‘এমন করি না দাবি’; আমি চাই মৃতিকার ওম—

আমার চোখের মধ্যে ফোটে যেন ঘুমের কুসুম।

যেখানে পায়ের নিচে মৃত্যুর স্বাক্ষর, বাতাসে বারুদগন্ধ লেলিহান শিখা, সেখানে কীভাবে আর আত্মরাত বড় করে, আপন আহ্লাদে মেতে ওঠা যায় আর। কবিও পারেননি তা। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছেন। সমুদ্রের জনান্তিকে মৃদুস্বরে স্বগত কথন তাঁর যে কানে বাজে—

সমুদ্র আমাকে বলে, যুদ্ধ আর আগ্রাসনে অই

মানুষের কবিতার মানচিত্র পালটে যাচ্ছে দ্রুত;

পালটে গেছে মাটি-মাটি আজ আণবিক ঘাঁটি;

                                    মরুভূমি স্বপ্ন দেখে জল

 

মূল প্রবন্ধের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হলো

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী