গত ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মরণোত্তর ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন-বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পিতার পক্ষে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রির সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বদান করে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মরণোত্তর ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করলো। এটি বঙ্গবন্ধুর জন্য যেমন সম্মানের, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও গৌরবের। এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সংবাদে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জাগে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো কেমন ছিল, তা জানার।
ইতিহাসের পাতায় চোখ মেললে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। তিনি ওঠেন ১৫০ মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ অফিসে এবং বসবাস শুরু করেন তাঁর বন্ধু শওকত আলীর সঙ্গে। ঢাকায় এসেই তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হন এবং ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এ সংগঠনের কার্যকরী কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯৪৭-১৯৪৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বি.এল প্রথম বর্ষে ভর্তি হন ১৯৪৭ সালের ১ ডিসেম্বর। তাঁর রোল নম্বর ছিল ১৬৬। এস. এম. হলে সংযুক্ত থাকলেও বাস করতেন ১৫০ মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ অফিসে। ভর্তি হয়েই তিনি এখানকার ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগেই কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের উদীয়মান নেতা হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। কলকাতা বসবাসকাল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ রাজনীতিবিদের নিবিড় সান্নিধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করেন এবং একজন দক্ষ সংগঠক হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, ছাত্রদের আস্থা অর্জন করে তিনি ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের জি. এস. নির্বাচিত হন। কলকাতায় অর্জিত ছাত্র রাজনীতির এই অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পূর্ববঙ্গের ছাত্র রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকায় আসেন তখন নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ছাত্র রাজনীতিতে নানা পালাবদল ঘটছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দীন-আকরাম খাঁ গ্রুপের তল্পিবাহক সংগঠনে পরিণত হওয়ায় এ সংগঠনের হাশিম-শহীদ গ্রুপের নেতা-কর্মীরা নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্যোগের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্তদের একজন ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন বলেছেন, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো একদিন শেখ মুজিবুর রহমান ফজলুল হক মুসলিম হলে এসে এক ছাত্রসভায় বলেন, আমরা পাকিস্তান পেয়েছি, একে উন্নত করে গড়ে তুলতে দরকার একটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর আগে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে একটি লিফলেট প্রকাশ করা হয়। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আবদুল মতিন আরও লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনারা এগিয়ে আসুন, আমরা একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলি।’ আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম। মোগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্প সমর্থিত নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের আবেদনে সাড়া দিলেন। অলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমিসহ আরো কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্র ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক কর্মীসভায় বসি। এ সময় আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি।” বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে প্রায় এমনই বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। এমতাবস্থায় আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নঈমুদ্দীন, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরো অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হলো, সেখানে স্থির হলো একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নঈমুদ্দীনকে কনভেনর করা হলো। ... যদিও নঈমুদ্দীন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন এবং নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। এ সময় নঈমুদ্দীন আহমদ এবং তিনি ‘পূর্ব্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণ- কৈফিয়ত দিতে হবে- আমাদের দাবী’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যেটি ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবন ‘বর্ধমান হাউস’-এ মুসলিম লীগের সভা চলাকালীন তা বিতরণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয়। এদিকে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষাবিষয়ক সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হলে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে এবং ভাষা আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১ মার্চ আবুল কাসেম, নঈমুদ্দীন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। ভাষা আন্দোলন সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য ২ মার্চ পুনর্গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্ত ছিলেন। শামসুল হক তাঁর রাজবন্দির জবানবন্দিতে লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠনের পর ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের লক্ষ্যে ধর্মঘট-কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানসহ নয়জন ছাত্রনেতার স্বাক্ষরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আরও একটি লিফলেট প্রকাশ করা হয়। তিনি ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে আয়োজিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যোগ দেন, যা তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে উল্লেখ আছে। সভায় আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। ১১ মার্চ ধর্মঘটের পক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করতে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি স্থানে সফর করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১০ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যোগ দেন এবং ১১ মার্চের ধর্মঘট-কর্মসূচিতে কে কোথায় পিকেটিং-এ নেতৃত্ব দেবেন, তা নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন।
১১ মার্চ ভোর থেকেই ছাত্রনেতৃবৃন্দ ধর্মঘটের সমর্থনে পিকেটিং শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ছাত্রদের সংগঠিত করে জেনারেল পোস্ট অফিস ও সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করেন। এ সময় তিনি, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেক ছাত্রনেতা পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। তাঁদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ছাত্রনেতাদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন। আন্দোলন প্রবল রূপ ধারণ করলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ৮ দফা সমঝোতা চুক্তি করেন। চুক্তির শর্তগুলো কারাগারে পাঠিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্রনেতাদের সম্মতি নেওয়া হয়। ছাত্রদের আন্দোলন এবং চুক্তির প্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য বন্দিরা মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির পর শেখ মুজিবসহ সকল ছাত্রনেতাকে একটি ট্রাকে চড়িয়ে ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করানো হয়। রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমান খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে করা সমঝোতা চুক্তিতে রদবদল করা অর্থাৎ- বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি না দেখে ক্ষুব্ধ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরপারে ছাত্রদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে চুক্তি বাস্তবায়নে আশঙ্কা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে ১৬ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি এবং শওকত আলী ১৫০ মোগলটুলীতে গিয়ে রাত্রি যাপন করেন।
১৬ মার্চ সকালে তিনি এবং শওকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে আসেন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করে আমতলার ছাত্রসভায় যোগ দেন। বেলা দেড়টায় সভা শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজিত ঐ সভায় খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে করা ৮ দফা চুক্তি সংশোধন করে অলি আহাদ মারফত সেটি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। সভা শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ অভিমুখে যাত্রা করে। তখন আইন পরিষদের অদিবেশন চলছিল। ফলে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে শওকত আলীসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা আহত হন। ছাত্রদের ওপর হামলার বিষয় নিয়ে আইন পরিষদে ব্যাপক বাদানুবাদ হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রতাপচন্দ্র গুহ, মনোরঞ্জন ধর, আনোয়ারা খাতুন, শামসুদ্দীন আহমদ প্রমুখ পুলিশি হামলার প্রতিবাদ করেন। আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘গত ১১ই মার্চ তারিখে যা হয়েছে, তা হয়েছে। আজ পুলিশ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছে, গলা টিপে মেরেছে, তার প্রতিকার চাই। ওই সমস্ত চোরামি এখানে চলবে না। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়ে দেখে আসুন।’ পুলিশি হামলায় ছাত্ররা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা সংগঠিত হয়ে আইন পরিষদের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন সেনা তলব করেন। পূর্ববঙ্গের জিওসি অইয়ুব খান তাৎক্ষণিক সেনাদের নিয়ে সেখানে হাজির হন এবং খাজা নাজিমুদ্দীনকে আইন পরিষদের পেছনের দরজা, অর্থাৎ- রান্নাঘর দিয়ে বের হয়ে যেতে সহায়তা করেন। পরবর্তীকালে ঐ ঘটনার বর্ণনায় তিনি তাঁর ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ বইতে লিখেছেন : “আমি পরিষদের মধ্যে গেলাম এবং উজিরে আলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। ... সবার চোখে ধুলা দিয়ে উজিরে আলাকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে পার করে দিয়ে এলাম। এই অসাধারণ কার্যটি সুসম্পন্ন করার পর আমি বেরিয়ে এলাম এবং ছেলেমেয়েদের বললাম, ‘পাখী উড়ে গেছে।’ সকলে হো-হো করে হেসে উঠলো।’’ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। এতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদসভা আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আয়োজিত ঐ ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দীন আহমদ। এতে বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল তাঁর পূর্ববঙ্গে প্রথম এবং শেষ সফর। তিনি ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। তাঁকে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত জনসভায় তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। ছাত্ররা এ ঘোষণার মৃদু প্রতিবাদ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সংবর্ধনা-সভায় যোগ দেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পুনরাবৃত্তি করলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত না থাকলেও ঐ দিন তিনি কার্জন হলের বাইরে অবস্থান করেন। গভর্নর জেনারেলের বিদায়ের কয়েকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ ছাত্রসভায় শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি উর্দুপ্রেমী ছাত্রদের বক্তৃতার বিরোধিতা করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’
ছাত্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের মানুষের খাদ্য-সঙ্কটসহ নানা সমস্যা সমাধানের আন্দোলনে যুক্ত হন এবং ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী প্রভৃতি স্থানে জনসভায় বক্তৃতা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতীয় মন্ত্রিসভা’ দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কোন চেষ্টা ত করেনই নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপইয়াছেন। ভুখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত ও শত অভাবের ভারে ন্যুব্জ জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্য-ব্যবহার্য দ্রব্যের কোন ব্যবস্থা তারা করেন নাই; বরঞ্চ পাট, তামাক, সুপারী ইত্যাদির উপর নয়া ট্যাক্স বসাইয়া ও বিক্রয়-কর বৃদ্ধি করিয়া জনগণের জীবন দুর্ব্বিষহ করিয়া তুলিয়াছেন। বিনা খেসারতে জমিদারী বিলোপের ওয়াদা খেলাপ করিয়া তাঁরা জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পঞ্চাশ ষাট কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতেছেন। নুতন জরিপের নাম করিয়া তাঁরা জমিদারী প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছর স্থগিত রাখার ষড়যন্ত্র করিতেছেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অছিলায় তাঁরা অনেক দেশভক্ত লীগ-কর্ম্মীকেও বিনা বিচারে কয়েদখানায় আটকাইয়া রাখিতেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের উপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার উপর লাঠিচার্জ্জ, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার ও গুলী চালনা করিয়া তাঁরা আজাদীকে কলঙ্কিত করিয়াছেন।”
তিনি ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে ‘জুলুম প্রতিরোধ’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে গঠন করা হয় ‘জুলুম প্রতিরোধ কমিটি’। ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। এ উপলক্ষ্যে তিনি একটি বিবৃতি দিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ঐ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল-সমাবেশ আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম, নাদেরা বেগম প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরে আন্দোলন শুরু করে। কর্মচারীদের আন্দোলন হলেও শেষ পর্যন্ত তা ছাত্র-আন্দোলনে পরিণত হয়। ঐ সময় কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের নেতা অনিল বসাক। কর্মচারীরা অন্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাঁদের সংঘবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেন এবং এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার অঙ্গীকার করেন। ১৯৪৯ সালের ২ মার্চ বেলা ১.৩০টায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রায় ১৫০জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। এতে শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। সভাশেষে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। কিন্তু উপাচার্য তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করায় আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। কর্মচারীরা ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করে ৩ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু ঐ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে আবারও কথা বলেন এবং তাঁদের দাবি-দাওয়া বিষয়ে কথা বলার জন্য উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উপাচার্য তাঁর কাছে কর্মচারীদের বিষয়ে কঠোর মনোভাবের কথা জানান এবং আন্দোলন বন্ধ না করলে তাদের বরখাস্ত করার হুঁশিয়ারি দেন। এর প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতাদের নিয়ে ফজলুল হক মুসলিম হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপিদ্বয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কর্তৃপক্ষের কাছে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায় করে দিতে তাঁদের অনুরোধ জানান। তাঁরা তাতে আশ্বাস দেন এবং কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু সকল কর্মচারী যথাসময়ে কাজে যোগদান না করায় জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং কর্তৃপক্ষের কঠোর মনোভাবের কারণে আন্দোলন শুরু হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে যেমন যুক্ত হন, তেমনি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের এতে সম্পৃক্ত করেন। ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। এতে ছাত্র এবং কর্মচারীরা সম্মিলিতভাবে পিকেটিং করেন। বেলা ১২.৩০টায় ছাত্রনেতা আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কর্মচারীদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্র-প্রতিনিধিদের যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সম্পর্কে অবগত করেন। তিনি দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
৯ মার্চ বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে ছাত্র ও কর্মচারীদের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২০০ শিক্ষার্থী এবং ১৫০ জন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃক আন্দোলনকারী কর্মচারীদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। তিনি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান এবং বলেন, যতদিন কর্মচারীদের সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করবে। সভাশেষে ছাত্ররা একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের দিকে রওয়ানা হন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন আখলাকুর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, অরবিন্দ বসু, কল্যাণ দাশগুপ্ত প্রমুখ। তখন উপাচার্যের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী পরিষদের সভা চলছিল। সভাশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দাবি মানার আশ্বাস দেন এবং তাদের কাজে যোগ দিতে বলেন। কর্মচারীরা কাজে যোগ দিলেও সরকারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল স্বল্প সময় বেঁধে দিয়ে কর্মচারীদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানান এবং তাতে ব্যর্থ হওয়া কর্মচারীদের শাস্তি দেন। একই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্রদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ছাত্র ও কর্মচারীরা দফায় দফায় বৈঠক করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছাত্ররা হল ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। শেখ মুজিবুর রহমান এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন : “রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সভার পরে ঘোষণা করল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হলো। হল থেকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে হবে। আর যে সমস্ত কর্মচারী ধর্মঘটে যোগদান করেছে তাদের বরখাস্ত করা হলো।’ আমি সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সেই মুহূর্তে সভা ডাকা হলো এবং সভায় ঘোষণা করা হলো, হল ত্যাগ করা হবে না।”
মূলত ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ সামনে রেখে এবং ঐ দিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ায় আগের বছরের মতো ছাত্র আন্দোলনের আশঙ্কায় সরকার কর্মচারী আন্দোলনের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে ছাত্রদের হল ত্যাগে বাধ্য করেন। ১১ মার্চ সীমিত পরিসরে ‘ভাষা দিবস’ পালিত হয়। ছাত্ররা মিছিল বের করে। ১২ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম এবং কল্যাণ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু-শো ছাত্র-ছাত্রীর একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলকারীরা ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘ভাইস-চ্যান্সলরের বিশ্বাসঘাতকতা চলবে না’, ‘ইউনিভার্সিটি খুলতে হবে’, ‘কর্মচারীদের দাবি মানতে হবে’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের দিকে আগ্রসর হন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের চাপে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্ররা হল ত্যাগ করেন। তাঁরা ১৫০ মোগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্প অফিসে ওঠেন।
এদিকে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলে কর্মচারীরা ১৯ মার্চের মধ্যে মুচলেকা দিয়ে কাজে যোগ দেন। এভাবে আন্দোলন থেমে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের শনাক্ত করে শাস্তি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুসহ মোট ২৭জন শিক্ষার্থীকে শাস্তি প্রদান করা হয়। ছয় জনকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার এবং অন্যদের আবাসিকতা কেড়ে নেওয়াসহ নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আবাসিকতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং পনেরো টাকা জরিমানা করা হয়। তবে মুচলেকা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাম কাটা যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এতে ছাত্ররা ফুঁসে ওঠেন। ১৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে তাঁরা ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয় ক্যাম্পাসে পিকেটিং-এ নেতৃত্ব দেন করেন শেখ মুজিবুর রহমান, নাদেরা বেগম, আবদুর রহমান চৌধুরি, আবদুল হামিদ, মাহবুব হোসেন প্রমুখ। এদিকে ১৬ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুব আলীসহ ১৪-১৫ ছাত্র মুচলেকা দিয়ে ক্লাসে ফিরে যান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘তাঁর (নঈমুদ্দীন আহমদ) সাথে আমি অনেক রাগারাগি করলাম এবং ফিরে এসে নিজেই ছাত্রলীগের সভ্যদের খবর দিলাম, রাতে সভা করলাম। অনেকে উপস্থিত হলো। সভা করে এদের বহিষ্কার করা হলো এবং রাতের মধ্যে প্যাম্ফলেট ছাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত হলো।’
ছাত্রদের শাস্তি বাতিলের দাবিতে ১৭ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহ্বান করে। ঐদিন সকাল ৭.৪০টায় শেখ মুজিবুর রহমান, নাদেরা বেগম, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, আব্দুল আজিজ প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হাজির হন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করে মেইন গেট বন্ধ করে পিকেটিং শুরু করেন। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শাহ আজিজুর রহমান, মোখলেসুর রহমান, দলিলুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে আন্দোলনে বাধা দেন। এক পর্যায়ে সাধারণ ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। ঐদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে। দুপুরে শামসুল আলমের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, এম এ ওয়াদুদ, নাদেরা বেগম প্রমুখ। তাঁরা শাস্তি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ‘সাপ্তাহিক নও-বেলাল’ পত্রিকায় বলা হয়, ‘প্রায় দু’হাজার ছাত্র-ছাত্রী সেদিন বেলা বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।’
