২৯ অক্টোবর সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রফেসর সৈয়দ আকরম হোসেন-এর উত্তরার বাসভবনে তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা হয়। সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবারের সময়টুকু বাদে টানা তিন ঘণ্টার কথাবার্তায় তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর শিক্ষকতা জীবন থেকে শুরু করে সাহিত্যচিন্তা, শিল্পভাবনা, গবেষণা, সম্পাদনা, রবীন্দ্র-নজরুল বিচারসহ জীবনবোধের অনালোকিত অনেক প্রান্ত। সামান্য কিছু পুনরাবৃত্তিমূলক প্রসঙ্গ বাদে দিবসের পুরো কথপোকথনটিই পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন- সরকার আমিন ও অনু হোসেন। আজ তাঁর শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।
সরকার আমিন : ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু; ২০১০ সালে আপনি শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। যদিও আপনি এখনো সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। আমাদের প্রথম প্রশ্ন দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর আপনি শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতা জীবনে আপনার সন্তুষ্টি কী ছিল, আর অতৃপ্তিই বা কী ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমি স্বনির্বাচিত শিক্ষক। -আমি রাজনীতিবিদ হতে পারতাম, নাট্যশিল্পী হতে পারতাম, ব্যবসায়ী হতে পারতাম- কিন্তু আমি শিক্ষক হতে চেয়েছি, এবং তাই হয়েছি। সুতরাং আমি পরিপূর্ণভাবেই আনন্দিত এবং নিজেকে অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে সার্থক বলে মনে করি। আর অতৃপ্তির দিক? মানুষের সব স্বপ্ন তো আর যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না! অপূর্ণতা আর অতৃপ্তি এক কথা নয়। অপূর্ণ আছি বলেই আমি প্রতিনিয়ত পরিপূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি এখনো হচ্ছি।
সরকার আমিন : শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : শিক্ষকতা পেশা বাছার প্রথম কারণ হল আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, যেকোনো অর্থেই, দল বা সংগঠন ছাড়া কিছু সম্ভব নয়। কিন্তু একটি পেশা- শিক্ষকতা, যেখানে একাই একটি প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে-ওঠা যায়, কিংবা গড়ে তোলা যায় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, সে কারণেই।
সরকার আমিন : এই শিক্ষকতা পেশার পেছনে অনুপ্রেরণাটা কী ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : এভাবে বলা যাবে না। কারণ আমি কী করব নিজেই জানতাম না। যেমন ধর, আমি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এটা ছিল আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। আমি বৃহত্তর যশোর জেলার ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম। তখন মনে হতো রাজনীতিই আরাধ্য। তারপরে যখন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হলাম, তখন ভাবতাম- সংস্কৃতিকর্মী হব, নাটক লিখব, ফিল্ম তৈরি করব- এসবই ছিল মুখ্য। তারপর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিষয়টা ঘটল তা হল, ১৯৬৫ সালেই বলা যেতে পারে, এ-দেশে চূড়ান্তভাবে প্রগতিশীল রাজনীতি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা হল মস্কোপন্থী আর একটা পিকিংপন্থী [তখন এমনই উচ্চারণ ছিল]। আমার মনে হল, ঐ যে বললাম, আমার একার পক্ষে একটি প্রতিষ্ঠান হওয়া সম্ভব নয়। তখন উপলব্ধি করলাম সেটা শিক্ষকতাতেই সম্ভব। সে-সময় আমি যশোর ত্যাগ করে, ঢাকায় এলাম। উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। হঠাৎ মুনীর চৌধুরী স্যারের সঙ্গে দেখা। মুনীর স্যারের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। স্যার বললেন ‘আরে তুমি পাশ করেছ?’ বিস্ময়কর! রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রমের ফলে আমার পক্ষে পাশ করা অস্বাভাবিক ছিল বলে মনে করতেন অনেকেই। বললেন, তাড়াতাড়ি এসো ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। আমি বললাম স্যার, আমি বংলায় না, দর্শনে ভর্তি হব। উনি বললেন, যাও পরীক্ষা দাও। পরীক্ষা দিলাম, ভালো হল, ভর্তি হলাম। তারপরে সিদ্ধান্ত নিলাম যে এটিই আমার পথ। ব্যাপারটা এত সহজে হয়নি। পারিবারিক, বিত্তদম্ভী পরিবেশের বিরুদ্ধে আমাকে দাঁড়াতে হয়েছে, প্রতিরোধ করতে হয়েছে। তার পর একসময় পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। বিভাগে যোগদান করলাম।
সরকার আমিন : তার মানে মুনীর চৌধুরী স্যারের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : মুনীর চৌধুরী স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৬২ সালে। তখন আমরা যশোরে ‘কপোতাক্ষ’ পত্রিকার প্রযোজনায়, আমার স্যার কবি আজীজুল হক এবং আমরা আরো অনেকে মিলে একটা সাহিত্য সম্মেলন করেছিলাম। সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং উপস্থিত ছিলেন মুনীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান [তাঁর ‘রৌদ্র করোটিতে’ সদ্য প্রকাশিত হয়েছে] এবং অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এঁদেরকে নিয়ে সেমিনার হল। ওখানে আমি মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘কবর’ মঞ্চস্থ করালাম বি. সরকার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে। সেটা আমি পরিচালনাও করেছিলাম। আমি মুর্দা ফকিরের ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করি। আমরা আমাদের বিরাট মঞ্চটি ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। গোরস্থানের দৃশ্যটি তৈরি হয়েছিল বিশ্বস্তভাবে। মুনীর স্যার এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি আমাকে বলেছিলেন তুমি ঢাকায় এসে বাংলা পড়বে অবশ্যই। যাহোক শেষ পর্যন্ত সত্য হল স্যারের ইচ্ছা। আমি বাংলায় পড়লাম [হাসি]। আমার সৌভাগ্য ওঁদের আশীর্বাদ নিয়েই আমি বাংলা বিভাগে যোগদান করলাম ১৯৬৮ সালের ২৫ জুলাই। তখন অধ্যক্ষ ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই।
সরকার আমিন : রোটেশন ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : না, তিন বছর মেয়াদি যে বিভাগীয় চেয়ারম্যান পরিবর্তন সেটা তখন ছিল না। তখনকার বিধান ছিল অবসরে না-যাওয়া পর্যন্ত সাধারণত নিয়োগপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকই অধ্যক্ষ থাকবেন। মুহম্মদ আবদুল হাই স্যারের সময়েই আমি বিভাগে যোগদান করি। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময়, কেন জানি না, আমি চাকুরিচ্যুত হই। আবার আমি আবেদন করলাম। তখন মুনীর স্যার ছিলেন অধ্যক্ষ।
সরকার আমিন : কত সালে স্যার অধ্যক্ষ হলেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : ১৯৬৯ সালের জুন মাসে।
সরকার আমিন : ওই সময় আপনি সহকর্মী হিসেবে কাদের পেয়েছিলেন, শিক্ষক হিসেবে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণই ছিলেন আমার সহকর্মী।
সরকার অমিন : যেমন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার শিক্ষক ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান- এঁরাই মূলত আমার শিক্ষক-সহকর্মী ছিলেন।
সরকার আমিন : যাঁরা আপনার শিক্ষক ছিলেন এবং পরে সহকর্মী। আর তখন আপনার সহশিক্ষক বন্ধু-স্থানীয় কারা ছিলেন? মানে কাছাকাছি বয়সের?
সৈয়দ আকরম হোসেন : তখন কাছাকাছি বয়সের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেননি। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যিক প্রতিষ্ঠান । তখন পাশ করার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দান করা খুব কঠিন ছিল। এটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমার সৌভাগ্য যে ফল প্রকাশের পরপরই আমি লেকচারার হিসেবে বিভাগে যোগদান করতে পেরেছিলাম।
সরকার আমিন : আপনি কি একাই যোগদান করেছিলেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, আমি একাই যোগদান করেছিলাম। আমার বন্ধু ছিল আহমদ কবির। আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই আর আহমদ কবির হয় দ্বিতীয়। আর এমএ-তে যে থিসিসটা আমি লিখেছিলাম, যেটি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : দেশকাল ও শিল্পরূপ নামে। সম্ভবত এই দুটি কারণে অনার্স না-থাকা সত্ত্বেও আমাকেই বিভাগে লেকচারার নেওয়া হয়। পরে আহমদ কবিরও বিভাগে আসে। নরেন বিশ্বাস বিভাগে আসেন। স্বাধীনতার পর একটা শূন্যতা তৈরি হয়, ওই শূন্যতা পূরণ করার জন্য তখন আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং নরেন বিশ্বাস, মনসুর মুসা- এঁদেরকে বিভাগে নিয়ে আসা হয়। আরো একজন এলেন তিনি মোহাম্মদ আবু জাফর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখানে বলা দরকার, আমার শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যার, তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। যেদিন স্যার প্রথম যোগদান করতে যাচ্ছেন, জুন মাস, প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। কুমিল্লার ওখানে তাঁর গাড়ি দুর্ঘটনা কবলিত হয়। ‘কলার বোন’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্যার ফিরে এলেন ঢাকায়। ওই দিনই অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই মগবাজারের রেলপথ দিয়ে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। খুবই মর্মান্তিক এবং দুর্ভাগ্যজনক!
অনু হোসেন : অনার্স ছাড়া আর কেউ কি বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, না আপনিই প্রথম?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ ছিলেন।
অনু হোসেন : কারা ছিলেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : মুনীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ এবং রফিকুল ইসলাম স্যারের কথা মনে পড়ছে।
সরকার আমিন : স্যার আপনি মাস্টার্সে যখন পড়েন তখন আপনার থিসিসটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের উপর।
অনু হোসেন : দেশ কাল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : দেশ কাল ও শিল্পরূপ।
সরকার আমিন : আপনার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করা কি তখন থেকে শুরু? এর আগে কি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোনো কাজ করেছেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : যেকোনো বিষয়ে অধ্যয়ন অথবা প্রণয়নের জন্য একটা পরিবেশের প্রয়োজন হয়, একটা মনস্তাত্ত্বিক সমর্থনের প্রয়োজন হয়। ওই সময় অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলা যায়, অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের চর্চা কিন্তু আমার আর আহমদ কবিরের হাত দিয়েই শুরু হয়। এর আগে হয়েছে, কিন্তু অ্যাকাডেমিক বলতে যা বুঝায় তা হয়নি। যেমন, আনিসুজ্জামান স্যারের রবীন্দ্র বর্ষপূর্তিতে সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়। ঐ সময় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে থাকা অবস্থায় আনোয়ার পাশা রবীন্দ্র ছোটগল্প-সমীক্ষা প্রকাশ করেন; এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাঁর প্রকাশিত ছোটো ছোটো প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করলেন, রবীন্দ্র পরিক্রমা- এ পর্যন্তই। আর একজন ছিলেন জগন্নাথ কলেজে অজিতকুমার গুহ, তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই ছিল আমাদের রবীন্দ্র-সম্পদ। তারপর ১৯৬৫ সালের পর থেকে তো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথের উপর নিষেধাজ্ঞা। সিলেবাস পর্যন্ত পরিবর্তনের চাপ আসে।
তখন আমি হয়তো গবেষণা করিনি, কিন্তু রবীন্দ্রাথের উপরে কাজ করবার বা রবীন্দ্রনাথ পাঠের একটি ইতিহাস তো আছেই। সেটি হল ১৯৬১ সাল। আমি যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রথম বর্ষ আইএ ক্লাসের ছাত্র। ঐ সময় পূর্ববঙ্গে, ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র, রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যশোরেও হয়েছিল।
সরকার আমিন : ওই সময় তো ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : ঐ সময় সব জায়গাতেই তা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঢাকাতেও ছিল যশোরেও ছিল। অন্য জেলাতেও ছিল ওই সময় আমার যতটুকু মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ ছোটোগল্পের নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। পরিচালনাও করেছিলাম; দারোগা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কাজী মাহমুদুর রহমান, বর্তমানে প্রখ্যাত নাট্যকার-কথাসাহিত্যিক, উত্তরায় থাকেন। কৃষক চরিত্রে রূপ দেয় সাজেদুর রহমান। আমি জানি না, সে এখন কোথায়! আর কিছু করতাম একটু ভিন্ন ধরনের, ছায়ানাট্যের আঙ্গিকে। যেমন, ‘অভিসার’, ‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘দেবতার গ্রাস’ ইত্যাদি। আবৃত্তির সঙ্গে মূকাভিনয় করা, কখনো নৃত্যসহযোগে। তারপর ‘কৃষ্ণচূড়ার রং’ প্রতিবাদী ছায়ানাট্য। স্পষ্ট বলা ভালো, ওই সময় আমাদের প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরস্পরিত ছিল। অসংস্কৃত ব্যক্তি তখন প্রধানত রাজনীতি করতেন না। আর যিনি রাজনীতি করতেন তিনি হতেন মূলত শিক্ষিত ও সংস্কৃতবান। আমাদের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটেছিল। এই কারণে রবীন্দ্র-চর্চার একটা পরিপ্রেক্ষিত ছিল। এখানে এসে আমি বিস্তৃত পরিসর এবং সুযোগ পেলাম।
সরকার আমিন : যতদূর জানি যে আপনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিশোরবেলা থেকেই। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তখন মার্কসবাদী বা মার্কসবাদ-কেন্দ্রিক রাজনীতির এক ধরনের বিতর্ক ছিল।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ। ছিল।
সরকার আমিন : রবীন্দ্রনাথ ‘বুর্জোয়া কবি’, ‘রবীন্দ্রনাথ সামন্তবাদী’- এ রকম নানা অভিধায় চিহ্নিত করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটা চেষ্টা ছিল। এই ‘রাজনৈতিক’ আবহের মধ্যে থেকে আপনি রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করছেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের নাট্যরূপ দিচ্ছেন, আবৃত্তি করছেন; পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে থিসিস করলেন- এই যে প্রত্যাশিত বিপরীত একটি অবস্থান, সেটা কেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : বিপরীত ঠিক নয়। বলা যেতে পারে আমি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়িনি কখনো।
সরকার আমিন : হয়তো সেটাই।
সৈয়দ আকরম হোসেন : কারণ পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পরপরই আমি একটি প্রবন্ধ লিখি, আমার গ্রন্থের মধ্যেও আছে। ‘বাংলাদেশ ও রবীন্দ্রবিচার’ এখানে আমি মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ কী হওয়া উচিত, এগুলো লেনিনের তত্ত্ব, মাও সেতুং-এর তত্ত্ব এবং মার্কস-এঙ্গেলেস্-এর ‘লিটারাটি করসপডেন্সে’র উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছি, মার্কসীয় সাহিত্যশিল্প বিচারের মূলসূত্র। মার্কস বলেছেন যে, ‘আঙ্গিক আমার সম্পদ, আমার আত্মিক ব্যক্তিসত্তা, মানুষ আর তার রচনাশৈলী অভিন্ন’। মার্কসবাদী ভাবনার উৎস হল- শ্রেণিজ্ঞান, ইতিহাস-জ্ঞান, কালজ্ঞান, জনসম্পৃক্তি এবং সমাজকাঠামোর উপরিতল-নিচুতলের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা। এর ফলেই কিন্তু কোনো ব্যক্তি কালান্তরকে দেখতে পায়। এখানে আমাদের দেশে যে বিতর্ক তা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই এসেছিল। বইও আছে ‘মার্কসীয় বিতর্ক ১/২ খণ্ড’ দেখো; এখন অখণ্ডও বেরিয়েছে। যাকে বলা যেতে পারে তত্ত্বকে তন্ত্র দিয়ে বেঁধে ফেলার একটা প্রবণতা। মোল্লাতন্ত্র, সেটা যেমন কোনো একজন ধর্মবিশ্বাসীর মধ্যেও থাকতে পারে, মার্কসবাদীদের মধ্যেও তেমনি মার্কসীয় মৌলবাদ থাকতে পারে; ছিল এবং আছে। এই দুটো আমি মেলাতে পারিনি বলেই বোধ হয়- রাজনীতিক পরিস্থিতিকে, বিচ্ছিন্ন হয়ে- দূরে সরে দেখেছি।
সরকার আমিন : তার মানে আপনি- এই পরিস্থিতি কি আপনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে আনতে কিছুটা অনুপ্রেরণা দিয়েছে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : অনুপ্রেরণা না বলে বলা যেতে পারে অনুঘটক। উপাদান হিসেবে হয়তো কাজ করেছে।
সরকার আমিন : আপনি কি কিছুটা হতাশ হয়ে...
সৈয়দ আকরম হোসেন : না, হতাশ হয়ে নয়। আমি বারবারই বলছি, আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম। করতে চাই বলেই, ভেবেছি আমি একা কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারি কি না। সেই প্রতিষ্ঠান কিন্তু শিক্ষকতা কেবল নয়, নিজের পড়াশুনা, অধ্যয়ন, সাহিত্যবিচারের নতুন দৃষ্টি, ভিন্ন অভিমুখী একটা ভাষা সৃষ্টি করা যায় কি না! কোনো আন্তর্জাতিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাহিত্যকে মূল্যায়ন করা যায় কি না- এগুলো একা নিভৃতে সাধনা করে করা যায়। একটা অনুকূল পরিসর গড়ে তোলা যায়। তুমি একটা ফিল্ম একা নির্মাণ করতে পারবে না, তুমি একা রাজনীতি করতে পারবে না, তুমি একটা নাটক একা করতে পারবে না- সহমর্মী, সহকর্মী এবং সংগঠন যদি না থাকে তাহলে তা করা যায় না।
সরকার আমিন : স্যার এবার একটু জানতে চেষ্টা করব এই মনোবৃত্তিটি কীভাবে আপনার মধ্যে গড়ে উঠল? যেমন একটি নাম আমরা আপনার মুখে প্রায়ই উঠে আসতে শুনেছি; আজীজুল হক স্যার। কবি ছিলেন অধ্যাপক ছিলেন। সম্ভবত উনি আপনার জীবনে খুব বড়ো প্রভাব ফেলেছিলেন।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, কিন্তু এর আগেরও একটা ইতিহাস আছে। ‘প্রদীপ জ্বালোনের আগে সলতে পাকানোর’ একটা ইতিহাস, তাই না? আমি মফস্বলের ছেলে। আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক শিল্প কিংবা ক্রীড়াজগৎ- এসব সম্পর্কে ক্লাস সেভেনের ছেলে যে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারল অর্থাৎ কীভাবে চিন্তা করতে পারল, তার পথপ্রদর্শনের জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ এবং ঋণী আমার স্কুল শিক্ষক অসিতবরণ ঘোষের কাছে। স্যার ছিলেন আমাদের সংস্কৃতিসচেতন শিক্ষক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে তিনি সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে ‘অধ্যাপক’ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
সরকার আমিন : উনি এখন....?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যা, উনি এখন থাকেন খুলনায়। ৮১ বছরে পড়েছেন। তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। এত তো বলা যাবে না। তবে একটা উদাহরণ দেই- আমি যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, আমাদের স্কুলে ইংরেজি নাটক মঞ্চস্থ করানো হল, অসিতবরণ স্যার সেটা পরিচালনা করলেন। শেকস্পিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর বিচারদৃশ্য। সেখানে অ্যান্টনিও-চরিত্রে আমি অভিনয় করেছিলাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত মুসা চৌধুরী, খুব ভালো ক্রিকেট খেলত, ছোটবেলায় খুব ফরসা ছিল, সে পরশিয়া চরিত্রে; সিরাজুল ইসলাম তার নাম, সেও মারা গেছে- শাইলক চরিত্রে অভিনয় করেছিল। এটি খুব প্রশংসিত হয়েছিল বললেও কম বলা হয়। ঐ সময় জেলার যে অভিজাত শ্রেণি, যেমন- ডিএম, এসপি, ডিএসপি, বিচারপতি, কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকবৃন্দ, স্কুল কলেজের পরিচালনা-পর্ষদের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। দৈনিক অবজারভারে মঞ্চস্থ নাটকের ছবিও ছাপা হয়েছিল। এই একটি উদাহরণ দিলাম। অসিতবরণ ঘোষ ক্লাসরুম থেকে ক্রিকেট-মাঠ সর্বক্ষেত্রেই আমাদের অনুপ্রাণিত করতেন। বিশেষ করে একদিকে ভারতীয় সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যের যে মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপার ছিল স্যারের মধ্যে, আমি বুঝেছিলাম ঐ বয়সেই। সেখান থেকে আমার শুরু।
তারপর আজীজুল হক স্যার আমার ভাবনা-বিকাশের মধ্য পর্যায় পর্যন্ত লালন করেছেন। তাঁর ভূমিকাও অসাধারণ- তিনি বাংলা সাহিত্য, পূর্ববঙ্গের কবিতা-নাটক-কথাসাহিত্য এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহী করতেন, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে অনুপ্রাণিত করতেন। যশোর সাহিত্যপরিষদের মধ্য দিয়ে স্যার আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। নিয়ম ছিল প্রতি পূর্ণিমায় সদ্যপ্রকাশিত নির্ধারিত গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা হতো। সপ্তাহে একদিন কবিতা/গল্প/প্রবন্ধ পাঠের আসর বসত। উপস্থিত থাকত খায়রুল আলম, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এবং প্রায়শ থাকতেন কাজী মাহমুদুর রহমান ও মাইকেল মধুসূদন কলেজের বাংলা অনার্সের শিক্ষার্থীবৃন্দ। বিশেষভাবে স্যারের বাসায় নিয়মিত যেতাম আমি, খায়রুল আলম, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানসহ অনেকেই। শীতের রাত, বেজে যেত ১১টা। স্যার বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করতেন। শিল্পতত্ত্ব, দর্শন, চিত্রশিল্প নিয়ে চলত অনির্ধারিত আলোচনা। স্যার নিজে ছবি আঁকতেন। মাঝে মাঝে উপস্থিত হতেন শিল্পী এস এম সুলতান। স্যারের সিগারেট খাওয়াটা ছিল একটা আর্ট। আমার সম্পর্ক স্যারের সঙ্গে ছিল নিবিড়। আজীজুল হক স্যার ঢাকায় এলে ফুলার রোডের বাসায় নিয়ে আসতাম। আমার শিক্ষক-জীবনের যারা সহকর্মী এবং আমার যারা ছাত্র- তাদের সঙ্গে স্যার বাসায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের আমার ছাত্র-সহকর্মী শিক্ষক যারা, তারাও কিন্তু স্যার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
সরকার আমিন : আজীজুল হক স্যারের কিছু গদ্য পড়েছি আমি, তার মধ্যে ভাষার একটি শৈল্পিক চেষ্টা, একটা গাম্ভীর্য, শিল্পিত ভাব আছে, সেই প্রভাব কি আপনার মধ্যে...?
সৈয়দ আকরম হোসেন : বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়- ‘অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা’। সংকলিত গদ্যগুলো আজীজুল হক স্যার লিখেছেন মানে তাঁকে দিয়ে আমরা লিখিয়ে নিয়েছিলাম; অসাধারণ, মূলত উনি কবি। কবিতার কাঠামোর মধ্যে সেকালের, ষাটের দশকের অত্যাধুনিক অসাধারণ সব পঙক্তি :
অন্ধকারে চাঁদ একটি বড়শির টোপ
সকালের সূর্য একটি দুষ্প্রাপ্য সুযোগ
স্বাধীনতা একটি নির্দেশ
স্বপ্ন একটি শত্রুতা
সময়- সময় একটা বহুব্যবহৃত ছদ্মবেশ
কিন্তু মাটি একটি সম্ভাবনা
এবং মানুষ একটি অস্তিত্ব।
সৃষ্টি যদি শিল্পিত না হয় তাহলে সাহিত্য হয় না। আজীজুল হক স্যার ছিলেন একজন আপাদমস্তক চিত্রকল্পময়, প্রতীকবাদী নান্দনিক কবি। তাই তাঁর গদ্যও ছিল মেধাবী ও সৃষ্টিশীল।
সরকার আমিন : তাহলে স্যার এটা অনুমান করতে পারি আপনার মনোবৃত্তি তৈরির পেছনে আজীজুল হক এবং অসিতবরণ ঘোষ ঐ পর্যায়ে...
সৈয়দ আকরম হোসেন : ঐ পর্যায়ে মানে যশোর পর্যায়ে, আগে অসিতবরণ স্যার, পরে কবি আজীজুল হক স্যার। আর ঢাকা পর্যায়ে স্পষ্টভাবে বললে, যাঁকে আমি আত্মস্থ করেছি, তিনি হলেন অসাধারণ বাগ্মী, মনস্বী প-িত, ইংরেজি-বাংলা উভয় শাস্ত্রে যিনি অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি অর্জনকারী, নাট্যকার, অনুবাদক- তিনি মুনীর চৌধুরী। আর কোনো বিশেষণ প্রয়োগ করলাম না।
সরকার আমিন : এখন স্যার, মুনীর চৌধুরীর যে বাগ্মিতা সেটা তো আমরা দেখি নি। কিন্তু আপনার বাগ্মিতা যেটা সরাসরি আমরা দেখি...
সৈয়দ আকরম হোসেন : এমন তুলনা চলে না। তবে কথা কী জানো আমার সৌভাগ্য হয়েছে মুনীর চৌধুরী স্যারের ছাত্র হওয়ার। স্যারের কণ্ঠস্বর ছিল ফ্যাসফেসে। কিন্তু কী করে যে স্যার ওই কণ্ঠ দিয়ে মুগ্ধতা ছড়াতেন, সম্মোহিত করতেন তা ছিল বিস্ময়কর। স্যারের ‘ব্যাক পেইন’ ছিল, অসম্ভব কষ্ট পেতেন। মুঠো ভরে অ্যাসপ্রিন খেতেন। প্রায়শ আমাকে বলতেন, রোল কলটা করে দিয়ে এসো। রোল কল শেষে বলতাম, স্যার রোল কল করা হয়ে গেছে আপনি যান। মুনীর চৌধুরী স্যারের পক্ষেই মানায়- তিনি ক্লাসে বক্তৃতা করতে করতে চা খেতেন। এটা সম্ভব তাঁর পক্ষেই। অন্য কেউ করতে গেলে বেমানান হত নিঃসন্দেহে। পরবর্তীকালে লক্ষ করেছি মুনীর চৌধুরীর ক্ষমতা, জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, ভাষার উপরে বিরাট দক্ষতা এগুলো অনর্জিত রেখে, কেবল তাঁর বহিরাঙ্গিক বিষয়গুলো অনুসরণের চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। মুনীর স্যার মিনিট পনেরো দেরিতে ক্লাসে গিয়ে, ত্রিশ মিনিটে যা বলতে পারেন, কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাজেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি শিক্ষকজীবনে কোনোদিন ক্লাসে এক মিনিট দেরিতে যাব না। এটা মুনীর চৌধুরীর কারণে হয়েছে; জানি আমি তো মুনীর চৌধুরী নই, আমি সাধারণ একজন শিক্ষক। কনিষ্ঠ ছাত্র-সহকর্মী হলেও আমাকে খুব স্নেহ করতেন স্যার। উনি একটা নাটক অনুবাদ করেছেন, আমাকে পড়ে শোনাবেন, আমি তখন নতুন করে তাঁর একক ক্লাসে বসতাম। মুনীর চৌধুরীর মধ্যে- সৃজনশীল এবং অ্যাকাডেমিক দু-প্রান্তের এক অসাধারণ মিথস্ক্রিয়া ছিল, যা একান্তই দুর্লভ। স্যার প্রায়ই বলতেন, সাহিত্যশিল্প ও মুক্তবুদ্ধির আন্তর্জাতিক পরিসরে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গ।
সরকার আমিন : মুনীর চৌধুরীকে তো আপনি স্যার ক্লাসের বাইরেও অনেকটা সময় পেয়েছেন, ব্যক্তিগত আড্ডায়।
সৈয়দ আকরম হোসেন : স্যারের আড্ডাটা ছিল অন্যরকম, সৃষ্টিশীল।
সরকার আমিন : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের যোগ্যতা কী হওয়া বাঞ্ছনীয় স্যার?
সৈয়দ আকরম হোসেন : শিক্ষকের কখনো শিক্ষার্থীদেরকে ডিকটেট করা উচিত নয়, কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদেরকে জাগিয়ে দেওয়া। তাদের মধ্যে অসংখ্য জিজ্ঞাসা তৈরা করা। ওই জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানের সচেষ্টতার মধ্য দিয়েই তারা তাদের জ্ঞান-পথ আবিষ্কার করে নেবে। সৎ শিক্ষক কখনো ডিকটেট করেন না, বিদ্যার্থীদের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়ায় তিনি সাহায্য করেন মাত্র । কেবল বই নয়, শিক্ষক তাঁর অকৃত্রিম জীবনকেও গ্রন্থাকারে শিক্ষার্থীদের কাছে উন্মোচন করবেন। ছাত্র-ছাত্রীরা কেবল বক্তৃতা নয়, শিক্ষকের আচার-আচরণ-উচ্চারণ ও আদর্শকে মান্য করে, শ্রদ্ধা করে। শিক্ষার্থীদের কল্যাণকর একজন হয়ে-ওঠার সাধনা শিক্ষকের থাকতে হবে।
সরকার আমিন : মুনীর চৌধুরী স্যার খুব শৌখিন ব্যক্তি ছিলেন, যদ্দুর আমরা তাঁর ছবি দেখি। তিনি নিজেই তাঁর গাড়ি ড্রাইভ করতেন।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ। তখন ঢাকায় অবশ্য ৫/৭ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে পর, নীলখেতে গাড়ি দৃশ্যমান হত । আমার সময়ে আমি দেখেছি : মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যারদের গাড়ি ছিল। প্রায় সবাই নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতেন।
সরকার আমিন : গাড়িটাকে স্যার সিম্বল হিসেবে ধরছি। ওই সময়ের প্রযুক্তি...
সৈয়দ আকরম হোসেন : তখন সবাই ব্যবহার করতেন। মুনীর চৌধুরীর প্রযুক্তির আধুনিকতা তো অন্য জায়গায়। তিনি আমাদের বাংলা ভাষা চর্চার অন্যতম উপকরণ, অর্থাৎ টাইপরাইটারই পালটে দিয়েছেন। তিনি আধুনিক টাইপরাইটার ‘মুনীর অপটিমা’-র উদ্ভাবক। ওই আবিষ্কারের পথ ধরেই কম্পিউটারের ফন্ট এসেছে। ইউনিকোড সম্ভব হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার সুযোগ এখন বিশ্বপ্রসারিত।
সরকার আমিন : মুনীর চৌধুরীর প্রযুক্তির প্রতি যে আগ্রহ এটা খুবই বিস্ময়কর আমাদের কাছে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : আগ্রহ শুধু না। আবিষ্কারক। মুনীর স্যার ছিলেন আধুনিক ভাষাতত্ত্ববিদ। আমেরিকা থেকে তৎ-সাম্প্রতিক ভাষাজ্ঞান তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জন করেন। স্যারের কাছে শেকস্পিয়ার অনুবাদ ও মুনীর অপটিমার আবিষ্কার একই রকম আনন্দের ছিল- সৃষ্টির আনন্দ।
সরকার আমিন : মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে স্যার কেমন দেখেছেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : অসাধারণ মার্জিতরুচির মানুষ ছিলেন স্যার। নিসর্গপ্রেমী। মৃদুভাষী। পুষ্পপ্রেমিক। এসব তিনি অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রসাহিত্য ও শান্তিনিকেতন থেকে।
সরকার আমিন : আপনাদের সময় তো একটি অভিজাত বিভাগ ছিল বাংলা বিভাগ। মর্যাদাকর, স্টারদের সমাহার, এটা তো আপনাদের সময় ছিল।
সৈয়দ আকরম হোসেন : স্টার শব্দ আজকাল ব্যবহৃত হয়। ওসব মিডিয়ার সাম্প্রতিক ব্র্যান্ড শব্দ। এমনিই পাল্টাবে অনেক কিছু। স্বাভাবিক। যাহোক। মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, আহমদ শরীফ, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যারদের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভাগ্য হয়েছিল তাঁদের স্নেহধন্য সহকর্মী হওয়ার।
অনু হোসেন : স্যার আমরা আপনার কাছ থেকে শিখেছি সময়ানুবর্তী হতে। আপনার মধ্যে এই প্রেরণাটি কীভাবে জেগেছে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা- আধুনিকতার অনিবার্য অনুষঙ্গ বলে আমার বিশ্বাস। সময় হত্যা চরম অপরাধ, নৈতিকতার প্রশ্নে বললে মহাপাপ। আমার ব্যক্তি-আচরণের মধ্য দিয়ে তা ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতে চেয়েছি। আমি শিক্ষার্থীদের মাঝে তার সদর্থক প্রতিফলনও দেখেছি।
সরকার আমিন : এখন অন্য প্রসঙ্গে একটু আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পাঠ্যসূচি সেটা কি সৃষ্টিশীল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচি নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলি। ১৯৬৮ সালেই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয় ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা; পাঠ্য ছিল: জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী। যুক্ত হল ত্রিশোত্তর উপন্যাস; পাঠ্য হল : তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁরা বর্জিত ছিলেন। এখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে যুক্ত হয়েছেন: সমরেশ বসু, অমিয়ভূষণ মজুমদার, আরো অনেকে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য। বাংলাদেশের ষাটের দশকের সাহিত্যিক প্রতিনিধিরা পর্যন্তও পাঠ্যসূচি অন্তর্গত হয়েছেন। তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতির বাস্তবিকতার উপর সার্বিক প্রাগ্রসরতা ও সার্থকতা নির্ভর করে।
অনু হোসনে : আপনার লেখা প্রথম প্রবন্ধ কী ছিল রবীন্দ্রনাথ না অন্য কিছু?
সৈয়দ আকরম হোসেন : জীবনের প্রথম, মানে সতেরো বছর বয়সে আমি প্রথম প্রবন্ধ লিখি, ‘জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন’।
অনু হোসেন : নজরুল নিয়ে কখন লিখতে শুরু করলেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : ১৯৬৮ সালে নজরুল ইসলামের ‘চক্রবাক’ এবং তাঁর ‘প্রবন্ধাবলির’ উপর লিখতে শুরু করি। ওগুলো পরে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।
অনু হোসেন : স্ট্রিম অব কনশাসনেস কোন সময়ের প্রবর্তন? প্রথম শুরু রবীন্দ্রনাথ না পশ্চিমের কারো হাত দিয়ে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : বলা যায় রবীন্দ্রনাথই কথাসাহিত্যের ন্যারেটিভ অবচেতন-অচেতন মনোজগতের আচরণগুচ্ছ প্রয়োগ করেন। প্রসঙ্গত জানা দরকার, মার্কিন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনারের ‘অ্যাজ আই লে ডাইং’ উপন্যাস Darl, Cora, Jewel, Dell, Tull, Anse প্রভৃতি চরিত্রের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রণীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সমকালীন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসটি লেখেন। অনেকে আঙ্গিকের প্রশ্নে বিমলা-নিখিলেশ-সন্দীপের আত্মকথার মাঝে ‘অ্যাজ আই লে ডাইং’-এর প্রতিধ্বনি খোঁজেন। কিন্তু ‘ঘরে-বাইরে’র প্রকাশ ১৯১৬ এবং ‘অ্যাজ আই লে ডাইং’-এর প্রকাশ সন ১৯৩০। এ সময়ে সবুজপত্রে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের অত্যাধুনিক উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। এখানে ‘স্ট্রিম অফ কনশাসনেস’, ‘এক্সপ্রেশনিজম’ এবং ‘স্যাররিয়ালিজম’-এর প্রয়োগ এবং গদ্যের একটা পরীক্ষা আছে। ‘চতুরঙ্গে’র গদ্যরীতি সাধুরীতির; কিন্তু মৌখিক অর্থগ্রহণরীতি, ছেদ-উপচ্ছেদ ব্যবহার, ক্রিয়াপদ বর্জন, উচ্চারণভিত্তিক হ্রস্ব বাক্যের ব্যবহার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, চলতি গদ্যের কাছাকাছি। এসব নিয়ে আমি আমার গবেষণা গ্রন্থে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছি।
অনু হোসেন : রবীন্দ্রনাথ নামটি ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত থাকবে তাঁর কোন কাজের জন্য- গানে, কবিতায়, কথাসাহিত্যে, নাটকে না উপন্যাসে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : দেখো, একজন সাহিত্যিক কীভাবে আবিষ্কৃত হচ্ছেন সেটা তার উপর নির্ভর করে। যেমন, তাঁর কথাসাহিত্য, তাঁর কবিতা। তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে’ ছিল আলোর উচ্ছ্বাস। ‘গল্পগুচ্ছে’ প্রথম দিকে ছিল অন্ধকার। তারপরে বিশ শতকে এসে দেখা যাচ্ছে তার উপন্যাসের মধ্যে অন্ধকার সঞ্চারিত হচ্ছে, তাঁর নাটকের মধ্যে অন্ধকার পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছে। তাঁর চিঠির মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। এই যে জায়গাগুলো, অর্থাৎ অন্ধকার-পূর্ব ভাবনা থেকে তিনি সরে এসেছেন, বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাকে তিনি ষড়ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করেন, কিন্তু তিনি অন্ধকারকে চারদিক থেকে ভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করেছেন- বলাকাপর্যায়ের কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে। এখন তুমি যদি এই বিষয়টাকে আবিষ্কার করতে না-পারো, তাহলে মনে হবে কবিতা, কথাসাহিত্য পুনরাবৃত্তিময় ও প্রথাবদ্ধ, আর যদি বুঝতে পারো তাহলে স্পষ্ট হবে ওখানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে একালের, এখনো পর্যন্ত আমাদের অন্ধকারের কাছাকাছি, অস্তিত্বসংকটকে স্পর্শ করেন ঐ জায়গাটায়। যখন তুমি ‘রথের রশি’, ‘গল্পস্বল্প’ পড়বে, তারপরে ‘অচলায়তন’ নাটকের বিষয়টা পড়বে- যেখানে তিনি শূদ্র শ্রেণির প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সমর্থন করছেন। এসব জনসম্পৃক্তির
বাস্তবতা- সবকিছুই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আছে। এখানে বলা দরকার যে, একজন চিত্রশিল্পী হোন, একজন প্রাবন্ধিকই হোন, ঔপন্যাসিকও হোন, নাট্যকার হোন তিনি কিন্তু মূলত কবি। যিনি কোবিদ না হন তার পক্ষে কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। গদ্যের মধ্যে যখন কবিতার স্পন্দিত পুষ্পিত ইমেজ সঞ্চারিত হয়, তখন তার কবি সত্তাই কিন্তু আরেকটা রূপ নেয়। ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে কেউ বলেছেন, আমি প্রবন্ধ লিখতে প্রকাশক-সমর্থন পাই না বলেই উপন্যাস লিখছি। উপন্যাস যদি লিখতে না হত আমি প্রবন্ধই লিখতাম। যাহোক, আমার বিশ্বাস সম্পর্কে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। সৃষ্টির সহস্র ফুল ফুটতে দাও; কবি এবং কোবিদ সত্তা যার মধ্যে নেই তিনি ছবিও আঁকতে পারবেন না। কারণ ছবির যে রং, রূপ, রেখা এবং তার টোনালিটির যে ডিফারেন্স এগুলোর মধ্যেও কিন্তু কবি সত্তারই কাজ। কাজেই কোনটা বড়ো সেটা কথা নয়। গান, হ্যাঁ, একটা বিশেষ মানুষের কাছে গানটাই প্রধান হয়ে উঠতে পারে। আবার আর একজনের কাছে মনে হবে ‘রক্তকরবী’ অনেক ভালো, অনেক বেশি জীবনের কথা বলছে। কাজেই বড়ো প্রতিভা একটা জনসঙ্ঘের, সেটা বিশ্ব জনসঙ্ঘই হোক আর দেশীয় জনসঙ্ঘই হোক, মাঝে নানা মাত্রায় প্রতিনিয়ত একটা প্রিজমের মতো নানা রঙের রূপ-রূপান্তর ঘটাতে পারেন। একটা ত্রিকোণ কাচের মধ্যে যেমন সকাল আটটায় এক রকমের রং বিচ্ছুরিত হয়, দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যায়, সৃষ্টি-আনন্দের বর্ণান্তর কথা বলে। বড়ো একটা প্রতিভার মধ্যেই কিন্তু সৃষ্টির সবটাই জাগ্রত থাকে, কথা বলে, খেলা করে।
অনু হোসেন : রবীন্দ্রনাথের গান বিশেষ একটি সংস্কৃতবান চিন্তামগ্ন মানুষের জন্য, তারাই বেশি শোনেন। নজরুলের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম- অনেক শ্রেণির মানুষ উপভোগ করেন। কেন? রবীন্দ্রনাথের কোন দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমনটা ঘটে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : জনসম্পৃক্তির একটা কারণ তো থেকেই যায়। কোনো একটা বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে, কোনো একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে কোনো মানুষ যখন কথা শোনে, সে তার অস্তিত্বের সপক্ষীয় কথাই শুনতে চায়, যেহেতু মানুষ আজীবন প্রতিদিনই বঞ্চিত। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে কিন্তু একটা প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে। সেটা যখন মানুষ খুঁজে পায় তখন সরাসরি তার কাছে যেতে পারে- খুব সহজ কথা। রবীন্দ্রনাথ যখন গান লিখেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ এটা কিন্তু প্রত্যেকেই গাচ্ছে। [হাসি] বা উনি যখন লিখছেন, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ তখন কিন্তু এটা সবাই গ্রহণ করছে। এমন বেশ কিছু গানই আছে।
সরকার আমিন : অনু যেটা বলছে স্যার, রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু গান আছে যেগুলো একটা বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে, বিশেষ মানুষের অনুভূতিতে কাজ করে, যেমন চিন্তাশীলতার বিষয়।
সৈয়দ আকরম হোসেন : ঐ যে আমি আগেই বললাম যে, একটা মানবসম্প্রদায়ের কাছে, জনসম্পৃক্তির কাছে।
অনু হোসেন : জনসম্পৃক্তির কথা বলছিলেন স্যার।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, এক একটা জনসম্পৃক্তির কাছে, তাদের অস্তিত্বের কাছে তা এক-একটা মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেকথা আমি অন্যভাবে বলতে পারি, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে’- বৃষ্টি হল, প্রচুর বর্ষা, চারদিকে পানি থইথই করছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের যারা বস্তিতে থাকে তারা ভাসছে। ওখানে তখন যদি টেপ রেকর্ডারে ছাড়া যায় ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ তা হলে কী তাৎপর্য আসবে? মনে রাখতে হবে মানবঅস্তিত্বের সার্বিক অনুকূলে যা তাই সত্য, তাই সুন্দর, তাই কল্যাণ। নিরাপদ অস্তিত্ব ও উদ্বৃত্ত সময় যাদের আছে, উদ্বৃত্ত অর্থ যাদের আছে, আধুনিক রেকর্ডারে-কম্পিউটারে গান বাজছে, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ তখন বেশ আবেশ-আবেগ সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু বন্যাপ্লাবিত নিরস্তিত্বপ্রায় মানুষের কাছে তা হবে না। কিংবা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ এটা ভিন্ন পরিবেশে সুন্দর, জীবনের কাছাকাছি। আমার কথা হল, জীবন একটি সামবায়িক জগৎ, এর একটি ঠিক অন্যগুলো ঠিক নয়, এটাও অযথার্থ। সব শ্রেণি মিলিয়েই কিন্তু আমাদের জীবন। আমাদের সমাজের মধ্যে তো তারই সহ-অবস্থান। বৈচিত্র্যের মাঝে ন্যূনতম ঐক্যকে তো অস্বীকার করা যাবে না।
অনু হোসেন : স্যার রবীন্দ্রনাথের গানের যে সংবেদনা, সেনসেশন বা ফিলিংস এটার প্রেরণা কোথা থেকে? কেউ কেউ বলেন সুরের ক্ষেত্রে একটি পরোক্ষ ইউরোপীয় প্রেরণা কাজ করেছে।
সৈয়দ আকরম হোসেনে : না, আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রেরণার ব্যাপারটা মূলত তো তাঁর পারিবারিক। এটা তাঁর মধ্যে এসেছে শৈশব থেকেই। ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, উপাসনা-অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করা। রবীন্দ্রনাথের শিশুকাল থেকেই প্রতিদিন সকালে সংগীত শিখতে হত। তাঁর দাদা জ্যেতিরিন্দ্রনাথ অসাধারণ ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন, সুরকার ছিলেন, ব্রহ্মসংগীতের আধুনিক স্বরলিপিরও অন্যতম উদ্ভাবক তিনি। জ্যেতিরিন্দ্রনাথের উৎসাহে প্রেরণায় কিশোর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের সুরের অসাধারণ বোধ ছিল। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর গাওয়া গান শুনতেন।
অনু হোসেন : মানে সুরের ব্যাপারটা।
সৈয়দ আকরম হোসেন : তিনি যখন ইংল্যান্ড গেলেন, সেখানে যে উদ্দেশ্যে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিকতার স্বার্থে- তা তো হল না। সেখানে গিয়ে তিনি অর্জন করলেন ইয়োরোপীয় সংগীত, নৃত্যের অভিজ্ঞতা; কন্স্টবল প্রমুখের চিত্রশিল্প দেখার সংবেদ। অর্জন করেন পাশ্চাত্য শিল্পের প্রত্যক্ষ জ্ঞান। ইয়োরোপীয় তরুণ-তরুণীর স্বাধিকার, ভারতবর্ষে তার অভাব বিষয়ে তাঁর চিঠিপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। ওসব চিঠিপত্রে কলকাতায় সৃষ্টি হচ্ছিল পারিবারিক ও সামাজিক সংকট। ফলে রবীন্দ্রনাথকে দ্রুত দেশে ফেরত আনা হল। কিন্তু তিনি ফিরে এলেও মস্তিষ্কের মধ্যে, বোধের মধ্যে নিয়ে এলেন নতুন শিল্প-অভিজ্ঞতা, প্রেরণা ও সৃষ্টির নতুন আকাঙ্ক্ষা। দেখা দিল ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অর্থাৎ সেখানে নৃত্যনাট্য, সুর নতুনভাবে কিন্তু সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ইয়োরোপীয় সুর এবং আমাদের ভারতীয় সংগীতের একটা আশ্চর্য সম্মিলনের সূত্র দেখা গেল। রবীন্দ্রনাথের গানটা ভালো করে শোনো, ঢেউটা শান্ত পদ্মার স্রোতের মতো ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে সুরের ধারায়। একটা অদ্ভুত মেলোডি, সুরসংগতি, উত্থান-পতন।
অনু হোসেন : এটা তরঙ্গ।
সৈয়দ আকরম হোসেন : একটা অপূর্ব মেলোডি। এভাবে উঠে যাচ্ছে, সমান্তরাল নয় কিন্তু। অর্থাৎ একদিকে যে ভারতীয় সঙ্গীতের সুরধারা আর ওদেশের অ্যান্টি-মেলোডিতে উঠা-নামা। আমি কোনো সংগীতের জ্ঞানে কথা বলছি না, সে জ্ঞানও আমার নেই। আমি আমার বোধের, সংবেদের কথা বললাম।
সরকার আমিন : সামান্য একটা।
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার তো শুনলেই মনে হয় এটা রবীন্দ্রসংগীত। নজরুল সম্পর্কেও এ-কথা বলা যায়। আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, নজরুল সংগীতের বৈচিত্র্যই বা কতজন বোঝে? কিন্তু আকর্ষণ প্রবল।
সরকার আমিন : অর্থাৎ?
সৈয়দ আকরম হোসেন : এটার একটা কারণ হল গ্রামফোন কোম্পানি, ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’ ব্যবসা করবার জন্য নজরুলকে দিয়ে গান লিখিয়ে, সুর করিয়ে নিত। তিনি একাধারে- তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, আবার শ্যামা মায়ের পায়ের নিচে- গেয়ে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বটা কিন্তু অপ্রমাণিত ও অচর্চিত রয়ে গেছে। তিনি এই ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক কবি, গীতিকার ও সুরকার। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু আমরা তাকে দেখি না। আর দেখি না বলেই তাঁকে কিন্তু আমরা সীমাবদ্ধতার কারণে কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে, অনেকেই, তাঁকে সরিয়ে রাখছি ।
অনু হোসেন : নজরুলের ‘নটরাজ’ সম্পর্কে জানতে চাই- এই বিষয় নিয়ে আপনি লিখেছিলেন।
সৈয়দ আকরম হোসেন : এই প্রবন্ধটা লেখার পেছনে একটা জাতীয় তাগিদ ছিল। সেটা হল, কমলেশ চট্টোপাধ্যায় একটা পিএইচ ডি গবেষণা-গ্রন্থ রচনা করেছিলেন মিথের ব্যবহার এবং তপস্বী তরঙ্গিনী বিষয়ে, সেখানে তিনি চল্লিশ পঞ্চাশ পৃষ্ঠাব্যাপী বাংলা কবিতায় মিথের ব্যবহার সম্পর্কে পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের নামটা পর্যন্ত উল্লেখিত হয়নি। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমার মনে হল বাংলাদেশে এত নজরুল চর্চা হচ্ছে কিন্তু এটা নিয়ে কেউ ভাবছে না। নজরুলের সম্পূর্ণ সাহিত্য পড়লে দেখবে, তাঁর বিদ্রোহ ও সৃষ্টি খুব প্যারালাল। কেবল ভাঙার জন্য নয়। ভাঙা এবং সৃষ্টি। ভাঙা এবং সৃষ্টির এই যে ইমেজ, এর একটা সিম্বল, শক্তি উৎস নজরুল অনুসন্ধান করেছেন। সমকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ-শাসিত ভারতবর্ষে কোনো প্রতিবাদী অসাম্প্রদায়িক বিশাল ব্যক্তিত্ব কি তিনি পেয়েছেন? সর্বজনগ্রাহ্য যে প্রতিবাদী চরিত্র তা কিন্তু তিনি পাননি। তখন কিন্তু নজরুল ইসলাম গেলেন, ঐতিহ্যের কাছে, পুরাণের কাছে। পেলেন নটরাজকে। পার্থক্যটা বুঝতে হবে। নজরুল ইসলাম বলেছেন যে নটরাজের আকাশে-ওড়ানো কালো কেশ, কালবোশেখি হয়ে ঝড় আসছে যেসব ভেঙে ফেলবে। ভেঙে ফেলে কী হবে? ভেঙে ফেলে তার শিশু চাদের আলোয় ‘ভরবে এবার ঘর’- এমন একটা প্রতীক। নজরুল ইসলাম ‘শিশু চাঁদের করকেই’ জয়ধ্বনি করে আহ্বান করেছেন, এবং করতে বলেছেন। নটরাজ শিব একদিকে প্রলয় নৃত্যের মাঝ দিয়ে সৃষ্টি ধ্বংস করে, আবার নৃত্যের মাঝ দিয়েই গড়ে ওঠে নতুন সৃষ্টি। সৃষ্টিনৃত্য এবং ধ্বংসনৃত্যকে একত্রিত করে যে ছন্দোময় করতে পেরেছে সে নটরাজ। এটি নজরুল ইসলামে আজীবন অনুসৃত হয়েছে। আমি আবারো বলি, নজরুল ইসলামের মতো দ্বিতীয় কোনো অসাম্প্রদায়িক কবি বাংলায় জন্মায়নি। তাঁর সাহিত্যে মিথ-পুরাণ-ইতিহাস চর্চার প্রশ্নেও একথা প্রযোজ্য।
অনু হোসেন : আপনার কাজের মধ্যে গবেষণার ক্ষেত্রে, ছাত্র পড়ানোর ক্ষেত্রে এবং লেখালেখিতে- একটা বিশেষ জায়গাকে আপনি গুরুত্ব দেন। সেটা স্ট্রাকচারাল বিশ্লেষণ, যেটা সচরাচর আমাদের সাহিত্য সমালোচনায় বেশি দেখা যায় না। সাহিত্যে কেন আমরা স্ট্রাকচারকে বিশেষ গুরুত্ব দেব? একজন লেখক কি স্ট্রাকচারের উপর ভিত্তি করে লেখেন না কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : মনে রাখতে হবে যে আমরা একটি অস্তিত্বশীল, অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ, আমরা প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রকাশ করতে চাই। প্রকাশ আকাক্সক্ষা মানুষের একটা সহজাত বৃত্তি। তো এটাকে অর্থাৎ বস্তুবিশ্বজাত অনুভূতিপুঞ্জকে আমরা যদি প্রকাশ করতে চাই, নির্বস্তুক অনুভূতি কি আকার-আঙ্গিক অর্থাৎ স্ট্রাকচার ছাড়া সম্ভব? সুন্দর বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মধ্যে একটা রূপ জেগে ওঠে, অবয়ব পায়...
অনু হোসেন : অনুভূতি পায়।
সৈয়দ আকরম হোসেন : অনুভূতি রূপ পায় আকারের মধ্য দিয়েই। ভাবনা, বোধ, দর্শন- সব কিন্তু বিমূর্ত। সেটাকে মূর্ত করতে গেলেই আমাকে একটা রূপে প্রকাশ করতে হবে। আমি স্ট্রাকচার শব্দটা বলছি না কারণ ওর সঙ্গে আবার স্ট্রাকচারিলিজমের সম্পর্ক আছে। একটা রূপ দিতে হবে। এই রূপ-দক্ষতাই একটা প্রতিভার সবচেয়ে বড়ো ঐশ্বর্য। যে-সময় আমি গবেষণা করতাম তখন আমার মনে হত, প্রচলিত সমালোচনাসাহিত্য মানেই হল কাহিনির বর্ণনা। জসীমউদ্দীনের উপর কোনো একটা সমালোচনাগ্রন্থ প্রকাশের পর মূল বই বিক্রি হ্রাস পায়।
অনু হোসেন : মূল বইয়ের?
সৈয়দ আকরম হোসেন : কারণ ওখানেই তো সব কাহিনি আছে। যাহোক, আমাদের দেখতে হবে কোনো প্রতিভার রূপদক্ষতার উৎস কোথায়, উপকরণ কী, মোটিফগুলো কী কী- এগুলো যদি না স্পষ্ট হয় তাহলে একজন শিল্পীর স্বাতন্ত্র্য শনাক্ত করা যায় না। এজন্য শিল্পীকে রূপদক্ষ হতেই হবে, এবং সৃষ্টি বোঝার জন্য আলোচককেও ‘রিসিভটিভ ইমাজিনেশনে’র সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে রূপদক্ষতা একভাবে এসেছে। নজরুলের মধ্যে এসেছে ভিন্নভাবে। জীবনানন্দ দাশের মধ্যে আর একভাবে এসেছে, তাই না? কাজেই বিবেচনা-দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্নতর হতে হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, শিল্পের আধেয় সবই তো আমাদের স্থানীয়। ইংল্যান্ডের কেউ কিন্তু এই বর্ষাকে বুঝবে না। আবার কানাডায় যখন তুষার নিয়ে শিশুরা বরফের মধ্যে খেলা করে, অন্যরা আকাশ দেখছে, বরফ-ঢাকা বৃক্ষ দেখছে- সেটাও কিন্তু আমরা ওভাবে বুঝব না। বা মরুভূমির উপরে যেমন হাওয়া বয়ে যায়, বালুর স্তরে স্তরে ছবি-দৃশ্য ফুটে ওঠে। সুর জেগে ওঠে। ওদের কবিতার মধ্যে সে সৌন্দর্য ওরা শিল্পরূপ দেবে- তা সবই স্থানীয়। স্থানীয়টা আন্তর্জাতিক হচ্ছে কখন, যখন তাঁরা ওসবকে ব্যঞ্জনাময় রূপ দিয়ে, সহৃদয়হৃদয়সংবেদ্য সবার মাঝে তা সঞ্চারিত করতে পারছেন। রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন। আবার ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইয়েটস তা পেরেছেন। কারণ এটা হয়ে-ওঠার ব্যাপার। প্রকরণটি কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের যা জাতিক তাকেই কিন্তু আন্তর্জাতিক করতে হবে। আন্তর্জাতিক নিসর্গ, নদী-সমুদ্র ও মনস্তত্ত্বকে জাতিক করা যায় না। তার জন্য ভিন্ন করণকৌশল আছে, অন্য প্রতিভা আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র পড়ে বিদেশিরা মুগ্ধ হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হওয়ার ষোলো বছর আগে জীবনের কঠিন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আদ্রেঁজিত অনূদিত ফরাশি ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে ওকাম্পো কেঁদেছেন, শান্ততা আর সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন। কেন? কারণ জাতিককে আন্তর্জাতিক করার দক্ষতা রবীন্দ্রনাথের ছিল। মহৎ শিল্পী মানেই কিন্তু ভাবসাধক এবং রূপসাধক।
অনু হোসেন : রবীন্দ্রনাথের এমন কোনো গান কি আছে, যেটা আপনাকে সব সময় ভাবায়, মনে আসে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : রসাস্বাদনের প্রশ্নে আমি কিন্তু পরিস্থিতিবাদী। পরিস্থিতিবাদী মানে হল রাত বারোটায় কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কেবল বাইরের কুকুর ডাক শুনছি, আর কিছু নেই। তখন আমার ভালো লাগাটা একরকম। দুপুর রোদে ঘর্মাক্ত হয়ে পড়ছি তখন আমার গানের নির্বাচন আলাদা। শীতের আমেজের মাঝে গান নির্বাচনও আলাদা হয়ে যায়। কাজেই একটি গানের কথা আমি বলতে পারব না যেটা সব সময়ই আমাকে অনুরণিত করে।
অনু হোসেন : স্যার, যতদূর জানি আপনি তো অনেক সকালে ওঠেন। সকালটা আপনার কীভাবে শুরু হয়?
সৈয়দ আকরম হোসেন : সকালে উঠি, উঠতে হয়। তাড়াতাড়ি করে চলে যেতে হয় বাইরে। প্রয়োজনে, পারিবারিক কারণে।
অনু হোসেন : স্যার, একটি গান যেটি আপনার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : ‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,/আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা।’ এটা কেন বললাম একটু ব্যাখ্যা করি, এটা নিয়ে একটা প্রবন্ধও লেখা যেতে পারে। এখানে ‘আপন বেগে পাগল পারা’, গতির একটা তীব্রতা ধরা পড়ে, দৃশ্যমান হয়। আর স্তব্ধ চাঁপার তরু, সেও কিন্তু রাতে ফুল ফোটায়, কিন্তু গতি দৃশ্যমান নয়, নীরব নিভৃত গতি, তার গভীর চলা গোপন থাকে। কে জানে সে গতিকে? জানে শুধু রাতের শিশির। কী চমৎকারভাবে চিত্ররূপময়, প্রতীকায়িত হল রবীন্দ্রনাথের গতিতত্ত্ব। কিন্তু আমাদের অত ব্যাখ্যার দরকার আছে কি? এই যে ভালো লাগা, ওটাই আনন্দ। মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’ গানটির কথাও, মনে পড়ছে।
সরকার আমিন : অনু স্যার খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছে, এই যে আপনার ব্যক্তিগত দিনটা কীভাবে শুরু হয়। স্যার আমরা একটু আপনার পছন্দ জানবার চেষ্টা করছি। একটা মানুষ কীভাবে তার ব্যক্তিগত দিন শুরু করে। এখন আপনার দিনটা শুরু হয় কীভাবে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : বর্তমানে দিনটা শুরু হয় আমার অনেক ভোরে, আজানের ধ্বনিরও আগে। আমার ঘুমের কিছু ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য আছে। আমি আবার একনাগাড়ে এক ঘণ্টা ত্রিশ/পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি ঘুমাতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও কীসব স্মৃতি-ভাবনা জেগে ওঠে। ঘুম ভেঙে গেলে উঠি, হাঁটাহাঁটি করি, পানি খাই।
সরকার আমিন : স্যার, সারাজীবন এমন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : না। বছর পাঁচেক। উত্তরা আসার পর থেকে।
সরকার আমিন : কয় ঘণ্টা ঘুমান স্যার আপনি?
সৈয়দ আকরম হোসেন : সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা/সাড়ে চার ঘণ্টা। রাতে জেগে যাই, সে ঘুম আবার আসতে বেশিক্ষণ লাগে না। হয়তো ১০/১৫ মিনিট। সকালের দিকে খুব অবসাদ বোধ করি। ক্লান্ত মনে হয়। ঐ সময় বিছানায় শুয়ে ভাবতে খুব ভালো লাগে। অনেক কিছু ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু উপায় তো নেই।
অনু হোসেন : সন্ধ্যা?
সৈয়দ আকরম হোসেন : না, ভোরে। সন্ধ্যায়! আমাদের এখানে কিন্তু বাংলার স্মৃতিবিধুর কোনো সন্ধ্যা নেই। টি এস এলিয়টের কবিতার মধ্যে আছে, ডুবন্ত-সূর্যের সন্ধ্যাটিকে মনে হয়, ‘লাইক এ পেশেন্ট ইথারাইজ্ড আপঅন এ টেবল’। ঢাকার কংক্রিট কুয়াশা-ধুয়াশার সন্ধ্যাও তেমন হয়ে উঠছে, তাই না? ঐ ভোরটাই সম্বল। জানো অনু আমি কিন্তু খুব বেশি পড়ি না। আমি জানি বাংলাদেশের অনেক অনেক লোক আছেন, শিক্ষার্থী আছেন- যাঁরা অনেক অনেক পড়াশুনা করেন। তাঁদের দেখলে শ্রদ্ধা জাগে, বিশ্বাস জাগে ওইসব তরুণদের দিয়েই কিছু হবে।
অনু হোসেন : আপনি মাঝে মাঝে বলেন, যতটুকু পড়তে হবে তার চেয়ে বেশি ভাবতে হবে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : এটা কিন্তু আমার কথা না, গ্রিক দার্শনিকদের কথা, সাহিত্যতাত্ত্বিকদের ভাবনা। হোরেস, লঙিনুস- ওঁদের কথা। দিনে পড়ো রাতে ভাবো।
অনু হোসেন : কেন স্যার, বেশি ভাবলে আমরা কী পাব?
সৈয়দ আকরম হোসেন : জ্ঞান উদ্ভাবন করতে পারবে, মানবঅস্তিত্বের বিকশিত লূতাতন্তুজালের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পারবে, সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যকে উন্মোচন করতে পারবে। গ্রন্থ পথ দেখায়, কিন্তু অনুধ্যান আর তপস্যা মানুষকে জ্ঞানসৃষ্টিতে পারঙ্গম করে।
অনু হোসেন : নিজস্ব সৃজনশীলতার জায়গা?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, তোমার মস্তিষ্কের মধ্যে তো অনেক কিছুই সক্রিয়। হৃদয় বলে তো বুকে কিছু নেই, সবই মূলত মস্তিষ্কে, তাই না? এই চিন্তা-ভাবনাক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কিন্তু সব কিছু সৃষ্টি হয়, আবিষ্কৃত হয়। এই যেমন তুমি যখন জীবনানন্দ দাশ পড়ছ। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ দুটি পদের ব্যবহার- ‘রোমশ অন্ধকার’ তোমার ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করবে, জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করবে, বিশেষণে অন্ধকার হয়ে উঠছে জান্তব। নতুন বোধ, ‘রোমশ সময়’তো লাফিয়ে পড়তেই পারে জীবন-জোছনা-নিসর্গে। একটা নতুন বোধ-সংবেদনা উদ্ভাবিত হল নতুন চিত্রকল্পে, প্রতীকে। কী বুঝলে? অন্ধকার রাতে বিদ্যুচ্চমক যেমন চকিতে পৃথিবী-নিসর্গকে উদ্ভাসিত করে তেমনি, সৃষ্টির নতুন উৎসও অবারিত হয়।
সরকার আমিন : হুম্...
সৈয়দ আকরম হোসেন : তুমি যখন একটা প্রবন্ধ পড়ছ, পড়তে পড়তে দেখবে একটি সূক্ষ্ম উক্তি প্রবন্ধকার উপেক্ষা করে যাচ্ছেন, কিন্তু তার মাঝে থেকে যাচ্ছে নতুন সৃষ্টির এক অসাধারণ বীজ। কাজেই তুমি যখন ভাববে, অনুধ্যান করবে, তখন ওইসব অগ্রবীজ থেকে সৃষ্ট হবে বৃক্ষ, পুষ্প-ফল বৃক্ষ, তোমার ভাবনা থেকেও তৈরি হতে পারবে উত্তরাধিকারী অগ্রবীজ। অন্যের ভাবনা নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ করলে তাকে সৃষ্টি বলা যায় না।
সরকার আমিন : স্যার ফুলার রোডকে খুব মিস করেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : দেখো, আমি দ্রুত অতীতকে ভুলে যেতে পারি। আমাকে কিছুই স্পর্শ করে না। সত্যকে সহজে নেবার মানসিক প্রস্তুতি সবসময় থাকা উচিত। পরিণাম-উদ্বেগের কথা ভেবে কী হবে !...
সরকার আমিন : এটাই তো স্যার ‘বর্তমানবাদ’; ফিলসফি অব দ্যা মোমেন্ট...
সৈয়দ আকরম হোসেন : ক্ষণবাদী কখনো নয়। হয়তো বর্তমানবাদী। কেন জানি না। আমার মস্তিষ্কের গড়নটাই এমন, কিচ্ছু মনে থাকে না, পুরোনো দিনের বৈভব কিংবা বেদনা। সন, তারিখও বিস্মৃত হই। এজন্যই ইতিহাস অধ্যয়নে আমি দুর্বল। এই মনে না-থাকাটা কিন্তু ভালোই। মনে রাখার ক্ষমতা, তীব্রতা বেশি থাকলে মানুষ কিন্তু বেশি কষ্ট পায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; একা হয়ে যায়। নিজেকে সঙ্কুচিত করে নেবার একটা প্রবণতা তার মধ্যে তীক্ষ্ম হয়ে দেখা যায়। সামবায়িক জীবনে ব্যর্থ হয়।
অনু হোসেন : যখন স্যার, ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে আমরা পড়ি বা লিখি, বা উত্তেজিত হই- তখন আপনার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল আপনি বলেছিলেন এগুলো তো আমাদের বৈষ্ণব পদাবলিতেই আছে, রূপকথায় আছে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : আছে তো, আমাদের লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যেই আছে। রূপকথার কাঠামোর মধ্যে আছে। এজন্যই বলি যে, পড়া ভালো কিন্তু তাতে যদি নিজের স্বাবলম্ব-চিন্তনক্রিয়া রুদ্ধ বা পরজীবী হয়ে যায়, সেটা কিন্তু ভালো না। আমি আবারও বলি, বারবারই বলতে চাই যে পড়ো এবং তার চাইতে বেশি ভাবো। বিশ্বমানব-মননের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সবিচারে ‘উদ্ভাবনীক্ষমতাসম্পন্ন-প্রতিভা হতে হবে’- এভাবেই জন্ম নেবে সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞা; এবং তার বৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রবংশ।
অনু হোসেন : আপনার লেখালেখির একটা বড়ো জায়গা হল আপনার গদ্য যা একইসঙ্গে মৌলিক এবং সৃজনশীল। আবার আপনি বাংলাদেশের খ্যাতিমান একনিষ্ঠ গবেষক। একই সঙ্গে গবেষণায় একনিষ্ঠ আবার সৃজনশীল গদ্য ও চিন্তা- এটা কীভাবে এলো আপনার মধ্যে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার গদ্য সম্পর্কে কোনো ‘বিশেষণে’র দাবি নেই। যাহোক। রবীন্দ্রনাথের পরপরই যে গদ্যচর্চা- যেটা বলা যায় যে- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমেই সৃষ্টি ও প্রবর্তিত হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের গদ্য কেমন হবে? আমরা তখন প্রধানত একমাত্রিক সংবাদপ্রধান গদ্যের চর্চা করছি। মুনীর চৌধুুরী, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং আবদুল মান্নান সৈয়দেও অনুসৃত গদ্যের ধারা ছিল শীর্ণ ও ম্রিয়মাণ; এবং তা ছিল নন-অ্যাকাডেমিক। মনে হত যে অত্যন্ত সংবেদনশীল, আবেগী কিন্তু ভেতরে সব কিছু ধারণ করে স্থিতিস্থাপকগুণ-সম্পন্ন একটা পৌরুষদীপ্ত গদ্য আমাদের চাই। অর্থাৎ গদ্যের মধ্যে পৌরুষ থাকবে, অশ্রু থাকবে, উচ্ছ্বাস থাকবে- তবে হতে হবে বিষয়স্পর্শী, নিয়ন্ত্রণশানিত এবং শিল্পিত। আমার কাছে মনে হত কেন তা হবে না? এভাবেই অ্যাকাডেমিক- নন অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে আমার গদ্যচর্চার শুরু। এক সময়, জীবনের প্রথমে : বোধ হয়, বাঙালি সন্তান হিসেবে, বছর আটেক কবিতাও লিখেছিলাম।
অনু হোসেন : ৮ বছর।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ। এবং সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতায় আমার বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে; প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাতেও। পরে আমি কবিতা ছেড়ে দিলাম। কারণ শামসুর রাহমান এবং ফজল শাহাবুদ্দীন ‘কবিকণ্ঠ’-এর একটা বৃহদাকায় কবিতা সংকলন বের করেছিলেন, ষাটের দশকের প্রতিনিধি কবিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন । আমার একটা কবিতাও নির্বাচিত ও মুদ্রিত হয়। পরে মনে হল কবি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজটি আমাকে দিয়ে হবে না। আমার এখন ‘কবিতা’কে ছুটি দেওয়া উচিত। দিলামও। তবে আমি যেটা অর্জন করেছিলাম, তা হল- একটা সংবেদনময়দৃষ্টি, কবিতার ভেতর-গড়নস্পর্শের সামর্থ্য, কবিতার অনেকান্ত স্তরখননের আনন্দ, শব্দ-অলংকার-ছন্দ-চিত্র ও চিত্রকল্প-প্রতীকের আবিষ্কার-উৎসাহ।
সৃষ্টিশীল কিছু করতে গেলে, তা পদ্যই হোক বা গদ্যই হোক, তার ভেতরে কবিত্ববোধ থাকতেই হবে। এটা ছাড়া কখনই কোনো কিছু মৌলিক সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। গদ্যচর্চায় আমি সমন্বয়ের চেষ্টা করেছি। এর জন্য অনেকেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বিভাগীয় শিক্ষার্থীদের বলেছেন ‘আকরমীয় গদ্য’ কেন লেখ? ‘আজ তোমরা বলছ এই গদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল যিনি এই গদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন না’। বলা উচিত আমাদের গদ্য, বাংলাদেশের গদ্য। আমি হয়তো শুরুর একটা ভূমিকা পালন করেছি, অ্যাকাডেমিক নন-অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে। তারপরে কিন্তু সে নিজ স্টিমের শক্তিতেই গদ্যগাড়ি চলছে। কেউ যদি মনে করেন এটাই চলবে, তবে সেটা ভুল হবে। আমি হয়তো একটা প্রেরণা-পথ দেখিয়েছি, একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছি। পরবর্তীকালে গদ্যসচেতন সবাই কিন্তু নিজের মতো করে চেষ্টা করে চলেছেন, সেটাকে তাঁরা ক্রমবিকশিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
অনু হোসেন : আপনি যেটা বললেন যে, ভাষার চর্চার যে একটা সৃজনশীল গদ্য তৈরি করা, এটা একটা ক্ষমতা।
সৈয়দ আকরম হোসেন : ওই যে আমি আবারও বলছি আমি সৃজনশীলতার উৎসকে কোবিদ-শক্তি বলে মনে করি।
অনু হোসেন : কবি, তাহলে স্যার যাঁরা এই সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন গদ্য সৃষ্টি করছে...
সৈয়দ আকরম হোসেন : তুমি দেখবে যাঁরা পৃথিবীতে ভালো কাজ করেছেন, আমাদের বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও সত্য, তাঁদের প্রত্যেকের সৃজনশীল কোবিদ-প্রতিভা না থাকলে সম্ভব হত না। মনে রাখতে হবে যে, তুমি যে সব বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে সবটা যে অঙ্কুরিত হবে, তা কিন্তু নয়। কারণ একটা প্রকৃতির দৃষ্টান্ত দেই, ফাল্গুন মাসের শেষে আম গাছে যে বিলিয়ন-বিলিয়ন মুকুল আসে। সমস্ত মুকুলেই যদি আম হত তাহলে গাছের কী দশা হত?
অনু হোসেন : গাছ ভেঙে পড়ত।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, প্রকৃতিই নির্ধারণ করেছে সবটাই আম হয় না। নিসর্গ আমাদের বড়ো লজিক, মহৎ গ্রন্থ। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন, ‘কেউ কেউ কবি’। তবে আমাদের মহত্তর সাধনা থাকতে হবে। জীবন হতাশাকে অনুমোদন করে না।
সরকার আমিন : স্যার আমি যেটা বুঝতে পেরেছি যে, আপনার যে থিসিস, যেটা দিয়ে আপনি পিএইচ ডি ডিগ্রি পেয়েছেন- ওটাই বোধ হয় আমাদের প্রথম সৃষ্টিশীল গবেষণা গদ্য।
সৈয়দ আকরম হোসেন : ইতিহাস যদি স্বীকার করে, তাহলে তাই।
সরকার আমিন : এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আপনি কেন করতে গেলেন, এটা পরীক্ষক সমর্থন করবেন কি না, আপনি ডিগ্রি পাবেন কি না- অনিশ্চয়তা তো ছিল, ঝুঁকির ব্যাপার ছিল?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার শুভানুধ্যায়ী অনেকেই আমাকে না করেছিলেন। ভাবলাম, কী হবে, জীবনে একটা পিএইচ ডি ডিগ্রি হবে না, এর বেশি তো আর না। কিন্তু দায়িত্ব কাউকে-না-কাউকে তো নিতে হবে। তুমি যদি একটা নতুন কিছু করতে চাও, তাহলে তোমাকে তো ঝুঁকি নিতেই হবে। আমার থেকে আমি তো আলাদা হতে পারি না। তুমি কি পার, স্রোত থেকে গতিকে ছিন্ন করতে।
সরকার আমিন : স্যার পরীক্ষক কারা ছিলেন ?
সৈয়দ আকরম হোসেন : এখানে এক ধরনের স্বাধীনতা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম। নীলিমা আপা। তিনি কখনই আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেননি। মাস্টার্সের থিসিসটা, ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : দেশকাল ও শিল্পরূপে’র কারণে আমার উপর আপার আস্থা ছিল। বিশ্বাস করতেন, আমি পারব। বাংলাদেশে আমার পরীক্ষক ছিলেন, তিনিও গদ্যসচেতন ব্যক্তি ছিলেন, কবি-প্রাবন্ধিক ও গবেষক সৈয়দ আলী আহসান।
অনু হোসেন : উনার ভাষা তো এমনই।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হুম, সৃষ্টিশীল ভাষা। আর একজন ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য, অধ্যাপক দেবীপদ ভট্টাচার্য। এই দুজন আমার অভিসন্দর্ভের পরীক্ষক ছিলেন। আহ্বায়ক-পরীক্ষক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। তত্ত্বাবধায়ক-পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম। ডিগ্রি অর্জিত হল।
পরবর্তীকালে অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করা নিয়ে আছে অনেক কাহিনি। বাংলা একাডেমি আমার গ্রন্থ প্রকাশ করেনি। তখনকার পরিচালক ৭৯/৮০ সালের দিকে, আমাকে আন্তরিকভাবে প্রকাশে অপারগতা জানান। অন্য এক নামী প্রকাশক লিখিতভাবে জানালেন, আপনি সহজ করে লিখে দিলে হয়তো প্রকাশ করা যেতে পারে। এমন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এগুলো হয়ই। যা হোক, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা বিভাগ, অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করা যাবে কি না- অভিমতের জন্য মনস্বী অধ্যাপক ডক্টর এনামুল হককে দায়িত্ব দিলেন। এনামুল স্যার অভিমতে লিখেছিলেন : অভিসন্দর্ভটি আমি আদ্যপান্ত পড়ে দেখেছি এর কোথাও কোনো ভাষাগত ত্রুটি নেই। আরো অনেক কথা লিখেছিলেন। তা নথিবদ্ধই থাক। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস : চেতনালোক ও শিল্পরূপ প্রকাশ পায় ২৫ বৈশাখ ১৩৮৮ সনে, মে ১৯৮১।
তারপর বইটি পশ্চিম বাংলায় গেল। পূর্ণেন্দু পত্রী পৃথক প্রবন্ধ লিখলেন, তারপর দেবেশ রায় তাঁর সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বিশদভাবে তা প্রকাশিত হয়। ভূদেব চৌধুরী, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অশ্রুকুমার সিকদার, পবিত্র সরকার, শঙ্খ ঘোষ, আবদুল মান্নান সৈয়দ-সহ অনেকে অভিনন্দন জানালেন, কেউ কেউ প্রবন্ধও লিখেছিলেন।
অনু হোসেন : শঙ্খ ঘোষ তো বাংলা একাডেমিতে বলেই গেলেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এটি দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ গবেষণার কাজ।
সৈয়দ আকরম হোসেন : তোমরা জানো, আমি শুনেছি। ‘গল্পগুচ্ছ’-বিষয়ে ডায়াক্রনিক-সিনক্রনিক পদ্ধতির মিথস্ক্রিয়ায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলাম। ‘উৎস থেকে স্রোতস্বতী’, ‘গল্পগুচ্ছের প্রকরণ : কতিপয় মোটিফ’, ‘গল্পগুচ্ছে নিসর্গ : রূপ-রূপান্তর’ অর্থাৎ মেঘ-বৃষ্টি, অন্ধকার ও বৃক্ষের- চিত্ররূপময় ও চলচ্চিত্রময়, প্রতীকী এবং অবজেটিভ কোরিলেটিভ হিসেবে কী বিপুল বৈচিত্র্যে উপস্থিত, তার দৃষ্টান্ত বিশ্লেষিত হয়েছে। ওখানে ভাষারও কিছু পরীক্ষা ছিল।
সরকার আমিন : কিছুটা ফিল্মি ল্যাংগুয়েজ।
সৈয়দ আকরম হোসেন : রবীন্দ্রগল্পের বিন্যাসেই তো ফিল্মসেন্স রয়ে গেছে। ওই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল- অ্যাঙ্গেল, ফ্রেম, রং আর আলোর গভীরতার-তারতম্য, কবিতা ও চলচ্চিত্রের আন্তরক্রিয়া, স্থান-কাল ও মনতাজ ইত্যাদি। ফলে গল্পগুলোর গঠন-মনোগঠন বুঝতে আমার সুবিধা হয়েছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছে’র এক জায়গায় আছে, ‘সে অন্ধকারের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল’। ভাবতে পারো যে একটা অন্ধকারের মধ্যে আরো কালো অন্ধকার। এটা টোনাল ডিফারেন্স। দূরের আকাশ আঁকতে গেলে পেন্সিলের হালকা-রং ব্যবহৃত হয়। একটা গাছের গোড়ার আলো-আঁধার আঁকতে শিল্পী কিন্তু পেন্সিলের কালো রং ব্যবহার করেন। এটা টোনাল ডিফারেন্স। বর্ণগভীরতার তারতম্য। রবীন্দ্রনাথ কবি এবং চিত্রশিল্পী বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
অনু হোসেন : স্যার আমরা এবার একটু আপনার গবেষণার ক্ষেত্রে নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনি গবেষণার দুটি জায়গায় এস. ওয়াজেদ আলি ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বেছে নিয়েছেন কেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : প্রথম কারণটা হল, আমার কাছে দীর্ঘকাল যাবৎ মনে হত যে বাঙালি মুসলমান যারা, তাদের প্রগতিশীলতার যে প্রান্ত- ধর্ম বিষয়ে কতটুকু আধুনিক, শিল্পতত্ত্বে কতটুকু আধুনিক, কথাসাহিত্য ও ভাষারীতিতে কতটুকু স্বতন্ত্র ছিলেন, তার দৃষ্টান্ত এস. ওয়াজেদ আলি। যিনি স্কুল জীবনে ‘ইংলিশ মিডিয়ামে’ পড়াশুনা করেছেন। তারপর কেম্ব্রিজ থেকে বিএ এবং ব্যারিস্টারি পাশ করে, আইনজ্ঞ হিসেবে ফিরে আসেন ভারতবর্ষে। তিনি কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি হসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
দেশে ফেরার পথে জাহাজে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তখন তো জাহাজে এক মাস, দেড় মাস লেগে যেত দেশে ফিরতে। প্রমথ চৌধুরী বললেন, তুমি তো কিছু লেখ না। ওয়াজেদ আলি বলেন, লেখার একটা জায়গা বের করো। তখন প্রমথ চৌধুরী বললেন যে, আমি তো গিয়ে একটা পত্রিকা বের করব। বুঝতেই পারছ এটা ‘সবুজপত্র’। তখন উনি বললেন যে ঠিক আছে, তাহলে আমি বলছি যে আমি লিখব। এস. ওয়াজেদ আলি সবুজ পত্রে লেখেন চলিত গদ্যের ‘অতীতের বোঝা’ বলে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ। পরে নিজেই ‘গুলিস্তাঁ’ বলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। পত্রিকাটি ছিল অসাম্প্রদায়িক। এর পর তিনি লিখেছেন ছোটোগল্প ও প্রবন্ধ। আধুনিক সাহিত্য-শিল্পবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন একাধিক। এগুলো আমরা বিস্মৃতপ্রায় ছিলাম। তখন মনে হল, আমাদের ভিত্তিটাকে পাকাপোক্ত করতে হলে ঐতিহ্যটাকে সজাগ রাখতে হবে, শক্ত পাথরের উপর দাঁড় করাতে হবে। তো, বছর তিনেক অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে। যা স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমি থেকে দু-খ-ে প্রকাশিত হয়। একইসঙ্গে, একই সময়ে প্রায়, আমি সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেছিলাম বাংলাদেশের আধুনিক ছোটোগল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার,
চিন্তাবিদ যাকে আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে নতুন ব্যাখ্যায়, যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব। মানে ভিত্তিটা। তখন আমি অনুসন্ধান করলাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনাবলি, নানা জায়গা থেকে, ‘পূর্বাশা’ পত্রিকা থেকে, বাংলাদেশের পুরোনো কলেজের গ্রন্থাগার থেকে। উপন্যাসগুলোর যথার্থ পাঠ নির্দেশ করি, বিকৃত পাঠ শনাক্ত করি। যে গল্পগুলো আমি নতুন অন্তর্ভুক্ত করেছি তাতে তিনটি গল্পের বই আরো হতে পারত। শেষ পর্যন্ত সেটাও বংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছিল ১৯৮৫ সালে। পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমি তার নীতিগত কারণের জন্যই হোক বা যে কারণেই হোক, দুষ্প্রাপ্য হলেও তা পুনঃপ্রকাশ করেনি। ওই দুজনকে নির্বাচনের মূল কারণ হল কিছু আমাদের দৈশিক, কিছু জাতীয়তাবোধ। আমাদের বাঙালি মুসলমানসমাজ-বোধ যে আধুনিকতার গভীরে ছিল, সেই শেকড়টা শনাক্ত করা। এই কারণের জন্য ওই দুজনকে গবেষণার বিষয় হিসেবে নির্বাচন করি।
অনু হোসেন : সম্পাদনার ক্ষেত্রেও আপনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে পরিশ্রম করে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি ত্রিশ খণ্ডে সম্পাদনা করেছেন। সেখানে স্যার আপনার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। কী নতুনত্ব পাঠক সেখানে পাবেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : মোটকথা, ঐ আবার ১৯৬৮ সালেই যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, বিশ্বভারতী যা করেছে ঐ সময় এর চেয়ে ভিন্ন কিছু করা সম্ভব ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রচনাবলীর আটটি খণ্ড বেরিয়েছে। অচলিত সংগ্রহ প্রথম খণ্ডসহ। ওটা পড়তে গিয়ে দেখতাম যে রবীন্দ্রনাথ ষোলো বছর বয়সে কবিতা লিখছেন, কিন্তু পাশাপাশি এই তথ্যটা পাচ্ছি না একই সময় তিনি শেলি, কিটস, বায়রন, হাইনে অনুবাদ করছেন; তিনি ম্যাকবেথ-এর অংশবিশেষ অনুবাদ করছেন। এই সমস্ত তথ্য কিন্তু বয়ঃক্রম অনুসারে সন্নিবেশিত হয়নি। তখন আমি চিন্তা করলাম যে যদি রবীন্দ্রসাহিত্যের কখনও পুনঃসম্পাদনার প্রশ্ন ওঠে তাহলে কয়েকটা দিক স্পষ্ট করা দরকার। একটি হল- সমগ্র রচনাবলিকে প্রকাশক্রম অনুসারে পুনর্বিন্যাস করা। বিশ্বভারতী রচনাবলীর অন্তর্ভুক্ত বিষয় প্রকাশ-ক্রমানুসারে সাজিয়েছি- এ হল বিন্যাস প্রক্রিয়া। আর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন যা আগে বিশ্বভারতী রবীন্দ্র-রচনাবলীতেও ছিল না- সেগুলো হল, প্রথমত চিঠিপত্র, যেমন; ছিন্নপত্র, ছিন্নপত্রাবলী। বিশ্বভারতী রবীন্দ্র-রচনাবলীতে ১৯ খণ্ডে চিঠিপত্র ছিল না, ভানুসিংহ ঠাকুরের পত্রাবলী ছিল না, এগুলো সবই সংযুক্ত করা হয়েছে রবীন্দ্র-রচনাবলিতে। প্রতিটি পত্র শেষে প্রয়োজনীয় তথ্য-টীকা সংযোজন করা হয়েছে। এটা সবচে কঠিন কাজ ছিল। ওখানে পত্রতথ্যাবলি বইয়ের শেষে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এক খণ্ড তো ছিল তথ্যবিহীন। আমি যেটা করেছি সেটা হল প্রত্যেকটা চিঠির নিচে ঐ চিঠির মধ্যে ১ ২ ৩ ৪ করে যে প্রাসঙ্গিক উৎসগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। আর আরো বিস্তৃত তথ্যের জন্য বলা হয়েছে গ্রন্থ পরিচয় দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা নম্বর ‘অত’। এই হল চিঠির বিষয়। তারপরে আমার মনে হল, ‘গীতবিতান’ কেন রচনাবলিতে থাকবে না? গীতবিতানও তখন এর মধ্যে সংযুক্ত হল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে, ইংরেজি রচনা ছাড়া বাংলায় মুদ্রিত রবীন্দ্রনাথের এ যাবৎ কালের প্রাপ্ত সব লেখা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অনু হোসেন : সব লেখাই এখানে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : এ যাবৎকালে প্রাপ্ত সব লেখাই এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকাশক্রম অনুসারে বিন্যাস করা আছে। এর বাইরে যেটা বিশ্ব ভারতী খ- আকারে প্রকাশ করেনি। তা হল রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে যে চিঠি লিখেছিলেন, মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে লিখেছিলেন- তা অন্তর্গত করা হয়েছে। ওগুলো মৈত্রেয়ী দেবী প্রণীত ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ গ্রন্থের মধ্যে মুদ্রিত আছে। ওখান থেকে পত্রগুলো রচনাবলিতে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যাতে পাঠকের ওখানেও দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হয়। আর অন্য কথা হল, আমাদের দেশের মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা পড়তে চায়। ঘর সাজানোর জন্য নয়, পড়তে চায়, দেখতে চায়। আমার মনে হয়েছে যে এত টাকা খরচ করে রবীন্দ্রনাথের পেইন্টিংস, সংগ্রহে রাখা কঠিন। এজন্য আমরা কমপক্ষে দুশো আঠারোটি রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত প্রতিনিধিত্বমূলক রঙিন ছবির রিপ্রোডাকশন ছেপেছি। ছবির নিচে আমি টাইটেল সংযুক্ত করিনি। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই এর বিরোধী ছিলেন। আর রবীন্দ্র-রচনাবলির জন্য স্বতন্ত্র কাগজ তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। তাতেই ছাপা হয়েছে সবটাই। আর প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনা হয়েছে, সেটি হল প্রত্যেকটা খণ্ডের, বাম পাশের ফ্লাপে রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্রপ্রদর্শনীর স্বাক্ষর আর ডান পাশের ফ্লাপে প্রত্যেকটাই আলাদা আলাদা ইমেজ। কোনোটা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা, কোনোটা রামকিঙ্করের তৈরি রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য, রোদেনস্টাইনের আঁকা রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি, চৈনিক ভাস্কর্য, জাপানি শিল্পীর আঁকা প্যরট্রেট এবং লন্ডনে যে ভাস্কর্য আছে, মস্কোতে যেটা আছে, চীনে যেটা আছে- সবই আলাদা আলাদা করে শিল্পীর নামসহ বিন্যস্ত । যদি রচনাবলি কেউ নাও পড়ে, শুধু ফ্ল্যাপগুলো দেখে যায়, তাহলে বুঝতে পারবে রবীন্দ্রনাথের [ভ্যাঙ্কুভার থেকে জাপান, শ্রীলংকা থেকে রাশিয়া] বিস্তৃতি ছিল, এই বিশ্বের কতদূর।
অনু হোসেন : রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশক্রম অনুসারে দেওয়ার কারণে পাঠকের বা গবেষকের নিশ্চয় পাঠসহায়তা সৃষ্টি হবে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, এটাই আমি বলছি। গবেষণা করতে গিয়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছিল, যে এই পুনর্বিন্যাসটা প্রয়োজন। কারণ রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন, ‘কড়ি ও কোমল’, বা তার আগে যখন তিনি ‘কবি-কাহিনী’, ‘ভগ্নহৃদয়’ বা এ জাতীয় কিছু লিখছেন ঐ সময় যে তিনি অনুবাদ করছেন, ঐ অনুবাদ হল শেলি, কিটস বা বায়রন এই সব রোমান্টিক কবিদের। তো এর ফলে যে তার মধ্যে হচ্ছে রাসায়নিকসংশ্লেষ হচ্ছিল, এগুলো তো আমরা বুঝতেই পারছিলাম না- ওগুলো কী করে হল। রবীন্দ্রনাথ সেসময় ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পর্যন্ত লেখার কথা বলেছেন। এ সময় তিনি লেখেন : ‘স্যাক্সন জাতি ও অ্যাংলো স্যাক্সন সাাহিত্য’, ‘নর্মান জাতি ও অ্যাংলো নর্মান সাহিত্য’, ‘বিয়াত্রীচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য’, পিত্রার্ক ও লরা’, এবং ‘গ্যেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ’। প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। এত অল্প বয়সে তিনি এত পড়াশুনা করেছেন। তার বড়ো প্রমাণ, ১৬ বছর বয়সেই তাঁর রচিত ‘মেঘনাদবধকাব্য’ প্রবন্ধটি। ভেতরের ক্রস রেফারেন্সগুলো দেখলেই বোঝা যাবে যে কতদূর তাঁর পড়াশোনার বিস্তার ছিল। তাঁর সৃজনশীলতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখছেন কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক। রবীন্দ্রনাথের প্রবাস-ভ্রমণ, বাইরের যে দিকটা, যাকে আমি বলছি দেশকাল, এই দেশকালের কনসেপ্ট- তার ভেতরের যে অস্তিত্বর প্রকাশ, বস্তুর যে চৈতন্য, দর্শন, ভাবনা, ভালোলাগা মন্দ লাগা- এর যে শব্দরূপ দেয়া বা যাতে দক্ষতার কথা প্রথমেই বলেছিলাম এগুলো সম্ভবপর হয়েছে- ক্রমবিকাশগত পরম্পরায়। রবীন্দ্র-রচনাবলিতে এখন ক্রমবিকাশ-পরম্পরা, মিথস্ক্রিয়া- আরো ভালো করে বোঝা পাঠকের জন্য সম্ভব হবে। রচনাবলি পুনর্বিন্যস্ত হওয়ার কারণে।
অনু হোসেন : গবেষণার ক্ষেত্রে যাই। আপনার কাছে যারা গবেষণা করতে আসেন, পিএইচ ডি করেন, তাদের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে গবেষকের না আপনার নিজের পছন্দ কাজ করে। জানা যায়, গবেষক একটা ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে আসেন আর আপনি ভিন্ন বিষয় বাছাই করেন গবেষণার জন্য। কারণ গবেষণার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বা বিরুদ্ধ মানসিকতা দরকার- এমন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : কারণটা জটিল কিছু না। দুটো জিনিস ভাবতে হয়, ধরো যে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কী গবেষণা হয়েছে? আমাদের কিছু বাকি আছে কি না। দ্বিতীয়ত, গবেষকের বিষয়ানুভূতি, ভাষিক দক্ষতা এবং তাঁর চেতনার মৌল ভিত্তিটাকে শনাক্ত করা। সরকার আমিনের গবেষণার বিষয় চিত্রকল্প নির্বাচনের কারণ, সরকার আমিনের যে কবিতাগুলো আমি আগে পড়েছি, সেখানে তার চিত্রকল্পময় প্রকাশ-মানসিকতা স্পষ্ট ছিল। এই যে আধুনিক শব্দগুলো দিয়ে কাব্যবীজ তৈরি করা এটা সরকার আমিনের মধ্যে এক সময় ছিল, এখন পাল্টেছে। এজন্য ওকে চিত্রকল্পবিষয়ক গবেষণার বিষয় দেয়া। তত্ত্বাবধায়ক বিশ্বজিৎ ঘোষও তা সমর্থন করে। আবার কোনো কোনো সময়, যেমন মাহবুব সাদিক, একদিন আমি তাকে জোর করে নিয়ে এসেছিলাম গবেষণা করানোর জন্য। ও ভালো ছাত্র ছিল, ভালো কবিতা লেখে, গল্প লেখে- এদের দিয়ে কিছু করা সম্ভব হবে। সে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল। ওর ইচ্ছে ছিল জীবনানন্দ দাশ নিয়ে গবেষণা করবে কিংবা সুধীন দত্ত। বললাম, জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ কাজ করছে। সুধীন দত্তের উপরে সিদ্দিকা মাহমুদা গবেষণা করছে। বেগম আকতার কামাল বিষ্ণু দের উপর থিসিস করছে। তখন আমার মনে হল, আমাদের এখানে যে লোকটি স্মৃতিময়, বুদ্ধদেব বসু তার উপরে কিন্তু কোনো গবেষণা হয়নি। ওই সময় শুধু এখানে নয় পশ্চিমবঙ্গেও কেউ পিইচ ডি করেনি বুদ্ধদেব বসু বিষয়ে। তখন তাকে ‘বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ও শিল্প প্রকরণ’ বিষয়ে আমিই তাকে তত্ত্বাবধায়ন করলাম। যেমন, ভীষ্মদেব চৌধুরী। প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমি কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক নই। আমি অপ্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক। এটা উপযোগিতা থেকে এসেছে। আর আমার সবচে বড়ো আনন্দ যে আমার শিক্ষক, কবি, অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আমার প্রতি তাঁর অপরিমেয় আস্থা ছিল। স্বাধীনতার পর আমাদের এখানে সাংস্কৃতিক জগৎ এবং তার পরে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে হঠাৎ-একটা শূন্যতার সৃষ্টি হল, শুধু শিক্ষকতার ক্ষেত্রে নয়, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে শূন্যতা, রেডিওর ক্ষেত্রে শূন্যতা, বিভিন্ন জায়গায় সংযুক্তি-সমন্বয় করবার ক্ষেত্রে শূন্যতা, বক্তৃতা করবার ক্ষেত্রে শূন্যতা, সেখানে আমাদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি আমার উপরে আস্থা রাখতেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাহিত্য পত্রিকা’র ১৩ বছর সহযোগী সম্পাদক ছিলাম। মনিরুজ্জামান স্যার কিন্তু কখনও কোনো ব্যাপারে বাধার সৃষ্টি করেননি। স্বাধীনতা দিতেন আমাকে তাঁর পিএইচ ডি গবেষকদের নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তখন ভীষ্মদেব চৌধুরীকে আমি বললাম, ‘তোমার ইচ্ছাটি জানতে চাইছি’। আমি ওর বাবা সম্পর্কে জানি অবনীকান্ত রায়চৌধুরী, ‘জলসাঘর’ এর বিশ্বম্বর রায়চৌধুরীর মতো একটা আভিজাত্য আছে। তখন তাকে বললাম তোমার বাবা... তখন তারাশঙ্করের বিষয়টা তাকে নির্বাচন করা হল। তারপর রফিকউল্লাহ তো স্পষ্টই বলল, সে আমাকে ছাড়া গবেষণা করবে না। জীবনে তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই পিএইচ ডি-র। বাংলাদেশের সাহিত্যকে তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তখন বাংলাদেশের উপন্যাস বিষয়ে রফিকউল্লাহর গবেষণার আমিই সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নিলাম। অন্যদিকে আর একজন বিশ্বজিৎ ঘোষ, সে কী করবে? তখন আমি তাকে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে নৈঃসঙ্গ্য চেতনার বিষয়টি, ত্রিশ-উত্তর পর্যায়ের বিচ্ছিন্নতার অপরতার- বিষয়টিই ওকে বুঝিয়ে দিলাম। তখন ঢাকায় এসেছিলেন...অমর একুশের বইমেলায়।
অনু হোসেন : ওহ্ অশ্রুকুমার সিকদার।
সৈয়দ আকরম হোসেন : হুম্। অশ্রুকুমার সিকদার বললেন যে, বিশ্বজিৎ তোমার এই বিষয়ে কী গবেষণা করবে? বিশ্বজিৎ বললেন, আকরম স্যার তো এটা দিয়েছেন, আমি কী করব? তখন উনি বললেন, আকরম যখন দিয়েছেন, দেখো ভালোই হবে বোধহয়! তবে বিশ্বজিতের আমার উপর পূর্ণ আস্থা ছিল। ও কখনো হতাশ হয়নি। তারপরে যে সময় বিশ্বজিৎ পিএইচ ডি-র পর ওর থিসিসটা পাঠিয়েছে, তখন অশ্রুকুমার সিকদার চিঠিতে জানিয়েছিলেন, আমি দুঃখিত, আসলে সব ব্যাপারেই পিএইডি হতে পারে। ট্রিটমেন্টটাই আসল। অশ্রুকুমার সিকদার ২০০০ সালে চোখের দুটি তারা : দুই বাংলার কবিতা গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ‘বন্ধু সৈয়দ আকরম হোসেন ও তাঁর শিষ্যম-লীকে’। তোমরাও তার অংশীদার। যা বলছিলাম- একসময় ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক মোহাম্মদ জয়নুউদ্দীন আমার কাছে এসে বলল, ও পিএইচ ডি করতে চায়। আসলে যারা পিএইচ ডি করতে চায় তারা অনেক বড়ো বড়ো কিছু বিষয় নিয়ে আসে। আমাদের যিনি তত্ত্বাবধায়ক বা যিনি বিষয় ঠিক করছেন, আগেই বলেছিলাম যে, তাকে বুঝতে হবে গবেষণাপ্রার্থীর মানসিক ও অ্যাকাডেমিক দক্ষতা কতটুকু। আমি তাকে বললাম, এক কাজ করো বাংলাদেশে মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম নিয়ে আজ পর্যন্ত পিএইচ ডি পর্যায়ে গবেষণা হয়নি। এটা এক অর্থে আমি মনে করি আমাদের ব্যর্থতা এবং অপরাধ। তুমি মুনীর চৌধুরী উপর কাজ করো। এভাবে কখনো কখনো জাতীয় চেতনা থেকে, কখনও কখনও আমাদের ব্যক্তিত্বকে উন্মোচন করানোর জন্য, কখনও কখনও বাংলা ভাষারীতির পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে যে আমরা অনেক আধুনিক এবং এগিয়ে আছি, এটাও প্রমাণের একটা ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল, এভাবে বিষয়গুলো ভেবেছি।
সরকার আমিন : ফোকলোর নিয়ে বোধহয় আপনি কাজ করিয়েছেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, আমি তো অনুকে তাই করিয়েছি। কারণটা হল ওই, এখানে একটা অন্য বিষয় আসবে। তোমাদের বোধ হয় মনে আছে, আমাদের এখানে একসময় উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্র্ক হত। অনেকে নানা বই হাতে চলাচল করত। কিন্তু তত্ত্ব কোনো পদ্ধতি নয়। প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতে হবে যে আমরা কীভাবে একালে ফোকলোরকে আমাদের কবিতার মধ্যে পুননির্মাণ করছি, আধুনিক চৈতন্যের মধ্যে নিয়ে আসছি, কখনো প্রতীক আকারে আনছি, কখনো চিত্রকল্পের রূপবন্ধে আনছি, কখনো ন্যারেটিভ আকারে আনছি, এটা যদি আমরা না-উদ্ভাবন করি, কেবলমাত্র তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে কিন্তু কোনো মোটিফকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তখন অনেকের কাছে মনে হত উত্তর-আধুনিকতা না থাকলে সাহিত্যকর্ম সর্বসাম্প্রতিক হল না।
সরকার আমিন : এখানে স্যার একটা সুপরিকল্পিত থিম সব সময় মাথায় কাজ করত।
সৈয়দ আকরম হোসেন : শোনো, এটা যদি তুমি পারিবারিক জীবন পরিচালনা করতে চাও, একটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প কিন্তু তোমার মাথায় থাকবে। যাই কিছু তুমি করতে চাও একটা সুপরিকল্পিত বিষয় তোমার মস্তিষ্কে থাকতে হবে। তার মধ্যে একটা ইতিহাস থাকবে, তার মধ্যে একটা বর্তমানতা থাকবে এবং তার মধ্যে একটা ভবিষ্যৎ থাকবে। এই পরিকল্পনার ছকেই কিন্তু সব কিছু হওয়া উচিত।
অনু হোসেন : স্যার আপনি দীর্ঘদিন সম্পাদনা এবং গবেষণার বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাহিত্য পত্রিকা’ সম্পাদনা করেছেন সম্ভবত ১৩ বছর...
সৈয়দ আকরম হোসেন : ১৩ বছর সহযোগী সম্পাদক ছিলাম। সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্যার।
অনু হোসেন : বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা।
সৈয়দ আকরম হোসেন : পরবর্তীকালে যখন আমি বিভাগের চেয়ারম্যান, তখন ‘সাহিত্য পত্রিকা’র সম্পাদক জ্যেষ্ঠতানুসারে তিন বছর পরপর পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তখন আমি আর সম্পাদকের দায়িত্ব নিইনি।
সরকার আমিন : তবে স্যার একটা বিস্ময়কর ঘটনা আমরা দেখি ও সময়ের একেবারে তরুণতর লেখকরা লিটল ম্যাগাজিন করেছে এবং অদ্ভুত অদ্ভুত সব নাম। আমি দেখলাম আপনার শিক্ষক জীবনের শেষ দিকে আপনার ছোটোকাগজ বের করবার পরিকল্পনা যখন আমার শুনলাম তখন আমরা একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। মানে খাদি খদ্দরের পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত, এই প্রতিষ্ঠানিক পোশাকের সঙ্গে যেন লিটল ম্যাগাজিন খুবই সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছিল। আপনি সেই কাগজটা বের করলেন এবং ছোটোকাগজ সম্পাদকদের সাথে যেন প্রতিযোগিতা করেই নামটাও বেরিয়ে আসল ‘উলুখাগড়া’, এটার ইতিহাসটা জানতে চাই স্যার।
সৈয়দ আকরম হোসেন : ইতিহাস মানে, আমি একটা জিনিস সব সময় বিশ্বাস করতাম, যার জন্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক আন্তরিক ও গভীর ছিল। কারণ আমি মনে করি, একজন মানুষকে যদি সাম্প্রতিক বা সর্বসাম্প্রতিক হতে হয় তাহলে তরুণদের সঙ্গে আন্তরক্রিয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর তারুণ্যের উত্তাপ, তার শব্দ, তার বক্তব্য, তার ছন্দ, তার ন্যারেটিভ এগুলো যদি বুঝতে হয় তাহলে একটা পত্রিকার মধ্যে যে তরুণরা লেখে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তুমি লক্ষ করে দেখেছ ‘উলুখাগড়া’র বিপুল পরিসরে তরুণদের লেখা ছাপা হত। একেবারে তরুণ, অন্য কোথাও তার লেখা মুদ্রিত হয়েছে কি না আমরা তাও জানতে চাইনি। নামও অপরিচিত, তবু গুণগত কারণে আমরা তাদের লেখা ছেপেছি। এ ব্যাপারে নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ সালেকীনের উৎসাহ ও কৃতিত্ব অতুলনীয়। ঘোষণা দিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়া এবং ঘোষণা দিয়ে তরুণ হওয়া নিষ্প্রয়োজন। তোমার ভেতরে যদি বহমান তারুণ্যাবেগ এবং তরুণের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে কিন্তু এটা হয়ে যায়।
সরকার আমিন : স্যার, এমন হয় না যে মানুষের একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। হয়তো সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা যখন তার মধ্যে থাকে, সেটা বিশ্বাস আকারে থাকে, ফলে দৃঢ় হয়। অবিরাম বা এমন কিছু বাস্তবতায় এই বিশ্বাসটা নড়বড়ে হয়, ভেঙে যায়, নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়। আপনার জীবনে কি এই ধরনের ব্যাপার ঘটেছে যে আপনি আপনার বিশ্বাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন ।
সৈয়দ আকরম হোসেন : বিশ্বাস?
সরকার আমিন : দৃষ্টিভঙ্গিগত বিশ্বাস।
সৈয়দ আকরম হোসেন : বিশ্বাস। প্রাকৃতিক নিয়মের বিষয়টাকে যদি তুমি অবলম্বন করো, তাহলে এমনভাবে ধাক্কাটা খেতে হয় না। যেমন, একটা মানুষ, অস্তিত্বশীল মানুষ, সে একটা পারিপাশ্বিকতার মধ্যে অবস্থান করে। তার মনের মধ্যে অনেকভাবে চিন্তা, অভিজ্ঞতা কাজ করে। সংযুক্ত সবকিছু তাকে একটা জায়গায় জোয়ার-ভাঁটার সন্ধিক্ষণের মতো স্থির থাকতে বাধ্য করে। তার পরে তার পরিবর্তনটা সূচিত হয়। ওই বিশ্বাসান্তরের মধ্যেই কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে তোমার পরিবর্তনটা সদর্থক, নাকি জনজীবনের বিরুদ্ধে, নাকি মানবীয় সভ্যতার বিরুদ্ধে? এই মানদণ্ডেই বিশ্বাসকে পরীক্ষা করতে হয়।
অনু হোসেন : [হাসি]
সরকার আমিন : স্যার আর একটা প্রশ্ন করব, সেটা এই সুযোগে করে ফেলি, সেটা হল যে প্রতিটি মানুষের একটা জীবনদর্শন থাকে। গোপনে থাকে। এটা যদি খুব সহজে বলি, স্যার আমাদেরকে বলেন আপনার জীবনদর্শন কী?
সৈয়দ আকরম হোসেন : জীবনদর্শন মানে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। মৃত্যুটা আমার একটা ব্যক্তিগত বিষয়। আমার যখন মৃত্যু হবে- তখন আমিই মরে যাব, থাকব না। তাহলে আর কী কী থাকবে? থাকবে মানবপ্রবাহ, জীবনপ্রবাহ, প্রাণীবংশ, নিসর্গপ্রবাহ। আমি থাকব না কিন্তু অনাগত মানবস্রোত থাকবে। তো সেখানে আমার একটা অঙ্গীকার থাকা উচিত। আমার একটা অকৃত্রিম দায়িত্ব থাকা উচিত। দায়িত্ব, তরুণশ্রেণির বোধকে জাগ্রত করা; তাদের ধারণাকে জাগ্রত করা এবং তারা যাতে একটি যথার্থ পথ নিজেরা নির্মাণ করে নিতে পারে, তার প্রেরণা দেওয়া। আমি এ কথাও বোধ হয় বলেছিলাম কোনো এক জায়গায়, একটা মানুষকে পাগল বলা হয় কখন? যখন প্রথাবদ্ধ সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কেউ ভিন্ন আর-একটা পথে চলতে শুরু করে। যদি কেউ তার চলার পথ ও প্রেরণা অনুসরণ না করে, সে একাই চলতে থাকে আজীবন, তাহলে সে পাগল। কিন্তু তাকে যদি হাজার লোক অনুসরণ করে, ওই পথে নতুন নতুন সৃষ্টি করে চলে- তাহলে কিন্তু সে পাগল নয়।
সরকার আমিন : বিপ্লবী হতে পারে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : বিপ্লবী হতে পারে, শিল্পী হতে পারে, বিজ্ঞানী হতে পারে- আসলে সে বা তারা অনেক বড়ো ব্যতিক্রমী প্রতিভা। সব শ্রেষ্ঠ প্রতিভার মধ্যেই সৃষ্টিশীল পাগলামি থাকে।
সরকার আমিন : স্যার, আমি দেখেছি একটা জিনিস যে আপনি আপনার জীবনের চল্লিশ বছর বা ৪২ বছর শিক্ষকতার সময় ক্লাস রুমটাকে নির্ভর করে আবর্তিত হয়েছেন।
অনু হোসেন : শ্রেণিকক্ষ।
সরকার আমিন : শ্রেণিকক্ষকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এটাও আমরা জানি যে অতি আপনজনের মৃতদেহকে মস্তিষ্কে নিয়েও শ্রেণিকক্ষে ছুটে গেছেন। এই শ্রেণিকক্ষ-নির্ভর জীবন আপনি যাপন করেছেন, সামাজিক মানুষ আপনি হননি। সেই তথাকথিত অর্থে, মানে সভা-সমিতিতে যাননি, রেডিও টেলিভিশনে যাননি। এতে কি আপনার মনে হয় না যে সমাজের অন্যান্য মানুষকে সহযোগিতা করা, অন্যান্য মানুষের চেতনাকে প্রশিক্ষিত করা, শক্তিশালী করা এসব থেকে আপনি মানুষকে বঞ্চিত রেখেছেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যাঁ, হয়তো তাই। তবে আমাদের দেশে রেডিও-টেলিভিশনে- এসব জায়গায় জাতিকে বা সমাজকে প্রশিক্ষিত করবার কোনো সুযোগ নেই। নিজেকে ভিন্নতর প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করবার সুযোগ আছে, অর্থনৈতিক সুযোগ আছে, সেলিব্রেটি হবার সুযোগ আছে। আমি তা চাইনি। কিন্তু আমি সারা জীবন তরুণদের মাঝখানে থাকতে পেরেছি এবং তাদের মনের এক কোনায় ছোট্ট একটা প্রদীপ জ্বেলে দিতে পেরেছি। তার পরে ওটা হাতে নিয়ে তারা নিজেদের মতো অনেক পথ এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ যুক্তরাষ্ট্রে-অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ কানাডায়, কেউ ইংলন্ডে- এই গ্রহের সবখানে বিস্তৃত হচ্ছে। সে অর্থে কিন্তু বড়ো এক সামাজিক দায়িত্ব আমি পালন করতে চেষ্টা করেছি। ব্যক্তি-দায়িত্বটা আমি পালন করিনি। পরিবারের দায়িত্বটা আমি সামাজিকভাবে, আর্থিকভাবে যথাযথ পালন করতে হয়তো পারিনি। কথাটা ঠিক। কিন্তু পরিবারের সকলকে নৈতিক শিক্ষা, সংযম শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হইনি।
অনু হোসেন : স্যার আপনার ক্লাসের প্রতি, ছাত্রছাত্রীর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। অন্য শিক্ষকদের ক্লাস যেখানে হয় ত্রিশ বা চল্লিশ মিনিট আপনার ক্লাস সেখানে দেড় ঘণ্টা, দু ঘণ্টা। আপনার ক্লাসের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ফ্যান বন্ধ হবে, জানালা বন্ধ হবে, দরজা তো হবেই, বাইরের হইচই যাতে না আসে। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো আপনার বক্তৃতা শুনতাম, বিশ্লেষণ শুনতাম। আপনি প্রথমেই আমিনের একটা কথার জবাবে বলেছিলেন যে আপনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করবার চেষ্টা করেছেন। আপনি কি স্যার সেই প্রতিষ্ঠানটা কি দেখতে পান বা সেটা কি করা হয়ে গেছে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : তোমার প্রশ্নটা তির্যক কিন্তু জরুরি। সব পুষ্পে-মুকুলে কিন্তু ফল হয় না। তবুও আমি বলব, আমি সমর্থ হয়েছি। তোমাদের কী ধারণা? আমার মনে হয় গদ্য রচনার ক্ষেত্রে আমি যেমন প্রাতিষ্ঠানিক একটা দায়িত্ব পালন করেছি, তেমনি পাঠদান করার লক্ষে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছি। জেনে রাখা দরকার, এর মধ্যে একটি কষ্টের, দুঃখের ব্যাপার আছে। কেন সেই সময় ক্লাসকক্ষে দু-ঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টার পীড়ন করেছি? গড়ে-তোলার, উদ্বুদ্ধ করার, প্রশ্নমুখর করার কোনো বিকল্প আমার জানা ছিল না। নদী প্রবাহিত হয়। নদী যখন প্রবাহিত হয় তখন তার দুপাশের গাছপালা, ঘাস-মৃত্তিকা- এগুলোকে পুষ্ট করতে করতে যায়। সে কোথায় যায়? তার তো একটা লক্ষ্য আছে- সমুদ্র, সমুদ্র হওয়ার। সুতরাং, সে কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে করতে সমুদ্রে যাচ্ছে; আর একটা হল যেতে যেতে ক্ষুদ্র দায়িত্ব পালন করা। সে যদি সমুদ্র পেতে চাইত তাহলে প্রথম জলধারা সমুদ্রে সমর্পিত হলে বলত : ‘আমি তো সমুদ্র পেয়ে গেলাম।’ নদী কিন্তু সমুদ্র হতে চায় প্রতি মুহূর্তে। হওয়ার শেষ নেই, পাওয়ার শেষ আছে। কাজেই চলার পথের দুপাশের মৃত্তিকার কঠিন তটে যদি নদী আবদ্ধ-সংযত হওয়ার কষ্ট-দুঃখকে স্বীকার না-করত, তাহলে সে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে হাওর হয়ে যেত। প্রকৃতির লজিকে জবাব দিলাম। এমনি আমার আনন্দ। আমি বলেছিলাম যে, শিল্পিত দুঃখের কথা; মানবজীবনে বেদনা-স্বীকার-করা নির্লোভ তপস্যার প্রয়োজন আছে। জানি না কী বুঝলে! রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বসভ্যতার অনেক মনস্বী এভাবেই ভেবেছেন।
সরকার আমিন : আর একটা জায়গায় যাই স্যার, আজকের দুনিয়ার মানুষ বিভক্ত; কখনও জাতীয়তার নামে, কখনো ধর্মের নামে; এই যে সভ্যতার সংকট, রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন সভ্যতার সংকট...
সৈয়দ আকরম হোসেন : ঠিকই। ইন্টারমিডিয়েটে আমার ইতিহাস বিষয় ছিল, বিএ-তেও ছিল। সেই ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলব, সর্বকালে পৃথিবীটা এমনি ছিল, প্রতি কালই ক্রান্তিকাল। আমরা অত্যন্ত সচেতনভাবেই শতসহস্র শাসন-শোষণ-লাঞ্ছনা-বঞ্চনা অতিক্রম করে, মানবীয় সভ্যতার দিকে এগিয়ে আসছি। এখন কিন্তু মানুষের যে-কোনো বিপর্যয়ে মানুষ, আগের তুলনায়, মানুষের পাশে দাঁড়ায়। মানবীয় পরিস্থিতির ক্রম-উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে পৃথিবীতে। অবশ্য যতদিন ধন-সম্পদের অসম বণ্টন থাকবে, ততদিন সমাজ কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন হবে না। প্রায় এমনই থাকবে। নীতি-কল্যাণের প্রশ্নে শোষণের কৌশল পাল্টবে, হয়তো হ্রাসও পাবে কখনো কখনো। দ্বিতীয়ত, মানুষের জীবনের বোধের দুটো দিক আছে। একটি হল প্রযুক্তির বিকাশ আর একটি হল সস্কৃতির বিকাশ। সংস্কৃতি বলতে ঘর-বাড়ি, চিত্রকলা, কারুশিল্প-চারুশিল্প- সবটাই হল সুকুমার বৃত্তির বিকাশ। আর একটা হল মস্তিষ্কের তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের বিকাশ। একসময় এই দুটো বিকাশ ছিল পরস্পরিত, একসময় যেমন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক-তত্ত্বের সঙ্গে তাঁর বেহালার সুরের বিরোধ ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র-দের সুকুমার বৃত্তি, সাংস্কৃতিক মনোবৃত্তি, প্রযুক্তির বিজ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে অনুভূতির সংবেদনার আন্তরক্রিয়া ছিল। এই সমন্বয় থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত জ্ঞান অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছে, আর মানবীয় বোধে-মূল্যবাধে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ছি। প্রকৃতি, কল্যাণবোধ বা সাংস্কৃতিক বোধের সঙ্গে প্রযুক্তিবোধের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির ফলে আমরা সংবেদনা ও অনুভূতির প্রশ্নে ছিন্ন-বিচিছন্ন হয়ে পড়ছি। ফলেই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বাড়ছে। কিন্তু এই জায়গায়- সভ্যতার কর্ণধারদের বোঝাতে হবে, মানবীয় সুকুমারবৃত্তি, আমাদের সংস্কৃতিচেতনা, আমাদের শিল্পবোধ- যা আমাদের ত্যাগের গৌরবে, সংযমের গৌরবে সেগুলোকে উপরে তুলে ধরে, তার নিরন্তর চর্চা করতে হবে। একজন বৈজ্ঞানিক হবেন মানবিক, আবার যিনি মানবিক তিনিও কিন্তু প্রযুক্তিজ্ঞান-সমৃদ্ধ হবেন। এই বোধ-দ্বয়ের মধ্যে যদি একটি আন্তরক্রিয়া, মিথস্ক্রিয়া না হয় তাহলে, এই বিশ্ব নিরাপদ কল্যাণকর থাকবে না। অনেক পণ্ডিত আছেন, যারা এ সংকটের ভালো ব্যাখ্যা এবং সমাধানও নির্দেশ করতে পারবেন।
সরকার আমিন : স্যার এখন মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসেছে, যেখানে মানুষ সার্বভৌমভাবে নিজেকে ব্যক্ত করতে পারছে। এই ব্যক্ত হবার বিষয়টা আগে ছিল সীমিত। কেবল কয়েকটি সংবাদপত্র তার লেখা ছাপবে, রেডিও তার কথা নেবে। কিন্তু এখন নিঃসঙ্গ নারী তার বেদনার কথাটি লিখতে পারছে ফেসবুকে, টুইটারে, ব্লগে। এটা একটা সুযোগ যে মানুষ ব্যক্ত হতে পারছে। আবার এই ব্যক্ত হবার সুযোগে মানুষের রিরংসা, ক্রোধ, বেদনা, সাম্প্রদায়িকতা, বিষ বাষ্প সবই ব্যক্ত হচ্ছে। এই ব্যক্ত হবার বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সৈয়দ আকরম হোসেন : ব্যক্ত হওয়াটাতো দূষণীয় কিছু নয়। আমরা প্রযুক্তিজ্ঞানের এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছি যে দু-দশক আগে, সাতদিনের চেষ্টায় যে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতাম না, এখন তা এক মিনিটেই পারি। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এর মধ্যেও, পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। সামাজিকভাবে লক্ষ করা যাবে, হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে গেছি, সেখানে ৭/ ৮ জন বসে আছেন। তারা কেউ কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। সবই কিন্তু ফেসবুকে সামাজিক সংযোগ করছেন, ভার্চুআলি। হয়তো সংযুক্ত-ব্যক্তি লন্ডনে আছেন, অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। অথচ যে ভাই বা বোনটির জন্মদিনে তারা এসেছেন, তার সঙ্গে বিযুক্ত থেকে যাচ্ছেন ক্রমাগত। অর্থাৎ আমরা আন্তর্জাতিক-জাতিক যোগাযোগ করতে গিয়ে পারিবারিক-সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মাঝে, ‘অপতৎপরতার মাঝে ভয়ংকরভাবে ঢুকে যাচ্ছি। সভ্যতার আরেক সংকট দেখা দিতে পারে এ পথে, বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি।
অনু হোসেন : তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এর ভালো দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু মন্দের দিকও অনেক সময় প্রবল হয়ে উঠতে পারে।
সৈয়দ আকরম হোসেন : উঠবেই, কারণ কী জানো, এটা কিন্তু কারো দোষ নয়। রবীন্দ্রনাথ একটা খুব চমৎকার কথা বলেছেন, যে দক্ষিণের দুয়ার খোলা রাখবে, সেখানে ধুলোবালি-ঝরাপাতা ঢুকবে না, তা তো হয় না। ‘অমঙ্গলকে উড়াইয়া দিও না সে মঙ্গল সহিত উড়িয়া যাইবে’। রবীন্দ্রনাথ সব যুগ্মবৈপরীত্যকে উপলব্ধি করে গেছেন। আমাদের এগোতে হবে, কিন্তু এগোতে গেলে তো সমস্যা আসবেই, তাই বলে কি বলব এইসব আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের দরকার নেই? প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে কিন্তু আমাকে এই শিক্ষাটাও দিতে হবে যে আমার কিন্তু আর-একটা সমাজ-পরিবার-নীতি-মূল্যবোধ আছে। ফেসবুকের সমাজ এবং পারিবারিক-সমাজ এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয় রক্ষা করা জরুরি। জাতীয়ভাবে-পারিবারিকভাবে-সামাজিকভাবে সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ-সজাগতা প্রয়োজন।
সরকার আমিন : স্যার আপনার একটু আগের কথাটাতে যাই, কবিতাকে আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম বলে মনে করেন।
সৈয়দ আকরম হোসেন : পৃথিবীর আদি সৃষ্টিই তো কবিতা।...আমি বারংবার বলে থাকি, কবিতা মানুষকে সংবেদনশীল করে, মানুষের উদ্ভাবনশক্তি-সম্পন্ন করে, চিত্রকল্পময় করে, নির্বস্তুক ভাবনাকে রূপদক্ষতার সাহায্যে উপস্থান করতে সাহায্য করে।
সরকার আমিন : কিন্তু মনে হয় না কি মানুষ কবিতা থেকে সরে গেছে?
সৈয়দ আকরম হোসেন : হ্যা [হাসি] খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। আপাতভাবে মনে হয়, সম্প্রতি মানুষ কবিতা কম পড়ে, কবিতা থেকে সরে আসছে। তাই না? প্রাচীন এবং মধ্যযুগে কবিতা পড়া হত, কারণ কবিতা ছিল ধর্মের অংশ, ধর্মচর্চার উপকরণ। ঐ সময় মঙ্গলকাব্য পড়া হত পার্থিব-অপার্থিব মঙ্গলের প্রার্থনায়। বৈষ্ণব কবিতার মধ্যে ছিল বৈষ্ণবধমর্, দর্শন। চরিত-সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাস-ভূগোল-জীবন কাহিনি পড়ছে, সেকালে সবাই কি কবিতা পড়ছে? কলকাতায় নব-উদ্ভূত শাহরিক মধ্যবিত্তের হাত ধরে যখন তথাকথিত পুনর্জাগরণ ঘটল, গদ্যের উদ্ভব ঘটল এবং গদ্যের মধ্যে আশ্রয় নিল ইতিহাস-ভূগোল, ধর্মচর্চা, ধর্মতত্ত্ব, পারলৌকিক সাধনা ইত্যাদি। কবিতা তখন ধর্ম-বাহন মুক্ত হতে শুরু করল। একালে কবিতা পাঠ করলে কোনো স্বর্গ-পরমার্র্থ লাভের সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও যারা পড়ছেন তারা কিন্তু কেবল কবিতারই পাঠক। আগে যারা পড়তেন, শুনতেন- তারা ছিলেন ধর্মপাঠক, শ্রুতিফলপ্রার্থী। কবিতার নয়।
সরকার আমিন : খুব ভালো বলেছেন স্যার [হাসি]
অনু হোসেন : কবিতার পাঠক উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাক।
সরকার আমিন : অনু এবার বাকি প্রশ্নগুলো করো।
অনু হোসেন : আর কি বাকি আছে, ব্যক্তিগত?
সৈয়দ আকরম হোসেন : আমার তো ব্যক্তিগত কিছু নেই।
সরকার আমিন : স্যার আপনার এই কথাগুলো বইয়ে তো থাকবেই, ক্লাউডেও অনন্তকাল থাকবে। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
সৈয়দ আকরম হোসেন : তোমাদেরকেও ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা নিরন্তর। কল্যাণ হোক।
শ্রুতিলিখন : মহুয়া আবেদিন কণা, মুহম্মদ শহীদ-উদ্দীন, মিনহাজুল ইসলাম, মনিরুল মৃধা