X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভবঘুরে জীবনের এক দিন ।। জর্জ অরওয়েল

অনুবাদ : মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:৫৫আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:৫৫

১৯০৩ সালের ২৫ জুন ভারতের বাংলা প্রদেশের মতিহারীতে জন্মগ্রহণ করেন এরিক আর্থার ব্লেয়ার অর্থাৎ জর্জ অরওয়েল। তার বাবা রিচার্ড ওয়ালমেসলে ব্লেয়ার ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আফিম বিভাগে একজন সাব-ডেপুটি এজেন্ট। অরওয়েলের বয়স যখন এক বছর তখন তার মা ইডা ব্লেয়ার তাকে এবং তার বড় বোন মার্জোরিকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান।
১৯২২ সালের অক্টোবরে অরওয়েল বার্মায় ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশে যোগ দিতে রেঙ্গুনে পৌঁছান এবং মান্দালয়ের পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে হাজির হন।
১৯২৭ সালে তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন এবং জুলাই মাসে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং বার্মায় আর ফিরে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২৭ সালের শরৎকাল থেকে তিনি ইউরোপের দরিদ্র এবং ঘরছাড়া মানুষের জীবনে নিজেকে নিমজ্জিত করেন। ছিন্নবস্ত্র পরিধান করে তিনি শ্রমিক এবং ভিক্ষুকদের মাঝে নিম্নমানের বাসস্থানে বসবাসের জন্য লন্ডনের ‘ইস্ট এন্ড’ এলাকায় যান এবং পেশাদার ভবঘুরেদের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।



প্রথমত, ভবঘুরে কী? (*১)

ভবঘুরে হলো একটি স্থানীয় ইংরেজ শ্রেণি। ভবঘুরেদের কতিপয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে : তারা কপর্দকহীন, ছিন্নবস্ত্র পরিধানকারী, দিনে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার হাঁটে এবং কখনো একই জায়গায় দুই রাত ঘুমায় না।

সংক্ষেপে বলা যায়, অন্যের দানে জীবনযাপন ও ঘুরে বেড়ানো একজন মানুষ, যে বছরের পর বছর পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করে। সে বহুবার ইংল্যান্ডের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বিচরণ করে।

দীনহীন শরীরটাকে ঢেকে রাখা তুচ্ছ ছিন্নবস্ত্রটি ছাড়া এই পৃথিবীতে তার কোনো সংসার নেই, চাকরি নেই, ঘর-বাড়ি নেই, কোনো সম্পদ নেই। তিনি সরকারের খরচে বসবাস করেন।

কেউ জানে না এরকম ভবঘুরে জীবনযাপন করা ব্যক্তিদের সংখ্যা কত।

ত্রিশ হাজার? পঞ্চাশ হাজার? বেকারত্ব যখন চরমে তখন ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সম্ভবত সংখ্যাটি এক লাখ হবে।

ভবঘুরে তার নিজের বিনোদনের জন্য ঘুরে বেড়ায় না বা পূর্বপুরুষদের যাযাবর প্রবৃত্তিও উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি। অনাহারে মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে থাকাই তার প্রথম এবং প্রধানতম চেষ্টা হয়ে ওঠে।

বিষয়টি উপলব্ধি করা কঠিন নয় যে, ইংল্যান্ডের অর্থনীতির দুরাবস্থার ফলেই ভবঘুরেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সুতরাং অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তাকে অবশ্যই সরকারি বা ব্যক্তিগত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নিতে হয়। তাকে সহায়তা করার জন্য কর্তৃপক্ষ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে, সেখানে তার মত নিঃস্ব মানুষেরা খাবার এবং আশ্রয় পেতে পারে।

আশ্রয়কেন্দ্র নামের এই সরাইখানাগুলো প্রত্যেকটি প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। কেউ মাসে একবারের বেশি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে পারে না। তাই যে-সব অন্তহীন ভবঘুরে তীর্থযাত্রীরা মাথার উপরকার ছাদের নিচে খেতে এবং ঘুমাতে ইচ্ছুক তাদের প্রতি রাতে নতুন নতুন সরাইখানা খুঁজতে বের হতে হয়।

ভবঘুরের অস্তিত্বের ব্যাখ্যাটি এরকমই। এখন দেখা যাক তারা কী ধরনের জীবনযাপন করে। এদের জীবনের শুধু একটি দিনের দিকে তাকানোই যথেষ্ট, কারণ বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের এই হতভাগ্য বাসিন্দাদের জন্য সব দিন একই রকম।

*
সকাল দশটার দিকে ভবঘুরেদের সরাইখানা থেকে বেরিয়ে পড়ার সময় তাদের একজনের পিছু নেওয়া যাক।

পরবর্তী সরাইখানা থেকে সে এখনও বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। সেই দূরত্বটুকু হেঁটে পার হতে তার সম্ভবত পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে এবং বিকেল তিনটা নাগাদ সে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।

পথিমধ্যে সে খুব একটা বিশ্রাম নেয় না, কারণ পুলিশের সন্দেহজনক চোখ ভবঘুরেদের গায়ে সেঁটে থাকে। তারা তাকে থামানোর চেষ্টা করতে পারে, এমনকি যে কোনও শহর বা গ্রাম থেকে তাকে বস্তাবন্দি করে দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থাও নিতে পারে। সেজন্য আমাদের লোকটি পথে কালবিলম্ব করবেই না।

আমরা যেমনটি বলেছি, বিকেল তিনটার দিকে সে সরাইখানায় এসে হাজির হয়। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার আগ পর্যন্ত সরাইখানার দ্বার খোলা হয় না। তিনটি ক্লান্তিকর ঘণ্টা তাকে অন্য ভবঘুরেদের সঙ্গে কাটাতে হয় কারণ ইতিমধ্যে তার মতো অন্যরাও সেখানে এসে জুটেছে। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, নোংরা এবং ছিন্নবস্ত্র পরিহিত ম্লান মুখের মানুষের জটলা প্রতি মিনিটে বেড়েই চলে। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক পেশার প্রতিনিধিত্বকারী শ-খানেক বেকার পুরুষ সেখানে এসে জড়ো হয়।

এই দলে ইংল্যান্ডের উত্তর দিকটায় ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের শিকার খনি শ্রমিক এবং তুলা-ধুনকরেরাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি কিন্তু সমস্ত পেশার দক্ষ ও অদক্ষ লোকেরাও রয়েছে।

তাদের বয়স? ষোল থেকে শুরু হয়ে সত্তর বছর পর্যন্ত।

আর লিঙ্গ ভেদে? প্রতি পঞ্চাশজন ভবঘুরের মধ্যে প্রায় দুইজন নারীও রয়েছেন।

ইতস্তত আহাম্মকের মতো অর্থহীন কথাবার্তা ও বকবক করে বেড়াচ্ছে সবাই। কিছু পুরুষ এতটাই দুর্বল এবং অথর্ব যে তারা কীভাবে কুড়ি কিলোমিটার হাঁটবে সেটা যেকোনো মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে পারে।

তাদের উদ্ভট, ছেঁড়া এবং গা ঘিনঘিন-করা নোংরা জামাকাপড় আপনার রুচিবোধকে আহত করবে।

তাদের মুখগুলো আপনাকে কতিপয় বন্য প্রাণীর মুখের কথা ভাবতে বাধ্য করবে। বিপজ্জনক না হলেও সেই মুখগুলো বিশ্রাম ও যত্নের অভাবে একযোগে বর্বর ও দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে।

*
সরাইখানার আশপাশে ঘাসের উপর শুয়ে বা ধুলোয় বসে তারা অপেক্ষা করতে থাকে। সবচেয়ে সাহসী ভবঘুরেরা কসাই বা রুটিওয়ালার চারপাশে কিছু খাবার কুড়ানোর আশায় ঘোরাঘুরি করে। তবে এটি বিপজ্জনক কারণ ভিক্ষা করা ইংল্যান্ডের আইনের বিরুদ্ধে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হয়। তখন এক অদ্ভুত কুবচনে অস্পষ্ট ভাষায় তাদের বাক্য বিনিময় চলে। ভবঘুরেদের বিশেষ ভাষাটি এমনই উদ্ভট বর্ণনামূলক শব্দ এবং বাক্যাংশে পূর্ণ যা কোনো অভিধানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। 

তারা ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের চারটি কোণ থেকে এসে জড়ো হয়েছে এবং একে অপরকে তাদের উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছে। পথে কাজ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার কোনো আশা ছেড়ে দিয়েই তারা গুলতানি করছে।

অবিরাম ছুটে চলতে চলতে পথিমধ্যে দেশের অন্য কোনো প্রান্তের সরাইখানায় ইতিপূর্বেও কতিপয় ভবঘুরের সাথে পরস্পরের সাক্ষাৎও হয়েছে।

পুনরায় ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ার আগে এই নগণ্য আশ্রয়কেন্দ্রে এবং জঘন্য সরাইখানাসমূহে হতভাগা এইসব ইংরেজ আগন্তক কয়েক ঘণ্টা সময়ের জন্য জড়ো হয়।

ভবঘুরেরা সবাই ধূমপান করে। যেহেতু সরাইখানার ভিতরে ধূমপান নিষিদ্ধ তাই তারা তাদের অপেক্ষার সময়গুলোকে সবচেয়ে বেশি এই কাজে লাগায়। প্রধানত রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের শেষাংশের তামাকই তাদের ধূমপানের একমাত্র অবলম্বন। এই তামাক তারা কাগজে মুড়িয়ে বা পুরোনো পাইপে ভরে নিয়ে ধূমপান করে।

পথিমধ্যে ভিক্ষাবৃত্তি বা শ্রমের মাধ্যমে কিছু অর্থ হাতে এলেই একজন ভবঘুরে প্রথমেই তামাক কেনার কথা ভাবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে ফুটপাথ বা রাস্তা থেকে কুড়ানো সিগারেটের শেষাংশ দিয়ে কাজ সারতে হয়। সরাইখানা শুধুমাত্র তাকে থাকতে দেয় এবং আহার জোগায়। অবশিষ্ট কাপড়, তামাক ইত্যাদির সংস্থান তার নিজেরই করতে হয়।

*
সরাইখানার দরজা খোলার সময় ঘনিয়ে আসে। ভবঘুরেরা প্রস্তুত হয় এবং বিশাল ভবনটির দেয়ালের পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শহর থেকে কিছুটা দূরবর্তী এলাকায় সস্তার হলুদ ঘনক ইট নির্মিত ভবনটিকে কারাগার বলে ভ্রম হতে পারে। (*২)

আরও কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর ভারী দ্বারসমূহ খুলে যায় এবং মানুষের পালটি ঢুকতে শুরু করে।

দ্বারগুলির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করার পর যেকোনো কারাগার এবং এই সরাইখানাগুলোর মধ্যেকার সাদৃশ্য আরও বেশি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে৷ একটি খালি মাঠের মাঝখানে উঁচু ইটের দেয়াল ঘেরা মূল ভবনটি দাঁড়িয়ে। সেখানে গতানুগতিক দেয়ালঘেরা একটি কক্ষ, একটি স্নানঘর, প্রশাসনিক অফিসঘর এবং ভোজনকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত সাজসজ্জাহীন কাঠের লম্বা বেঞ্চ পেতে রাখা ছোট একটি কক্ষ। এর সবটাই আপনার কল্পনার চেয়েও শ্রীহীন এবং দুর্ভাগ্যজনক।

কারাগারের পরিবেশ বিরাজিত সবখানে। উর্দিপরা কর্মকর্তারা ভবঘুরেদের তর্জনগর্জন করে শাসায় এবং তাদের ধাক্কাধাক্কি করে। ভবঘুরেরা তাদের সমস্ত অধিকার এবং সকল স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েই সরাইখানায় এসেছে- এই বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে তাদের একদম ভুল হয় না।

ভবঘুরেদের নাম এবং পেশা একটি রেজিস্টারে লেখা হয়। তারপর তাকে স্নান করানো হয় এবং তার জামাকাপড় ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর তাকে রাতের জন্য সরাইখানার একটি মোটা সুতির জামা দেওয়া হয়।

তার কাছে কোনো টাকা থেকে থাকলে তা জব্দ করা হয় কিন্তু দুই ফ্রাঙ্কের বেশি [চার পেনি] থাকার কথা স্বীকার করলে তাকে সরাইখানাতে আর আশ্রয় দেওয়া হয় না। তখন তাকে অন্য কোথাও একটি শোবার জায়গা খুঁজতে হয়।

এর ফলে দুই ফ্রাঙ্কের বেশি অর্থ আছে এমন স্বল্পসংখ্যক ভবঘুরে নিজের বুটের ভেতরে পায়ের তালুর নিজে কষ্টকরভাবে তাদের অর্থ লুকিয়ে রাখে। পুরো ব্যাপারটি সবার আড়ালেই করা হয় কারণ এই প্রতারণার জন্য তাকে কারাভোগ করতে হতে পারে।

যে-সব ভবঘুরের জামাকাপড় কেড়ে নেওয়া হয়েছে, স্নানের পর তারা সামান্য মার্জারিন মাখানো আধা পাউন্ড রুটি এবং আধা লিটার চা সহযোগে নৈশভোজ গ্রহণ করে।

ভবঘুরেদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এই পাউরুটিটি রীতিমতো উৎকট। ধূসর, যারপরনাই বাসি এবং বিশ্রী স্বাদের সেই রুটি খেয়ে যেকোনো মানুষেরই মনে হবে যে দূষিত গমের ময়দা থেকে এটি তৈরি করা হয়েছে।

এমনকি তস্য বিস্বাদ সেই চা পানের পর ভবঘুরেরা আনন্দই পায় কারণ সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই চা তাদেরকে উষ্ণতা এবং আরাম দেয়।

অরুচিকর হলেও সেই খাবারটি পাঁচ মিনিটের মধ্যে হজম হয়ে যায়। এর পরে রাত কাটানোর জন্য ভবঘুরেদের সেই খুপড়িগুলোতে ঢোকার হুকুম দেওয়া হয়।

প্রায় বারো ফুট বাই ছয় ফুট আয়তনের এই খুপরি ঘরগুলো ইট বা পাথরের বাস্তব হাজত ঘর। কোন কৃত্রিম আলো নেই– দেয়ালের বেশ উপরের একটি সংকীর্ণ গরাদের কুলুঙ্গি আলোর একমাত্র উৎস। রক্ষীরা যাতে বন্দীদের উপর নজর রাখতে পারে সেইজন্য দরজায় একটি গুপ্ত ফুটো করা থাকে।

কখনও কখনও এসব খুপড়িতে একটি বিছানা থাকে তবে সাধারণত ভবঘুরেদের শুধুমাত্র তিনটি কম্বল দিয়ে সেই খুপড়ির মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমাতে হয়।

প্রায়শই কোন বালিশ থাকে না এবং সেই কারণে দুর্ভাগা বাসিন্দাগণকে নিজের পরিধেয় কোটকে এক ধরনের কুশনে মুড়িয়ে তাদের মাথার নিচে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।

স্বভাবত অতিশয় হিমশীতল সেই খুপড়িটিতে শীতের তীব্রতার বিরুদ্ধে অতি ব্যবহারে পাতলা হয়ে যাওয়া কম্বলগুলো কোনও সুরক্ষা দিতে পারে না।

ভবঘুরেরা নিজ নিজ খুপড়িতে ঢোকার সাথে সাথে বাইরের থেকে দরজাগুলো শক্তভাবে এঁটে দেওয়া হয়। পরের দিন সকাল সাতটা পর্যন্ত দরজাগুলো আর খোলা হয় না।

সাধারণত প্রতিটি খুপড়িতে দুজন বাসিন্দা থাকতে পারে। নিছক একটি সুতির শার্ট এবং তিনটি পাতলা কম্বলকে সম্বল করে ক্লান্তিকর বারোটি ঘণ্টা ছোট্ট বন্দিশালার দেওয়ালের ভেতরে বেচারা হতভাগারা ঠাণ্ডায় কাঁপে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যহীনতায় নিষ্ঠুরভাবে ভোগে।

এসব স্থান প্রায় সবসময়ই ছারপোকায় ভরা থাকে, ফলে ভবঘুরেরা ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়। কীটের দংশনে জর্জরিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে ঘুমের জন্য বৃথা অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপচয় করে।

যদিওবা কয়েক মিনিটের জন্য ঘুম আসে কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই শক্ত মেঝেতে ঘুমানোর অস্বস্তি তাকে আবার জাগিয়ে দেয়।