১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পলিত হয়। সকাল থেকেই ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করেন। এতে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, নাদেরা বেগম, এম এ ওয়াদুদ, শামসুল হুদা প্রমুখ। তাঁরা উপাচার্যের বাসভবনের দেয়াল টপকে ছাত্রদের সেখানে নিয়ে স্লোগান দেন ‘ছাত্রদের দমন চলবে না’, ‘ভাইস চ্যান্সেলর নেমে আসো’, ‘অন্যায় আদেশ প্রত্যাহার করো’। বিকেল পাঁচটায় তাঁর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে একটি প্রতিবাদসভা আয়োজন করেন। এতে বক্তব্য দেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং গোলাম মহিউদ্দিন। ঐদিন উপচার্যের বাসভবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্রদের শাস্তি বতিল না করায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্ররা রাতভর উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান-কর্মসূচি পালন করেন। তাঁরা ১৯ এপ্রিল দিনভর উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখলে বিকেলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপার বিরাট একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরের দিনও ধর্মঘট পালিত হয়। এদিন গ্রেফতার করা হয় অলি আহাদ, আবদুল মতিন, নিতাই গাঙ্গুলী, এনায়েত করিম, খালেক নেওয়াজ খান, অজিজ আহমদ, বাহাউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলন চলে। আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যুক্ত হন এবং তা ঢাকার বাইরেও বিস্তৃত হয়। তবে ছাত্রনেতৃবৃন্দের গ্রেফতার এবং পুলিশি নির্যাতনের মুখে আন্দোলন ধীরে ধীরে থেমে যায়। এক পর্যায়ে অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ মুক্তিলাভ করলেও শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাহাউদ্দিন চৌধুরীকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
পাকিস্তানি গেয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৪৯ সালের ৯ মে বিকাল ৫.৩০টায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে সমঝোতা করার প্রস্তাব দিলে তিনি ক্ষমা চাইবেন না বলে জানিয়ে দেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, তিনি মর্যাদাপূর্ণ সমঝোতার জন্য চারটি শর্ত দেন; শর্তগুলো ছিল- ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিঃশর্তভাবে শাস্তি প্রত্যাহার করতে হবে; ২. কর্মচারীদের আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে পূর্ববাংলায় যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করতে হবে; ৩. আর কাউকে অপরাধী করা যাবে না; ৪. কর্মচারী আন্দোলনের কারণে যেসব পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে তাঁকে যে শাস্তি প্রদান করা হয়, তা প্রত্যাহারে মুচলেকা প্রদান কিংবা ক্ষমা না চাওয়ায় এবং দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকায় বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। একই সঙ্গে অবসান ঘটে তাঁর ছাত্ররাজনীতির। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে কারাবন্দি অবস্থায়ই তাঁকে যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ ২৭ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মসে ঢাকার তাজমহল সিনেমাহলে তাঁর সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দবিরুল ইসলামকে সভাপতি এবং খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এটিই ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁর শেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই।’
রাজনৈতিক নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরবর্তীকালে তিনি বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি ১৯৪৭ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল মাস পর্যন্ত; অর্থাৎ ১ বছর ৪ মাস ১৮ দিন। এ সময়ের মধ্যে আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, জুলুম প্রতিরোধ আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন নেতৃত্বদানের মাধ্যমে ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি যে রাজনৈতিক গুণাবলি অর্জন করেন, তা তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের পথ সুগম করে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে রাজনীতিতে তাঁর যে অভিষেক ঘটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার ভিত আরও মজবুত হয়। বস্তুত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে যে বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল, তা-ই তাঁকে মুসলিম লীগের পশ্চাৎপদ, পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাপুষ্ট রাজনীতির উন্মেষ ও বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করে, যা ধাপে ধাপে এ অঞ্চলের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁকে প্রেরণা ও শক্তি জোগায়। বস্তুত, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার-সংগ্রাম, স্বাধিকার সংগ্রাম থেকে গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অমিত বিক্রমী তেজে দিয়ে আগলে রেখেছে। তিনি ক্রমে ‘মুজিব ভাই’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’র মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিলের দীর্ঘ ৭৪ বছর পর এবার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে মরণোত্তর ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে বিরল সম্মানে অভিষিক্ত করলো, যাতে স্থাপিত হলো ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়ের।
---
ড. এম আবদুল আলীম। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা পঁয়ত্রিশ। ঢাকা কলেজসহ দেশের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোতে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।