X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবসময় কমপ্লিট আর্টের কথা ভেবেছি : মোস্তাফিজ কারিগর

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মুহম্মদ মুস্তফা
১৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:১৭আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:১৭

মোস্তাফিজ কারিগর ‘বস্তুবর্গ’ পাণ্ডুলিপির জন্য এবছর পেলেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৬। ১৯৮৬ সালের ১৪ আগস্ট তিনি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন। শৈশব কৈশোর কুষ্টিয়া শহরে। বাবা চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। চিত্রকলা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগ থেকে। খুব সামান্যকাল একটা পত্রিকা ও এডভার্টাইজমেন্ট ফার্মে চাকরি। বর্তমানে পেশায় চিত্রশিল্পী। প্রকাশিত বই: নৌকাখণ্ডে দেবীর লাল, কবিতা, ২০০৯। শালঘর মধুয়া, ছোটগল্প, ২০১৩। ছবি আঁকার জাদু, শিশুতোষ ২০১৬। চিত্রকলা প্রদর্শনী: সাইক্লিং ইন সার্কেল, অঁলিয়স ফ্রসেস, লা গ্যালারি, ঢাকা, ২০১২। লাইফ ইন লাইট, গ্যালারি ডাউনটাউন, ইউনিভার্সিটি অব টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৫। হেয়ার এন্ড নাও, এডিথ ডেভিস গ্যালারি, রোজ সেন্টার, মরিসটাউন, টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৫। এছাড়াও কিছু দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ বাংলাদেশ ও জাপানে।


মোস্তাফিজ কারিগর
পুরস্কার পাবার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : নিশ্চয়ই খুব আনন্দের বিষয় আমার জন্যে। পুরস্কার একটা স্বীকৃতি, আরো বড় বড় কাজ করার অনুপ্রেরণা। সাহস। এমন একটা স্বীকৃতি যা আমার লেখক জীবনের জন্যে খুব ফলপ্রসূ হবে বলে ভাবছি। কেননা, এখন আমার ভেতরে আরো একটা নতুন শক্তিকে আমি নিজেই আবিষ্কার করতে পারলাম, সবচেয়ে বড় পুরস্কার সেটাই। একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলার দৌড় দেওয়ার দমটা যে আমার ভেতরেই ছিল, এটা আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়েছে। এর জন্যে যে শ্রমের দরকার, সময়ের দরকার- ঢাকার নির্মম সংগ্রামে ভেসে যাওয়া জীবন থেকে তা আলাদা করে বের করতে পেরেছি, আনন্দ এই।
আপনি ছবি আঁকেন, চিত্রশিল্পী হিসেবেই আপনার পরিচয় গড়ে উঠেছে এখন ঔপন্যাসিক পরিচয়কে মানুষ কীভাবে দেখবেন?
উত্তর : হ্যাঁ, এটা একটা নতুন সংযোজন। সেটা আমার জন্যে আনন্দের। আসলে ঔপন্যাসিক বা চিত্রশিল্পী পরিচয়টা হয়তো সামাজিক একটা অর্জন। আমার কাছে জরুরী কাজটা করে যাওয়া। কাজ ছাড়া এই সমস্ত পরিচয়তো আর কোন আনন্দ বয়ে আনে না। আমার হাতভর্তি কাজ আছে, আমি চালিয়ে যেতে পারছি লেখা বা আঁকা, আমার নিজের কাছে নিজের পরিচয় সেটাই, অন্যরা যে যেভাবে বিশেষায়িত করে, করবে। চিত্রশিল্পী হিসেবে আমাকে যারা এতদিন জানতেন, তাদের কাছে ব্যাপারটা নতুন লাগবে। সেটাও মজার বিষয়। উপন্যাসটা পড়ার পরে তারাই বলবেন, আদৌও ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার পথে হাটতে পেড়েছি কিনা বা পারবো কি না।
‘বস্তুবর্গ’ উপন্যাস কী নিয়ে লেখা?
উত্তর : উপন্যাসের প্রধান বিষয় হিসেবে কাজ করেছে- পুঁজির লাম্পট্য আর অসুস্থ রাজনীতির খোপের ভেতর আটকে পড়ে পচে যেতে থাকা মধ্যবৃত্ত ও ক্রমশ উচ্চবৃত্ত মানুষের হেরে যাওয়া জীবন, ক্ষয় হয়ে যাওয়া জীবন। এই কসমোপলিটানে মানুষের জীবনের অসুস্থতার কথা- যার পেছনে অনেক দূর থেকেই নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছে পুঁজি। যা আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, উন্মূল করে দিচ্ছে আবহমান ধর্মীয় চিন্তাকে। ফলত, অস্থিরতা। জঙ্গিবাদ। মিথ্যে ক্ষমতাচর্চা। এখানে ব্যক্তি বলে কিছু থাকছে না, ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে আমাদের বিশ্বাস। একটা স্যাতলা পরা বস্তুতে সেপ নিয়ে চলেছি আমরা। আমাদের নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দর্শন থাকছে না, না ধর্মীও না মানবিক দর্শন। নিজেকে, কেবল নিজেকে টিকিয়ে রাখার একটা মিথ্যে যুদ্ধ। একটা মিথ্যে স্ট্যাটাস, মিথ্যে প্রতিযোগিতা। মানুষ কখনো একা বাঁচে! আমাদের সকল সংগবদ্ধতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে একটা সিস্টেম। মিথ্যে প্রযুক্তি, মিথ্যে উন্নয়ন- যার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ, সম্পর্ক, মূল্যবোধ, বিশ্বাস। এখানে এখন পরিবার বলেও কিছু থাকছে না। এই বিচ্ছিন্নতা আমাকে তাড়িত করেছে লেখাটা লিখতে। মূলত ব্যক্তির নিজস্ব পরাজয়, যা একত্রিত হয়ে একটা বিরাট কমিউনিটির সংকটে রূপান্তরতি হচ্ছে, ভাবনাটা সেখানে- কি এমন শক্তি আছে এসবের পেছনে! আমরা বুঝছি, জানছি- যানজটের ভেতরে বসে বসে এক একটা বর্গের ভেতরে আটকে যাচ্ছি। রাস্তায় ধর্ম নিয়ে কথা বলা যাবে না, রাজনীতি নিয়ে না। বাসের জানালার মতো ছোট হয়ে আসছে সব- যার বাইরে কিলবিল করছে ম্যাজিক, মানুষের মুখোশ।
‘বস্তুবর্গ’ লেখার শ্রম সম্পর্কে জানতে চাই- কতদিনে কীভাবে লিখলেন?
উত্তর : আসলে এটা আমার জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। মাসখানিকের মধ্যে লেখাটা নামিয়ে ফেলার দরকার ছিলো। ঠিক সেভাবেই রাত-দিন। ঘুম থেকে উঠে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে টানা লিখেছি। কোন কোন দিন সমস্ত দিন ধরে লিখেছি। বাড়ির লোকজনকে বলেছিলাম- আমাকে মাখখানিক ভুলে যেতে, সংসারের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবো না। সহযোগিতা পেয়েছি এ বিষয়ে। এতোগুলো শব্দ ফাউন্টেইন পেনে টানা লিখে ওঠাটা আমার জন্যে ছিলো বিরাট আনন্দের। এর ভেতরে কোন ছবিও আঁকতে পারিনি। প্রফেশনালি খুব জটিলতার পড়ে যাচ্ছিলাম। এগুলো মাথায় ঝেকে বসছিল। সেসব দস্যু চিন্তাকে দুমড়ে-মুচরে জার্নিটা পেরোনোর পর খুব শান্তি হয়েছিল। একটা উপন্যাস- যেনো প্রবল শীতের মৌসুমে বড় সর নদী সাঁতরে পেরোনো। অনেকগুলো এবরো-খেবরো রাস্তা পারি দিয়ে অনেক বছর পর মা বা প্রেমিকার কাছে আসা, এমনই যুদ্ধ, এমনই আনন্দ।