পনেরো বা বিশ বছর ধরে এইরকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত কূটবুদ্ধি সম্পন্ন বৃদ্ধ ভবঘুরেরা স্বভাবে দার্শনিক হয়ে ওঠে, তাই তারা বকবক করে রাত কাটায়। পরের দিন তারা দুই-এক ঘণ্টার জন্য হয়ত মাঠে কোনো বৃক্ষের ছায়াতলে বিশ্রাম নেয়। সেই বিশ্রাম তাদের কাছে সরাইখানার চেয়েও অধিকতর আরামদায়ক বলে মনে হয়। কিন্তু তরুণ ভবঘুরেরা এখনও এই সংগ্রাম এবং অন্ধকারের বিভীষিকার সাথে অভ্যস্ত হওয়ার মতো শক্তি অর্জন করেনি। তাই ভোরের আলোয় তাদের মুক্তির জন্য তারা অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করছে।

তারপর অবশেষে যখন সূর্যের আলো তাদের বন্দিশালায় দ্যুতি ছড়াতে শুরু করে তখন তারা বিষণ্নতা এবং হতাশার সাথে ঠিক আগের দিনের মতো আরেকটি দিনকে দৃশ্যমান হতে দেখে।

অবশেষে খুপড়িগুলো খুলে দেওয়া হয়। চিকিৎসকের পরিদর্শনের সময় ঘনিয়ে আসে, প্রকৃতপক্ষে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ভবঘুরেদের মুক্তি নেই।

ডাক্তার সাধারণত দেরি করে আসেন বলেই এই পরিদর্শনের জন্য ভবঘুরেদের অপেক্ষা করতে হয়। তারা একটি বারান্দায় অর্ধ-নগ্ন শরীরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তখনই তাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

কী দেহ আর কী মুখচ্ছবি!

তাদের অনেকেরই রয়েছে জন্মগত ত্রুটি। বেশ কয়েকজন হার্নিয়া বা অন্ত্রবৃদ্ধি রোগে ভোগার কারণে এই রোগে ব্যবহৃত লেংটি পরে আছে। এদের অধিকাংশেরই বিকৃত হয়ে যাওয়া পা দুটো বেমানান বুটজুতো পরে দীর্ঘ সময় পথচলার ফলে ঘায়ে জর্জরিত। বৃদ্ধ শরীরগুলোতে হাড় এবং চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই। ঝুলে যাওয়া পেশির হতভাগা চেহারার এই লোকগুলোর ভাগ্যে বছরের কোনোদিনই একবেলা মানানসই খাবার জোটে না।

তাদের ক্ষয়প্রাপ্ত চেহারার অকাল বার্ধক্য, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি সমেত পুরো শরীর তাদের খাদ্যাভাব এবং নির্ঘুম জীবনের সাক্ষ্য দেয়।

কিন্তু এরপর ডাক্তার আসেন, তার পরিদর্শন যতখানি দ্রুত ততটাই ভাসাভাসা। মোটকথা কোনো ভবঘুরের শরীরে গুটিবসন্তের লক্ষণ আছে কিনা সেটি শনাক্ত করাই কেবলমাত্র এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য।

ডাক্তার দ্রুততার সাথে উপরে নিচে, সামনে পিছনে প্রত্যেক ভবঘুরের দিকে চোখ বুলিয়ে যান।

বর্তমানে তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো রোগে ভুগছে। তাদের মধ্যে কতক প্রায় পুরোপুরি নির্বোধ যারা নিজেদের যত্ন নিতে একদমই অক্ষম। তা সত্ত্বেও যতদিন তারা গুটিবসন্তের ভয়ংকর লক্ষণমুক্ত থাকবে ততদিন তারা মুক্তির স্বাদ পাবে।

যতক্ষণ তারা কোনও সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের স্বাস্থ্যের ভালো বা মন্দ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো তোয়াক্কা করে না।

ডাক্তারের পরিদর্শনের পরে ভবঘুরেরা আবার যে যার পোশাক পরে নেয়। তারপর বিলাতের জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে দরিদ্র দূর্ভাগাদের পরিধেয় পোশাক দিনের শীতল আলোয় সত্যিই স্পষ্ট দেখতে পাবেন।

দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে সংগৃহীত এই পোশাক নামের বিশ্রী ন্যাকড়াসমূহ ডাস্টবিনে নিক্ষেপের জন্যই বেশি উপযুক্ত। বিদঘুটে, বেমানান, অতি দীর্ঘ, খুব খাটো, খুব বড় বা খুব ছোট- এমন সব উদ্ভট পোশাক দেখে অন্য কোনও পরিস্থিতিতে আপনার হাসির উদ্রেক হতে পারে। তবে এই অবস্থায় তাদের দেখে আপনি গভীর সমবেদনা অনুভব করবেন।

যতদূর সম্ভব সব ধরনের তাপ্পি দিয়ে পোশাকগুলো মেরামত করা হয়েছে। অনুপস্থিত বোতামগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে গুনা। নোংরা ময়লা জমে ফুটো হওয়া অন্তর্বাসগুলো বড্ড কুৎসিত দেখতে।

তাদের মধ্যে কারোর আবার কোনো অন্তর্বাসই নেই। অনেকের মোজাও নেই তাই পায়ের আঙ্গুলগুলোকে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে নগ্ন পা গলিয়ে দেয় রোদ-বৃষ্টিতে শক্ত হয়ে যাওয়া অনমনীয় জুতোর মধ্যে।

ভবঘুরেদের প্রস্তুত হওয়ার দৃশ্যটি রতিমতো ভীতিপ্রদ।

পোশাক পরিধান করার পরই ভবঘুরেরা আগেরদিন রাতের খাবারের মতো একইরকমভাবে তাদের প্রাতরাশ গ্রহণ করে।

তারপর তারা সরাইখানার উঠানে সৈন্যদের মতো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে রক্ষীরা তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়।

কেউ মেঝে ধোয়ামোছা করে, কেউ কাঠ কাটে, কয়লা ভাঙে এবং অন্যান্য কাজ করতে থাকে। বেলা দশটা নাগাদ চলে যাওয়ার সংকেত দেওয়া অবধি এইরকম চলতে থাকে।

আগেরদিন সন্ধ্যায় জব্দ করা ব্যক্তিগত সম্পদ তাদেরকে ফেরত দেওয়া হয়। এর সাথে তাদের দুপুরের খাবার হিসেবে আধা পাউন্ড পাউরুটি এবং এক টুকরো পনির দেওয়া হয় অথবা প্রায় কদাচিৎ কোনো নির্দিষ্ট ক্যাফেতে রুটি এবং চায়ের জন্য বিনিময়যোগ্য তিন ফ্রাঙ্ক মূল্যের [ছয় পেনি] একটি টিকিট দেওয়া হয়।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হতভাগ্য এবং নোংরা নিঃস্ব মানুষের ভিড়কে শিথিল করার জন্য বেলা দশটার একটু পরে সরাইখানার দ্বার খুলে দেয়া হয়।

প্রত্যেকে একটি নতুন সরাইখানার সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে ওঠে যেখানে তার সাথে ঠিক একইভাবে আচরণ করা হবে।

আর সেই সাথে মাস, বছর ও কয়েক দশক ধরে ভবঘুরেরা হয়ত অন্য কোনো জীবনধারণ কৌশলের খোঁজও করবে না।

*
উপসংহারে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, প্রত্যেক ভবঘুরের খাবার বলতে সাকুল্যে সামান্য মার্জারিন ও পনিরসহ প্রায় ৭৫০ গ্রাম বা ২ পাউন্ড রুটি এবং দিনে এক পাঁইট চা। একজন মানুষের জন্য খাবারের পরিমাণটি স্পষ্টতই অপর্যাপ্ত, বিশেষ করে হররোজ যাকে বিশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়।

খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে পোশাক, তামাক এবং তার প্রয়োজনীয় এমন সহস্র জিনিসের তাগিদে ভবঘুরেকে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে হয়। অগত্যা যখন সে কাজ খুঁজে পায় না (এবং সে কমসংখ্যক দিনই কাজ পায়) তখন ভিক্ষা বা চুরিই হয়ে ওঠে তার অবলম্বন।

এখন ভিক্ষা করা ইংল্যান্ডে আইনের পরিপন্থি এবং এই কারণে অনেক ভবঘুরেকে মহামহিম রাজার কারাগারসমূহের অতিথি হতে হয়েছে।

এটি একটি দুষ্ট চক্র, ভিক্ষা না করলে সে অনাহারে মরবে আর যদি সে ভিক্ষা করে তাহলে আইন ভঙ্গের অপরাধে সাজা পাবে।