ছোটগল্পের বই ‘শালঘর মধুয়া’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে- সে বই সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : এই বইয়ের প্রথম গল্প- ‘একটি সচিত্র ধারাপাত’, লিখেছিলাম আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে, কুষ্টিয়ায় বসে। তখন সারা কুষ্টিয়া একটা নীল সাইকেলে করে টই টই করে বেড়াতাম। বাবা আর আমি যৌথভাবে সাইকেলটা কিনেছিলাম। বাবার বেতনের কিছু অংশ আর আমার টিউশনির টাকা এক করে। সাইকেলটা এখন বৃষ্টি-বাতাস-রোদে জং ধরে ধরে ক্ষয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার বাড়ির ছাঁদে, ছুটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটার ক্ষয়ে যাওয়া দেখি- আমার গল্পগুলো হয়ে ওঠার সাথে ঐ সাইকেলটা জড়িয়ে আছে। মিলপাড়ার মোহিনী মিল, ছেউরিয়া, বাঁশগ্রাম, শালঘর মধুয়ার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কেনী সাহেবের নীলকুঠি, শিলাইদহ, কুমারখালি- সাইকেল দাবড়ে বেড়িয়েছি। সেই টই টই করে ঘোরাঘুরির জন্যে ‘শালঘর মধুয়া’ গল্পটা লিখতে পারলাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলাতে ভর্তি হয়ে গেছি। ‘উত্তরপুরুষ’ গল্পের পেক্ষাপট ও চরিত্রও কুষ্টিয়ার, মাইক্রোক্রেডিট এখানে ডোমিনেট করল। ‘ঘা’ গল্পটা ঢাকার, আজিমপুর কবরস্থানের অন্ধমালি ও তার ছেলের; সাথে ওয়ানইলেভেনের দিনগুলো, বিডিয়ার বিদ্রোহ। আর আমার খুব কাছের এক কমরেড বন্ধুকে নিয়ে ‘গন্ধ’ গল্পটা। যে একদা কমরেড, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ছাত্র- ঢাকায় এসে তার যুদ্ধটা, একটা ভাল চাকরি, ক্রমে হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক বিশ্বাস এইসব।
আপনি নিয়মিত কবিতাচর্চাও করেন, বইও প্রকাশিত হয়েছে, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখলেন- এত মাধ্যমে কাজ করে কোন ক্ষেত্রে আপনি স্বচ্ছন্দ বেশি অনুভব করেন?
উত্তর : আমি আসলে সবসময় কমপ্লিট আর্টের কথা ভেবেছি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা- সব মিলে তো একটাই কাজ। মাধ্যমটা আলাদা।
কথাসাহিত্য পঠনপাঠন সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার প্রিয় লেখক কে বা কারা?
উত্তর : এক জীবনে কতটাই বা পড়া যায়! আরো সকলের মতোই হয়তো আমারও সমরেশ মজুমদারের কালবেলা-কালপুরুষ দিয়ে শুরু। খুব সামান্য হুমায়ুন আহমেদ। সে সময় কুষ্টিয়ার এক স্যাঁতসেতে মেসবাড়ির মধ্যে পরিচয় ঋপণ পরামানিকের সাথে, ক্রমে বন্ধুত্ব। মেসবাড়িতে ঋপনের ঐ খুপরি ঘরটার ভেতরে- মেঝেতে, চৌকিতে এলোমেলো গাদা হয়ে থাকা অজস্র বই, লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রিকা। আমার নতুন পৃথিবী হলো- ক্রমে হাতে উঠে এলো ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহিরের ‘ডলু নদীর হাওয়া’, মামুন হুসাইন, মনিরা কায়েস, আবুবকর সিদ্দিক, শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। ক্রমেই মহাশ্বেতা, সতীনাথ, অভিজিৎ সেন। পেয়ে গেলাম কমলকুমার, কলেজের প্রথম বর্ষেই পড়তে পেড়েছিলাম ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া শূক’। পেলাম দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ- ‘মহিশকূড়ার উপকথা’, ‘মধু সাধুকা’। তখন খুব আলোড়িত ছিলাম মামুন হুসাইন দ্বারা। তাঁর ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’, ‘জয়ের হাতে সাবান’, ‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’, ‘নিক্রোপলিস’- এইসব। অধুনালুপ্ত আজকের কাগজের সুবর্ণরেখাতে মনিরা কায়েসের দীর্ঘ গল্পগুলির জন্যে অপেক্ষায় থাকতাম। সম্ভবত শহীদুল জহির, মনিরা কায়েস আর মামুন হুসাইনের প্রভাবই ছিলো আমার গল্পগুলো দীর্ঘ হয়ে ওঠার পেছনে। পরে ঢাকা জীবনে এসে আরো আরো মহাজনদের লেখা- ইতালো কালভিনো, কাফকা, চিনুয়া আচেবে, আমোস টুটুওলা, মার্কেস পড়েছি যতদূর সম্ভব- আর তাঁকে দ্বারা আন্দোলিত হলাম সবচেয়ে বেশি। খুব আপ্লুত হয়ে পড়েছি সাদাত হাসান মান্টো। হাংরির গদ্যকার বাসুদেব দাসগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’, ‘খেলাধুলা’ আরেকটা দুয়ার তৈরী করল। কিছুদিন আগে আরেকজন গদ্যকারের খোঁজ- কৃষ্ণগোপাল মল্লিক- যার গদ্য বাংলাভাষার অন্যপথ। এখন আছি কমল চক্রবর্তীকে নিয়ে, তাঁর গদ্যই এখন আমাকে ঘিরে আছে, ডুবে আছি তাঁর ‘ব্রম্মভার্গব পুরাণে’।

আমাকে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

উত্তর : আপনাকেও।





 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা ২ মে
আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা ২ মে
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজ আদায়
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজ আদায়
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ
ফেসবুক স্টোরিতে লালনের গান, আটক ব্যক্তির জামিন
ফেসবুক স্টোরিতে লালনের গান, আটক ব্যক্তির জামিন
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