অত্যন্ত অবমাননাকর এবং হতাশাজনক এই ভবঘুরে জীবন খুব অল্প সময়ের মধ্যে একজন সক্রিয় মানুষকেও বেকার এবং পরাশ্রয়ী করে তুলতে পারে।

তাছাড়া এটা নিদারুণভাবে একঘেয়ে। অপ্রত্যাশিতভাবে কয়েক শিলিং উপার্জন ভবঘুরের একমাত্র আনন্দ। সেই উপার্জন তাদের একবেলা ভরপেট খাওয়া বা মদ্যপানে মাতলামীর সুযোগ এনে দেয়।

ভবঘুরেরা নারী সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। অল্প সংখ্যক নারীরাই ভবঘুরে হয়ে থাকেন। তাদের অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান বোনদের কাছে ভবঘুরেরা অবজ্ঞার পাত্র মাত্র। তাই সমকামিতার ন্যায় পাপাচার এইসব শাশ্বত পথচারীদের অজানা নয়।

কোনোরকম অপরাধ না করেও একজন ভবঘুরে কেবল বেকারত্বের শিকার হওয়ার কারণে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধীর চেয়েও নিকৃষ্টভাবে জীবনযাপন করার জন্য নিন্দিত হয়। বাইরের চেহারায় স্বাধীনতার ছাপ থাকলেও সে এমন একজন দাস যার অবস্থা নিদারুণ দাসত্বের চেয়েও করুণ।

যখন আমরা বিলেতের এরকম হাজার হাজার পুরুষের করুণ নিয়তির কথা চিন্তা করি তখন অনস্বীকার্য উপসংহার দাঁড়ায় যে, সমাজ তাকে তার অবশিষ্ট জীবন কারাগারে আটকে রেখে তার সাথে আরও সদয় আচরণ করতে পারে। সেখানে সে অন্তত তুলনামূলক স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করবে।

এরিক আর্থার ব্লেয়ার (*৩)
(জ্যানেট পার্সিভাল এবং ইয়ান উইলিসন ফরাসি থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন।)


টীকা:
(*১) এই নিবন্ধটি ১৯২৮ এবং ১৯২৯ সালে ‘লে প্রোগ্রেস সিভিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইংল্যান্ডের নাগরিক অগ্রগতি : ব্রিটিশ শ্রমিকদের সঙ্কটাপন্ন দশা’ শীর্ষক তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনের একটি। জানা যায়, একসময় প্রায় ৭৫০টি ভবঘুরে সরাইখানা ছিল। সরকারি আদেশে ১৯৯৬ সালে শেষটি (গ্লাসগোর কাছে বিশপব্রিগসে) বন্ধ করে দেওয়া হয়।

(*২) হাস্যকর কিছু প্রাক্তন ওয়ার্ক হাউস এখন বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্লবোরো শহরে।

(*৩) লেখক নাম 'জর্জ অরওয়েল', প্রথম ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’ গ্রন্থের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। বিবিসিতে অরওয়েল ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল অবধি এরিক আর্থার ব্লেয়ার নামে পরিচিত ছিলেন। চিঠিপত্রের আদান প্রদানে তিনি নিজের স্বাক্ষর করার সময় এরিক বা জর্জ হিসাবে করতেন। তবে এমনও দেখা গেছে, তার কোনো সচিব কোনো চিঠি টাইপ করলে তিনি মুদ্রিত ‘জর্জ অরওয়েল’ লেখাটির উপর ‘এরিক ব্লেয়ার’ নামেই স্বাক্ষর করতেন।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিফিনের টাকা জমিয়ে দুই হাজার পথচারীকে স্যালাইন-পানি দিলেন ৫ শিক্ষার্থী
টিফিনের টাকা জমিয়ে দুই হাজার পথচারীকে স্যালাইন-পানি দিলেন ৫ শিক্ষার্থী
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না: সালেহউদ্দিন আহমেদ
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না: সালেহউদ্দিন আহমেদ
ক্লপের সঙ্গে টাচলাইনে মতবিরোধ নিয়ে সালাহ, ‘কথা বললে আগুন লাগবে’
ক্লপের সঙ্গে টাচলাইনে মতবিরোধ নিয়ে সালাহ, ‘কথা বললে আগুন লাগবে’
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু